পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে সুপারিশমালা

জেনারেল ইব্রাহীম
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক
স্বাধীন বাংলাদেশের ভৌগোলিক মানচিত্রের দক্ষিণ-পূর্বে একটি লম্বা ভূখণ্ড পাওয়া যায়। ১৫৫ বা ১৬০ বা ১৭০ এই রূপ বছর পূর্বে, ওই ভূখণ্ডের নাম ছিল চট্টগ্রাম (ইংরেজি পরিভাষায় চিটাগং)। আজ থেকে ১৫৫ বছর আগে, ১৮৬০ সালে, তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের সরকার তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলার পূর্ব অংশের পার্বত্য অঞ্চলকে আলাদা একটা প্রশাসনিক ইউনিট তথা একটি নতুন জেলার সৃষ্টি করা হয়। ১৮৬০ সালের চট্টগ্রাম জেলার পার্বত্য অঞ্চলকে নিয়ে সৃষ্ট নতুন জেলার নাম দেয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। সেই সময় জেলার নামটি ইংরেজিতেই বেশি পরিচিতি পায়। ইংরেজি ভাষায় নামটি ছিল ‘হিল ট্রাক্টস অব চিটাগং’। বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে নামটি হয়ে যায় চিটাগং হিল ট্রাক্টস। ১৮৬০-এর পরে গুরুত্বপূর্ণ বছর হলো ১৯০০ সাল। এই সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনের জন্য একটি নতুন বিধিমালা চালু করে। সেটি ১৯০০ সালের এক নম্বর রেগুলেশন নামে পরিচিত। সেই রেগুলেশনটি এখনো বহুলাংশে প্রযোজ্য। এর পরের গুরুত্বপূর্ণ বছর হলো ১৯৪৭ সাল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুইটি নতুন রাষ্ট্র যখন সৃষ্টি হয়, তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাটি পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। ১৯৭১ সালে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে যায়। অতএব, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাও বাংলাদেশের অংশ হিসেবে অব্যাহত থাকে। এর পরের গুরুত্বপূর্ণ বছর হলো ১৯৮৪ সাল। এই বছরে সমগ্র বাংলাদেশে সব মহকুমাকে আপগ্রেড বা মানোন্নয়ন করে জেলা বানানো হয়। ওই আমলে বাংলাদেশে ১৯টি জেলা ছিল। এই ১৯টি জেলার মধ্যে ৬৪টি মহকুমা ছিল। এই ৬৪টি মহকুমাকেই জেলায় উন্নীত করা হয়। অতএব, চট্টগ্রাম জেলার দুইটি মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়ে নতুন পরিচয় পায়। চট্টগ্রাম সদর মহকুমা হয়ে যায় চট্টগ্রাম জেলা এবং কক্সবাজার মহকুমা হয়ে যায় কক্সবাজার জেলা। একই ধারাবাহিকতায়, ১৯৮৪ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় যে তিনটি মহকুমা ছিল এই তিনটি মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়। নতুন তিনটি জেলা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর অংশে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা, পার্বত্য চট্টগ্রামের মাঝামাঝি এলাকায় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ অংশে বান্দরবান পার্বত্য জেলা। বিভিন্ন আলাপ-আলোচনায় বা লেখালেখিতে তিনটি জেলাকেই একসাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা বা লেখালেখিতে তিনটি জেলা সম্পর্কে আলাদা আলাদাভাবে সম্বোধন করা হয় না। ওই সাতটি কলামে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম নামটি ব্যবহার করেছি। ওই সাতটি কলামের ধারাবাহিকতায় অষ্টম এবং শেষ কলামটি হচ্ছে আজকের কলাম। বিগত সাতটি কলামে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমসাময়িক অশান্ত বা অস্থিতিশীল পরিবেশ এবং তার প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করেছি। আলোচনার উদ্দেশ্য, দেশবাসীকে বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে অবহিত করা। অনেক কিছুই আলোচনা করেছি; সব কিছু আলোচনা করা সম্ভব নয়। ওই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের কলামে কিছু সুপারিশমালা উপস্থাপন করতে চাই। এই সুপারিশগুলোও স্বয়ংসম্পূর্ণ বা ‘কমপ্রিহেনসিভ’ নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনগোষ্ঠীর অবস্থান
পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন সুস্পষ্টভাবে দুই নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বসবাসরত। একটি হচ্ছে বাঙালি জনগোষ্ঠী, আরেকটি হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। উভয় ধরনের জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি সূচকে গুরুতর তফাৎ ও ভারসাম্যহীনতা বিদ্যমান। একই ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু সুবিধাভোগী থাকবে এবং কিছু সুবিধাবঞ্চিত থাকবে এটা কাম্য নয়; এটা বাঞ্ছনীয় নয়। অতএব, গত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে সৃষ্ট ভারসাম্যহীনতা লাঘবের জন্য বা সংশোধনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপটি হবে একটি সিদ্ধান্তগ্রহণ। সিদ্ধান্তটা কী? সিদ্ধান্ত হচ্ছে- ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনগোষ্ঠী যতসংখ্যক আছে এবং যেমন আছে, তেমন থাকবে।’ অর্থাৎ এই বিষয়ে দোদুল্যমানতা অথবা রাখঢাক-ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। এই সিদ্ধান্ত সবাইকে জানাতে হবে, মুখে না হলেও কর্মের মাধ্যমে। এই বিষয় নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের সাথে, আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে বা আধা আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে আলোচনা ও সংলাপ হতে পারে; তর্কবিতর্ক হতে পারে, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও খণ্ডন হতে পারে; কিন্তু সব কিছুর শেষে একটি মোটামুটি সর্বজনসম্মত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন হবে। সর্বজনসম্মত না হলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠসম্মত হওয়া বাঞ্ছনীয়। সিদ্ধান্তটি হলো- আমার মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনগোষ্ঠী যতসংখ্যক আছে এবং যেমন আছে, তেমন থাকবে। এই সিদ্ধান্তটি এত বেশি সংবেদনশীল বা সেনসেটিভ ও ক্রিটিক্যাল; এটি গ্রহণ না করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে অব্যাহতভাবে একটি অস্থিতিশীল ও সঙ্ঘাতময় পরিবেশ বজায় থাকবে। এই রূপ অস্থিতিশীল ও সঙ্ঘাতময় পরিবেশে অর্থবহ শান্তি কামনা করা বাতুলতা, তাৎপর্যবাহী আর্থসামাজিক উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা বাতুলতা। অপর পক্ষে এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি আর্থসামাজিক আঙ্গিকের সম্ভাবনাময় অঞ্চল। অতএব ওই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে আমাদেরকে পরিবেশ উন্নত করতে হবে। আমি এই কলামের বাকি কথাগুলো লিখছি এটা মেনে নিয়ে যে, বাঙালিরা যেমন আছে তেমন থাকবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ
পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল, আস্থাহীন অশান্ত পরিবেশের পেছনে অন্যতম কারণ ভূমিসমস্যা। তিন শ’ থেকে পাঁচ শ’ বছর আগে মোগল আমলে যে নিয়মে ভূমির মালিকানা ও ভূমি প্রশাসন নির্ধারিত হয়েছিল, সেটি ব্রিটিশ আমলে সংশোধিত বা পরিমার্জিত হয়ে একটি রূপ নেয়। পাকিস্তান আমলেও ওই ব্রিটিশ পদ্ধতিই চালু ছিল। বাংলাদেশ আমলেও চালু আছে। পৃথিবীব্যাপী পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে ভূমি সংস্কার হয়েছে। তাই বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলেও ভূমি সংস্কার প্রয়োজন। সমস্যাটি থেকে উত্তরণের জন্য ব্যতিক্রমী মেধা ও ব্যতিক্রমী চিন্তাশক্তি ধারণ করে এমন রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক নেতাদের কাছ থেকে দূরদর্শিতাপূর্ণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো দিন কোনো জরিপ হয়নি এটা যেমন সত্য, এটাও সত্য যে- কোনো-না-কোনো দিন জরিপ হতেই হবে। অতএব ভূমিজরিপ শুরু করা প্রয়োজন। এটাকে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে বলেন বা অন্য যেই নামেই অভিহিত করেন না কেন, মূল কথা হলো মোট জমির পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে এবং ওই মোট জমির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারের জন্য জমির শ্রেণিবিন্যাস ও আয়তন নির্ধারণ করতে হবে। তারপর যেই অংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন দেয়া উচিত বলে সরকার এবং সরকারকে উপদেশদাতা কর্তৃপক্ষ মনে করবে, সেই জমিগুলো ব্যক্তিমালিকানায় বা সমষ্টিমালিকানায় দিতে হবে। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিগুলোর মালিক কারা হবে? এই মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরাই মালিক হবে। তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা যেহেতু সমষ্টিগতভাবে মালিকানার পদ্ধতিতে শত বছর জীবনযাপন করে আসছেন, তাদেরকে ব্যক্তিমালিকানার সাথে পরিচিত করার জন্য পাঁচ বছর, সাত বছর বা দশ বছর মেয়াদি কুশন পিরিয়ড দিতে হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা আল্লাহর দেয়া পাহাড়ে, নিজস্ব ঐতিহ্য মোতাবেক সমষ্টিগত প্রচেষ্টায়, জুম চাষ করতে অভ্যস্ত। সেই জনগোষ্ঠীকে জুম চাষের অভ্যাস থেকে সরিয়ে এনে বিকল্প অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য পাঁচ বা দশ বা পনেরো বা বিশ বছর মেয়াদি আর্থসামাজিক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সার্ভে করার সাথে সথেই কারো-না-কারো নাম লিখে দিতে হবে, এমন কথা ঠিক নয়। এক শ’টি ক্ষেত্রের মধ্যে, নব্বইটি ক্ষেত্রেই এ কথা ঠিক যে, নামীয় জমি সার্ভে হয়। এখন থেকে দুই শ’ বা আড়াই শ’ বছর আগে কি এই নিয়মেই সার্ভে শুরু হয়নি? অতএব আমাদেরকে মেনে নিতে হবে যে, নাম নির্ধারণের আগেও জরিপের প্রয়োজন আছে। তাই সরকারি ও বেসারকারি বুদ্ধিমান জ্ঞানী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সরকার এই প্রসঙ্গে একটি উপায় বের করার এবং কাজটি শুরু করা প্রয়োজন। সাবেক জনসংহতি সমিতি বা সাবেক শান্তিবাহিনীর নেতাগণ বা বর্তমানের বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নেতারা যুক্তি উপস্থাপন করবেন এই মর্মে যে, জরিপ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাঙালিদের বসতিস্থাপনে সুযোগ-সুবিধা দেয়া। এই যুক্তির উত্তর সরকার দেবে। এখানে উল্লেখ করে রাখব, জরিপের মাধ্যমে ফলাফল ও সিদ্ধান্তগুলো আগ্রাসী মহলের আগ্রাসী মনোভাবকে সীমিত করবে বা রশি টেনে ধরবে এবং অপর পক্ষে বিপন্ন ও বঞ্চিত মহলের স্বার্থকে সুরক্ষিত করবে। কে নিজেকে আগ্রাসী বা বিপন্ন মনোভাবাপন্ন মনে করে বা করে না, সে প্রসঙ্গে কিছু বলছি না। সরকারের প্রতি পরামর্শ, ধানাইপানাই করে অথবা ধরি মাছ না ছুঁই পানি মনোভাব নিয়ে এত বড় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সরকারের প্রতি আবেদন, সাহস আর আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসুন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নেতাদের প্রতি এবং বাঙালি জনগোষ্ঠীর নেতাদের প্রতি আমার যুগপৎ আবেদন- সঙ্ঘাতপূর্ণ পরিবেশ থেকে উত্তরণের জন্য কিছু ত্যাগী পদক্ষেপ আপনাদেরকে নিতে হবে। এর জন্য মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। এর জন্য ত্যাগী প্রশাসক ও আমলা প্রয়োজন। সেই প্রশাসক ও আমলা সামরিকও হতে পারেন বেসামরিকও হতে পারেন।
উপজাতি ও আদিবাসী শব্দের ব্যবহার নিষিদ্ধ
পার্বত্য চট্টগ্রামে ১২টি বা ১৩টি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস। এই ১২টি বা ১৩টির মধ্যে তিনটি খুব বড়; যথা চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা উপজাতি। আর একটি আছে যারা তুলনায় একটু ছোট, যথা তংচংগা উপজাতি। অন্যগুলো ছোট, কয়েকটি খুবই ছোট। এই ১২টি বা ১৩টি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রধান তিনটির যথা চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা উপজাতির আলাদা আলাদা মুখের ভাষা লিখিত ভাষা আছে। অন্য তিন-চারটির মুখের কথা আছে, লিখিত ভাষা নেই। কিন্তু এই ১২টি বা ১৩টি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীই মাত্র বাংলাদেশের উপজাতি নয়। বাংলাদেশের অন্য কয়েকটি জেলা বা অঞ্চলে, যথা বৃহত্তর দিনাজপুর, বৃহত্তর রাজশাহী, বৃহত্তর ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল, বৃহত্তর সিলেট ও পটুয়াখালী জেলায় অন্যান্য আরো অনেক উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস আছে। ‘উপজাতি’ শব্দটির উৎপত্তি হচ্ছে ‘জাতি’ শব্দ থেকে। ইংরেজিতে জাতি মানে নেশন এবং উপজাতি অর্থ ট্রাইব। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী বা অন্যত্র বসবাসরত উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কেউই ‘উপজাতি’ শব্দটি পছন্দ করে না। তাদেরকে সরকারিভাবেও উপজাতীয় শব্দটি ব্যবহার বন্ধ করে অন্য শব্দ ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি। আমি দুইটি মোটামুটি সুপরিচিত শব্দ বা শব্দযুগল উপস্থাপন করছি : ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। ১৯৮৮ সাল থেকে আরেকটি শব্দযুগল পরিচিত হয়েছিল, যথা- অ-উপজাতীয়। অ-উপজাতীয় মানে বাঙালি। অতএব, উপজাতীয় শব্দটির ব্যবহার বন্ধ করা হলে অ-উপজাতীয় শব্দটিও আর ব্যবহার হবে না। অ-উপজাতীয় শব্দের পরিবর্তে বাঙালি শব্দটি ব্যবহৃত হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিরা সারা বাংলাদেশের বাঙালিদের মতোই মুখের ও লিখিত ভাষা অনুসরণ করে। জেনেশুনে বিষ পান করা যেমন নিজের ধ্বংস টেনে আনে, তেমনই জেনেশুনে আদিবাসী শব্দের ব্যবহার আমাদের জন্য ধ্বংস টেনে আনবে। অতএব পত্রপত্রিকায় এবং বক্তৃতা-বিবৃতিতে, আদিবাসী শব্দ ব্যবহার বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
বাংলাদেশ বহুজাতিক দেশ : সাংবিধানিক স্বীকৃতি
জাতিগঠন একটি কঠিন প্রক্রিয়া। আপনা-আপনি একটি জাতি গঠিত হয় না। স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক দেশ, বাঙালি জাতি এবং আরো অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার দেশ। সবাই মিলে একটি দেশ গঠন করবে; যে দেশের নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সংবিধানে এই ধারণার স্বীকৃতি থাকা চাই। জোর করে কাউকে বাঙালি বানানোর প্রয়োজন নেই। এতে হিতে বিপরীত হয়। সব জাতিসত্তার প্রকাশ্য উপযুক্ত স্বীকৃতি জাতিগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ভাগ্য এবং মর্যাদা উন্নয়নের লক্ষ্যে, প্রায় বাইশ বছর ধরে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে এবং সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করে। অপর পক্ষে বাংলাদেশ সরকারও, ওই এলাকার জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং মর্যাদা উন্নয়নের লক্ষ্যে আজ অবধি অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারি পদক্ষেপগুলোর কী ফলাফল পাওয়া গেল তার একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন সরকারকে জাতির সামনে উপস্থাপন করতে হবে। উপস্থাপন করবে বাংলাদেশ সরকার। ওই প্রতিবেদন প্রস্তুতের আগে অনেক গবেষণা করতে হবে। গবেষণার বন্দোবস্ত করবে বাংলাদেশ সরকার এবং সহযোগিতা আহরণ করবে রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিনটি জেলার তিনটি জেলা পরিষদ থেকে। এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে শিক্ষিত মহলের উপকার করবে। এই প্রতিবেদন পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে বিদেশীদেরকেও হালনাগাদ রাখবে।
বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা বাড়ানো 
পার্বত্য চট্টগ্রামে ইনসার্জেন্সি ও কাউন্টার ইনসার্জেন্সি বিরাজমান ছিল। এ কারণে মানুষের মনের ভেতরে অনেক প্রকারের ক্ষোভ, অভিমান, অভিযোগ, অনুযোগ জমা হয়ে আছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘর্ষ বিরত করা হয় এবং শান্তি শুরু করা হয়। কিন্তু কাগজের কথায় মানুষের মনে শান্তি আসে না। শুধু বক্তৃতার কথা শুনে মানুষের মনে শান্তি আসে না। মানুষের মনে যেসব কারণে শান্তি আসে মানুষের পারস্পরিক আন্তরিক আচার-আচরণ থেকে। যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামে ১২টি বা ১৩টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আছে এবং বাঙালি জনগোষ্ঠী আছে, সে জন্য পরিকল্পিতভাবে কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন- যার মাধ্যমে বাঙালি ও অবাঙালি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মেলামেশা বাড়ে, পারস্পরিক আস্থা ও সম্মান বাড়ে এবং পারস্পরিকভাবে একে অপরকে নিরাপত্তা দেয়ার আগ্রহ বাড়ে। এই কাজগুলোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ সরকার ও সরকারের মাধ্যমে রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত আঞ্চলিক পরিষদ এবং তিনটি জেলার তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ করবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কোটাপদ্ধতি
এখন থেকে ৪০-৪৪ বছর আগে মূল্যায়ন করা হয়েছিল যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষগুলো বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলের মানুষের তুলনায় অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত। এই মূল্যায়নের ফলে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিয়ে এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থা কায়েম করে। যার মাধ্যমে ওই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষগুলো অনগ্রসর অবস্থান থেকে ক্রমান্বয়ে অগ্রসর অবস্থানে যেতে পারে। আজ ৪৪ বছর পর সময় এসেছে তাদের অগ্রসর হওয়ার মাত্রা কতটুকু, তাদেরকে অগ্রসর হওয়ার জন্য যেই সুবিধাগুলো দেয়া হয়েছিল, সেই সুবিধাগুলো অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা এখনো আছে কি না, সেটা এখন ২০১৫ সালে মূল্যায়ন করা জরুরি। শুধু আলোচনার খাতিরে মাত্র একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। উপজাতীয় তথা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর কিশোর ও তরুণদের জন্য দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য দেশে ও বিদেশে একটা কোটা পায়। ক্যাডেট কলেজে ভর্তি, ঢাবি-চবি প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, বুয়েট-চুয়েট প্রভৃতি বিশেষ প্রকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, পিএসসির মাধ্যমে সরকারি চাকরিপ্রাপ্তি, বিদেশে লেখাপড়ার জন্য বৃত্তি সব কিছুতেই এই কোটাপ্রথার সুবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর কিশোর ও তরুণেরা সুবিধা পায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক সীমানার ভেতরে, সব কিছুতেই, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা অগ্রাধিকার পায়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব ও তথ্য হলো এই যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও অনেকেই উল্লেখযোগ্যভাবে সবল এবং সব কিছুর ভাগ বেশি পায়; অপর পক্ষে অনেকেই এত দুর্বল যে, তাদের ভাগ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। অপর ভাষায় বলা যায়, এই কোটাপ্রথার সুবিধা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী পায়। অতএব, এই কোটাপ্রথা আর বহাল রাখা প্রয়োজন আছে কি না মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। আমার মতে, প্রয়োজন নেই। আর যদি বহাল রাখতেই হয় তাহলে কোটাপ্রথার সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞা বদলাতে হবে। ১৯৭৩ বা ৭৪ বা ৭৬ বা ৭৮ সালে বা ৮৪ সালে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর জন্য যেই কোটাপ্রথা চালু করা হয়েছিল এবং এখনো অব্যাহত আছে। এর নাম বদলে ‘পার্বত্য জনগোষ্ঠী কোটা’ বলা ও প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বাচন
পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিপ্রক্রিয়া প্রসঙ্গে আমার লেখা বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। বইটির নাম ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিপ্রক্রিয়া পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন’। বিস্তারিত বিবরণ আমার ওয়েবসাইটে আছে। ওয়েবসাইট কলামের শেষে দেয়া আছে। এখানে শুধু এতটুকু বলি যে- প্রক্রিয়া আগে না হলেও, অন্ততপক্ষে ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হয়েছিল। ওই প্রক্রিয়ায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল দুইটি; যথা- ০১. ১৯৮৮-৮৯ এবং ০২. ১৯৯৬-৯৭। ১৯৮৮-৮৯ সালের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনটি পার্বত্য জেলায় আলাদা আলাদা পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়েছিল। ১৯৯৬-৯৭ সালের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, তিনটি পার্বত্য জেলার জন্য, তিনটি জেলা পরিষদের ওপরে, একটি পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। ১৯৮৯ সালের ২৫ জুন তারিখে তিনটি পার্বত্য জেলায়, সার্বজনীন ভোটারপদ্ধতিতে, জেলা পরিষদ নির্বাচিত হয়েছিল। তখন আমি খাগড়াছড়ির ব্রিগেড কমান্ডার ছিলাম। এর পর থেকে আর কোনো নির্বাচন হয়নি। ১৯৯৭-এর শান্তিচুক্তি মোতাবেক আঞ্চলিক পরিষদও নির্বাচিত হওয়ার কথা। কিন্তু বিভিন্ন ফ্যাকড়ার কারণে, সেই নির্বাচন আজ অবধি অনুষ্ঠিত হয়নি। মনোনীত ব্যক্তিদের দিয়ে নির্বাচিত পরিষদের কাজ চালানোর চেষ্টা চলছে পনেরো-বিশ বছর ধরে। এটা ভালো না। অতএব, সার্বজনীন ভোটারপদ্ধতিতে জেলা পরিষদ এবং আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করছি। এই মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সব ভোটার, ওই পরিষদগুলোর নির্বাচনে ভোট দেবেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর কিছু কিছু নেতা, আঞ্চলিক পরিষদের নেতৃবৃন্দ, জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ এবং ইউপিডিএফের নেতৃবৃন্দ আমার এই সুপারিশের বিরোধিতা করার সম্ভাবনা শতভাগ। সরকার তাদের সাথে আলোচনা করবে এবং ইতিবাচক সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। কারণ আজ হোক অথবা কাল হোক, বাস্তবতা যতই অপ্রিয় হোক না কেন, সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হতেই হবে। সিদ্ধান্ত না নিয়ে দেরি করা সব সময় ভালো প্রক্রিয়া নয়।
শান্তিচুক্তির মূল্যায়ন তথা ‘পিস-অডিট’
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির জন্য ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই শান্তিচুক্তির ভিত্তি ছিল দুইটি। প্রথম ভিত্তি হলো ১৯৮৮-৮৯ সালের শান্তিপ্রক্রিয়া; দ্বিতীয় ভিত্তি হলো ১৯৯৬-৯৭ সালে পরিচালিত শান্তি সংলাপ। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে বিপরীতমুখী মতামত বিদ্যমান। কেউ বলেন এতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, কেউ বলেন অতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে। কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে সেটা নিরপেক্ষ ‘অডিট’-এর মাধ্যমে তথা নিরপেক্ষ মূল্যায়নকারীদের মাধ্যমে আবিষ্কার করা প্রয়োজন। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। ১৯৯৭ সালের চুক্তিতে এমন কিছু ধারা আছে, যেই ধারাগুলো আদৌ বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে আমি মনে করি। অতএব, ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। অভিজ্ঞ পার্লামেন্ট সদস্য, অভিজ্ঞ সামরিক ব্যক্তি, অভিজ্ঞ বেসামরিক আমলা, মোটামুটিভাবে সর্বজনগ্রাহ্য পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালি ও অবাঙালি নেতৃবৃন্দকে নিয়ে পুনর্মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই পুনর্মূল্যায়ন ব্যতীত শান্তিচুক্তির উপকারিতা আবিষ্কার করা কঠিন।
শেষ কথা
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সমস্যাটির সমাধান, বাংলাদেশের জাতিগঠন প্রক্রিয়ার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতকে নিয়ে গঠিত অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যের বিনিময়, মানুষের মনে স্বচ্ছতা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। এই উদ্দেশ্যগুলোকে সামনে রেখে আগে সাতটি এবং আজকে একটি মোট আটটি কলাম লিখলাম। কলামগুলো প্রকাশের তারিখ- মার্চ ১১, ১৮, ২৫, এপ্রিল ০২, ০৮, ১৫, ২২ এবং মে ০৬। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, মানবীয় অনিচ্ছাকৃত ভুলভ্রান্তিগুলো সম্মানিত পাঠক উপেক্ষা করবেন।
লেখক : মেজর জেনারেল অব:; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন