ইটভাটায় পাচারে জড়িত একাধিক চক্র

পাহাড়ের অপরিপক্ক গাছ উজার, প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকির আশঙ্কা

fec-image

প্রাকৃতিক সবুজ বন-বনানিতে ঘেরা খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা। আর এই অঞ্চলের দক্ষিণে সীমান্তবর্তী ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী উপজেলার ইটভাটায় গাছের চাহিদা বেশি। কমমূল্যে গাছ সংগ্রহের অবারিত সুযোগ থাকায় ধুমধামে কাঠ পোড়ানো হয় স্থানীয় ও সমতলের ব্রিকফিল্ডে! যদিও এখনো কোথাও ইটভাটায় আগুন দেওয়া হয়নি। তারপরও অনেক আগে-বাগে ইটভাটায় গাছ জমায়েত করছে ভাটার মালিকেরা। এরই আলোকে গত ১৫ দিন ধরে মানিকছড়ি ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার ব্যক্তিমালিকানা টিলা ভূমিতে সৃজিত ও প্রাকৃতিক অপরিপক্ক গাছ কাটার ধুম পড়েছে! সন্ধ্যার পর পর ফাঁড়ি সড়ক দিয়ে অনায়সে চাঁন্দের গাড়ি বা জিপগাড়িযোগে সমতলে পাচার হচ্ছে কচিকাঁচা গাছভর্তি গাড়ির বহর।

বনবিভাগ ও সরজমিনে দেখা গেছে, সমতল থেকে খাগড়াছড়ি জেলার প্রবেশদ্বার মানিকছড়ি ও লক্ষ্মীছড়ি চিরসবুজে ঘেরা জনপদ। এখানাকার মোট ভূমির তিনের দুই অংশের অধিক টিলা। তবে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় ১৫০ থেকে ২০০ একর রিজার্ভ বা সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকলেও মানিকছড়িতে রিজার্ভ বন নেই। এলাকার কৃষিজীবী মানুষ টিলা ভূমির বাগানে ফলজ গাছ সৃজনের পাশাপাশি ঢালু বা ব্যবহার অনুপযোগী জায়গায় প্রাকৃতিক গাছ-গাছালির ফাঁকে ফাঁকে আকাঁশি গাছের চারাসহ দ্রুত সময়ে বেড়ে উঠা গাছের চারা রোপণ করেন। কিন্তু এসব গাছ পরিপক্ব হওয়ার আগেই গাছে দা, কুঁড়াল লাগাতে কেউ দ্বিধাবোধ করে না! দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত গাছ নিধনের ফলে করাতে কাঁটার মতো গাছ পাওয়া এখন দুঃস্কর!

দুই উপজেলার প্রধান সড়ক ছাড়াও সমতলে যাতায়াতের অসংখ্য ফাঁড়ি সড়ক থাকায় বনখেকোরা চাঁন্দের গাড়ি বা জিপগাড়িতে দেদারসে সমতলে গাছ পাচারে শীত মৌসুমে সক্রিয় থাকেন। গত ১৭ অক্টোবর সোমবার উপজেলার ডাইনছড়ি, একসত্যাপাড়া, পাঞ্জারাম পাড়া, এয়াতলংপাড়া, জামতলা, ধর্মঘর, চইক্যাবিল, রাঙ্গাপানি, দেবাতলী ও মানিকছড়ি-লক্ষ্মীছড়ি সীমাবর্তী মগাইছড়ি, দুল্যাতলী ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার অপরিপক্ক গাছ চাঁন্দের গাড়িযোগে মানিকছড়ির ফাঁড়ি সড়ক হয়ে ফটিকছড়ির বিভিন্ন ইটভাটামুখী অবাধে যাতায়াত করছে। অন্তত একদিনেই অপরিপক্ক গাছ ভর্তি ৩০ থেকে ৩৫টি গাড়ি প্রত্যক্ষ করা গেছে। এসব গাছ কাটাচ্ছে মূলত জায়গার মালিকেরা।

চইক্কাবিলের সফিকুল ইসলাম নিজ পাহাড়ের ছোট ছোট (অপরিপক্ক) গাছ কাটা প্রসঙ্গে বলেন, সংসারে অভাব-অনটন ও বিপদাপদে গাছ বিক্রির বিকল্প কী বা আছে? কচিগাছের মণ ৫০-৫৫ টাকায় কিনে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। ইটভাটায় পৌঁছলে ৭০-৭৫ টাকা মণে বিক্রি করছে তারা। এভাবে অনায়াসে পাচারে সক্রিয় রয়েছে গাছ ব্যবসায়ে অভিজ্ঞ একটি চক্র! তারা মূলত বনবিভাগের চক্ষু আড়াঁল করে উপজেলাগুলোর ফাঁড়ি সড়কে সমতলের ইটভাটায় এসব গাছ পৌঁছে দিচ্ছে অনায়াসে।
এভাবে পাহাড়ের অপরিপক্ক গাছ নিধন হতে থাকলে বনাঞ্চল ধ্বংসসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বৃক্ষ ও পরিবেশপ্রেমীরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লক্ষ্মীছড়ি বন কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন জানান, এই উপজেলায় ১৫০ থেকে ২০০ একর সংরক্ষিত বন রয়েছে।
বনবিভাগ ও সেনা জোনের সামনে থাকায় এ সম্পদ বিনষ্ট বা বেহাতের সুযোগ নেই। এছাড়া দুর্গম এই এলাকায় ব্যক্তি পর্যায়ের বনাঞ্চল নজরে রাখার সুযোগ আমাদের নেই। তথাপিও সেনাবাহিনীর নজরদারি থাকায় অবাধে গাছ পাচারের সুযোগও কম।

খাগড়াছড়ি বনবিভাগের গাড়িটানা বিটের বন কর্মকর্তা উহ্লামং চৌধুরী বলেন, এ অঞ্চলে মানুষের নিজস্ব ভূমিতে সৃজিত বা প্রাকৃতিক বন সম্পদের অপরিপক্ক গাছ অসময়ে নিধন প্রসঙ্গে বলেন, মানিকছড়ি উপজেলায় বন বিভাগের রিজার্ভ কোন বন নেই। এছাড়া ভূপ্রকৃতি কারণে এখানে ফাঁড়ি সড়ক বেশি হওয়ায় মৌসুমী গাছ ব্যবসায়ীরা বনবিভাগের সামনে দিয়ে গাছ পাচার করে না। ফাঁড়ি সড়কে তাদের অবাধ বিচরণ! বনবিভাগের জনবল কম থাকায় আমরা ফাঁড়ি সড়কে নজরদারী করতে পারি না। ফলে গাছের মালিক বা ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভিন্নপথে গাছ বাঁশ নিলেও বনবিভাগের নজরে কখনও পড়েনি। তারপরও আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্য বা অভিযোগ পেলে বন সম্পদ রক্ষায় অর্পিত দায়িত্ব পালনে এক বিন্দু পিছপা হবো না।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: গাছ, পরিবেশ, পাহাড়
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন