পাহাড়ে এই বৈষম্যের শেষ কোথায়?

fec-image

১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তৎকালীন সরকার সমতল হতে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তর করে। তাদের এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া, জীবন-জীবিকা সহজসাধ্য ছিল না। বলতে গেলে তাদের গহীন জঙ্গলে হিংস্র বাঘের মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। জীবন রক্ষার তাগিদে খেয়ে না খেয়ে সংগ্রাম করে দেশের মানচিত্র পাহারা দিতে হয়েছে তাদের।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী পার্বত্য বাঙালি। ২০২২ সালের জনশুমারির রিপোর্ট অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলায় মোট জনসংখ্যা ১৮,৪২,৮১৫ জন। এর মধ্যে বাঙালি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৯,২২,৫৯৮ জন (৫০.০৬%) এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ৯,২০,২১৭ (৪৯.৯৪%) জন। অর্থাৎ জনশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী পাহাড়ের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক পার্বত্য বাঙালি। এই বাঙালি জনগোষ্ঠী ভিন্ন কোন দেশ থেকে উড়ে এসে পাহাড়ে জুড়ে বসা কিংবা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নয়। তারা প্রত্যেকেই বাংলাদেশের মূল স্রোতের নাগরিক। জাতিগতভাবে তাদের আলাদা ভাবার কোনো সুযোগ নাই।

১৯৭৯ সালে আমার দাদা পাহাড়ে পুনর্বাসিত হয়েছিল। জন্মসূত্রে আজ আমিও পাহাড়ের বাঙালি। সমতল সম্পর্কে আমার ধারণা নেই বললেই চলে। আমার প্রতিবেশী একজন উপজাতি বন্ধু, যে পরিবেশে বড় হয়েছে ঠিক একই পরিবেশে আমিও বড় হয়েছি। আর্থসামাজিক দিক হতে উপজাতি বন্ধুরা পিছিয়ে আছে এমনটা ভাবার সুযোগ নাই। বরং পার্বত্য বাঙালিরা অর্থাৎ আমরা তাদের তুলনায় বেশ পিছিয়ে আছি। তারপরেও একই পরিবেশে বড় হয়ে তার আর আমার মধ্যে নাগরিক সুবিধাগত পার্থক্য কেন থাকবে?

অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের অন্য সকল অঞ্চল হতে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। রাষ্ট্রের নাগরিক সুবিধায় এই অঞ্চলকে অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করা উচিত। তবে সেটা জাতি গোষ্ঠী দেখে কেন?

সঙ্গত কারণে প্রশ্ন থাকে যে, পার্বত্য বাঙালিরা কি এদেশের নাগরিক না? সমতল হতে পাহাড়ে এসে বসবাস করা কিংবা পাহাড়ে আমার জন্ম নেওয়া কি অপরাধ? নাকি পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশেরই অংশ নয়? যদি বাংলাদেশেরই অংশ হবে, তবে কেন বাঙালি হওয়ার অপরাধে পাহাড়ের বাঙালিদের সর্বদিক হতে পিছিয়ে রাখা হবে?

একটি রাষ্ট্রে যুগের পর যুগ তার মূল স্রোতের নাগরিকদের এভাবে পিছিয়ে রাখার নজির সম্ভবত বাংলাদেশেই প্রথম। পাহাড়ের বাঙালিরা যেন রাষ্ট্রের পরগাছা।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেখুন, তিন জেলা হতে তিনটি আসনে বরাবরই মনোনয়ন দেওয়া হয় উপজাতি দেখে। পার্বত্য তিন সংসদ সদস্য উপজাতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান উপজাতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান উপজাতি, তিন সার্কেল প্রধান উপজাতি, তিন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উপজাতি। সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে মহান জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে যাকে নির্বাচিত করা হলো তিনিও উপজাতি।

পার্বত্য বাঙালিরা প্রত্যাশা করেছিল, অন্তত সংরক্ষিত নারী আসনে বাঙালিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। কেননা গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে পাহাড়ের বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব নাই। উল্লেখিত এত এত উপজাতিদের পদের ভিড়ে একটি মাত্র পদ বাঙালিরা প্রত্যাশা করতেই পারে। কিন্তু, সে আশায় গুড়েবালি। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, এবার রাঙ্গামাটি থেকে যাকে সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচিত করা হয়েছে, তাকে জেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই ঠিকমতো চেনেন না।

রাজনীতির পরে শিক্ষা!
পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন উপজাতি পরিবারের সন্তান উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে এবং খুব সহজে চলে যায়। অথচ, তার চেয়েও মেধাবী হয়ে একজন পার্বত্য বাঙালি পরিবারের সন্তান চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখার সুযোগও পায় না।

বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গেলে দেখা যায় ৬৪ মার্কস পেয়েও পার্বত্য বাঙালি পরিবারের সন্তান পড়ালেখার সুযোগ পায় না। কিন্তু ৪৩ মার্কস পেয়ে একজন উপজাতি ছাত্র খুব সহজেই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রতিবছর ছাত্রছাত্রীদের মেধা বৃত্তি প্রদান করা হয়। এখানেও দেখা যায়, নামে মাত্র কয়েকজন পার্বত্য বাঙালি ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি দিয়ে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় উপজাতি ছাত্রছাত্রীদের। দরিদ্র মেধাবী বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখার পর্যাপ্ত সুযোগ নাই। কিন্তু, উপজাতীয় ছাত্রছাত্রীদের পাশে দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থার অভাব নাই।

পাহাড়ের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী পার্বত্য বাঙালি। অর্থাৎ পাহাড়ের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক এই জাতি আসলেই যে পাহাড়ের নাগরিক সেটা যেন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা জেনেও জানেন না।

শিক্ষার পরে আসুন দেখি চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালিদের কী অবস্থা!
পার্বত্য বাঙালিদের মেধা আছে, যোগ্যতা আছে, কিন্তু মূল্যায়ন নাই। একই ক্লাসের প্রথম বেঞ্চের ছাত্র বাঙালি, পরের বেঞ্চ কিংবা শেষ বেঞ্চের ছাত্র উপজাতি। বিসিএস পরীক্ষায় দেখা যায় ক্লাসের শেষ বেঞ্চের ছাত্রটা উপজাতি হওয়ায় বিসিএস ক্যাডার, আর প্রথম বেঞ্চের ছাত্র বাঙালি হওয়ায় সেই অফিসের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী।
তবে বিসিএসে উপজাতি কোটা প্রথা বন্ধ হওয়ার পর এই চিত্রটা বদলালেও, দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগের ক্ষেত্রে একচেটিয়া প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে উপজাতিদের।

ইদানিং বিভিন্ন কোম্পানির চাকরিতে মাঠ পর্যায়ে বাঙালিদের অবস্থান চোখে পড়ার মতো। আর সরকারি অফিসগুলোতে উপজাতিদের একচ্ছত্র প্রভাব বিদ্যমান। সরকারি চাকরিতে ১ জন বাঙালির বিপরীতে রয়েছে প্রায় অন্তত ৫ জন উপজাতি। এর কারণ হচ্ছে, সরকারি চাকরি না পেয়ে শিক্ষিত বেকার বাঙালিরা কোম্পানির চাকরি করে কোনোমতে জীবনযাপন করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা পরিষদে সরকারের ৩২টি দপ্তর ন্যাস্ত। প্রতিটি দপ্তরের কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয় জেলা পরিষদের মাধ্যমে। জাতিগত কোটা ভিত্তিক নিয়োগে জেলা পরিষদে বরাবরই মেধাবী পার্বত্য বাঙালিরা উপেক্ষিত।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সর্বোচ্চ বাঙালি জনবসতিপূর্ণ একটি উপজেলা লংগদু। এই উপজেলায় মোট জনসংখ্যা ৮৪,৪৭৭ জন। যার মধ্যে ৬৩,৫৯৫ জন বাঙালি এবং ২০,৮৮২ জন উপজাতি। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৭৫% হচ্ছে বাঙালি। বাঙালি জনগোষ্ঠীবহুল লংগদু উপজেলায় রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের বিভিন্ন নিয়োগে দেখা যায় যে, ৬৫% উপজাতিদের জন্য এবং ৩৫% বাঙালিদের জন্য বরাদ্দ রেখে নিয়োগ দেওয়া হয়।

জনসংখ্যার দিক থেকে লংগদু উপজেলায় উপজাতিরা ২৫%। কিন্তু, চাকরি ক্ষেত্রে তাদের জন্য বরাদ্দ ৬৫% পদ বরাদ্দ থাকে। এই যদি হয় বাঙালি অধ্যুষিত উপজেলার চিত্র তাহলে নানিয়াচর, বরকল, বিলাইছড়ি, জুরাইছড়ি, রাজস্থলী উপজেলার চিত্র কী? যেখানে জনসংখ্যার দিক থেকে বাঙালিরা কম?

সুতরাং কোটাভিত্তিক অগ্রাধিকার পেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিরা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, একই পরিবেশে জন্মে পার্বত্য বাঙালিরা পিছিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে সর্বদিক থেকে পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠী হচ্ছে পাহাড়ের বাঙালিরা। সরকার কিংবা রাষ্ট্র উপজাতিদের প্রতি সহানুভূতিশীল, তাতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই। আমি বলব না যে, উপজাতিদের সুবিধা থেকে কেটে পার্বত্য বাঙালিদের সুবিধা দিতে হবে। বরং আমার কথা হলো, সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে মেধারভিত্তিতে বাঙালিদের তাদের প্রাপ্য সুযোগটুকু দিতে অসুবিধা কোথায়? বাস্তব ক্ষেত্রে একই অবস্থানে থেকে একই পরিবেশের একটি পক্ষকে উন্নত করে আরেকটি পক্ষকে দমিয়ে রাখা অত্যন্ত দুঃখজনক।

পাহাড়ের জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃস্থানীয় সকল পদ উপজাতিদের দখলে, সরকারি চাকরির উপজাতিদের দখলে, দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুযোগ-সুবিধা উপজাতিদের দখলে, দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থাদের সাহায্য সহযোগিতা উপজাতিদের জন্য। তাই এ প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক, পার্বত্য বাঙালিরা কি রাষ্ট্রের নাগরিক নয়?

পার্বত্য বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের মানচিত্রের পাহারাদার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেও পাহাড়ে বাঙালিদের অস্তিত্ব ছিল। পার্বত্য বাঙালি থেকে রাজাকার, যুদ্ধপরাধী একজনও নাই। যেমনটা আছে উপজাতিদের ক্ষেত্রে। তারপরও কোন দিক বিবেচনায় পার্বত্য বাঙালিদের সর্ব দিক হতে পিছিয়ে রাখা হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর আমার মতো নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা।

সর্বশেষ কথা হলো, এই বৈষম্যের শেষ কোথায়? পাহাড়ের বাঙালিরাও তো মানুষ, তাদেরও তো আত্মবিকাশের অধিকার রয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশে পার্বত্য বাঙালিদের সাম্প্রদায়িক তকমা দিয়ে আর কতকাল পিছিয়ে রাখা হবে?

লেখক: আবু উবায়দা, ব্লগার, রাঙামাটি থেকে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন