পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থিত প্রার্থীদের সংসদ যাত্রা?

মুজিবুর রহমান ভুইয়া :

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে পুঁজি করে স্বাধীকার আন্দোলন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণের খলনায়কেরা অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সংসদে বসার স্বপ্ন দেখছে। বিএনপি নেতৃত্বধীন ১৮ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করার প্রেক্ষাপটে তাদের এ স্বপ্ন এখন অনেকের কাছেই অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে না। আর এর মধ্য দিয়ে পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙ্গালীদের ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের ঘনঘটাও কাছকাছি আসছে বলে মনে করছেন পাহাড়ের সচেতন মানুষ। একই সাথে তা পার্বত্যচট্টগ্রামের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা প্রশ্নেও বড় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন।

তাদের মতে, পাহাড়ের তিনটি সংসদীয় আসনে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সমর্থিত প্রতিনিধি নিশ্চিত করতে পারলে একদিকে যেমন জাতীয় সংসদে স্বাধীকারের দাবী তুলে ধরার সুযোগ তৈরী হবে, তেমনি তাদের দাবীগুলোকে আইনে পরিনত করা সহজতর হবে।  অন্যদিকে সংসদ সদস্যের প্রভাব কাজে লাগিয়ে এলাকায় নিজ দলের জন্য নানা সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তখন অভিভাবকহীন হয়ে পড়বে পাহাড়ে বাসবাসকারী ৮ লাখেরও বেশী বাঙ্গালী জনগোষ্ঠি।

পাহাড়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত সহযোদ্ধারা এখন পরস্পর পরস্পরের প্রচন্ড বিরোধী। এক পক্ষের বিরুদ্ধে অন্য পক্ষের বক্তব্যও অগ্নিঝড়া। আলাদা আলাদা বক্তব্য নিয়ে এখন গনতান্ত্রিক মাঠের রাজনীতিতে চষে বেড়াচ্ছেন।  তবে সন্ত্রাস সৃষ্টিও চলছে সমানন্তরালে। পাহাড়ের তিন সংসদীয় আসনে প্রথমবারের মতো সরাসরি নিজেদের ‘জনপ্রিয়তা যাচাই’ এর লক্ষ্যে নির্বাচনী মাঠে নেমেছে তিন আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন চুক্তি বিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং সুধাসিন্ধু খীসার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা)।

সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জন সংহতি সমিতি ও প্রসীত বিকাশ খীসা‘র নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ এর আগে নির্বাচনে অংশ নিলেও এবারই প্রথম সরাসরি নির্বাচনী লড়াইয়ে নামলো অপর সংগঠন সুধাসিন্ধু খীসার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা)। এর আগে নির্বাচনী মাঠে নামলেও নিজেদের মুখোমুখি হতে হয়নি সন্তু লারমা জেএসএস ও প্রসীত খীসা‘র ইউপিডিএফকে। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইউপিডিএফ প্রধান প্রসীত বিকাশ খীসা রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচন করলেও সেবার নির্বাচন বর্জন করে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি। অন্যদিকে ২০০৮ সালে রাঙ্গামাটি সংসদীয় আসনে জনসংহতি সমিতি নির্বাচনে অংশ নিলেও সেসময় ‘না’ ভোটের পক্ষে প্রচারণা চালায় ইউপিডিএফ। ফলে দীর্ঘদিন পর এবার প্রথমবারের মতো সরাসরি নির্বাচনী লড়াইয়ে মুখোমুখি হচ্ছে প্রভাবশালী আঞ্চলিক দুই রাজনৈতিক শক্তি। রাঙ্গামাটি সংসদীয় আসনে জন সংহতি সমিতির পক্ষে প্রার্থী হয়েছেন সংগঠনের সহ-সভাপতি উষাতন তালুকদার, ইউপিডিএফ‘র সচিব চাকমা, জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) কেন্দ্রীয় সভাপতি সুধাসিন্ধু খীসা।

অপরদিকে খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ‘র দলীয় প্রধান প্রসীত বিকাশ খীসা, জন সংহতি সমিতির (এমএনলারমা) প্রকৌশলী মৃণাল কান্তি ত্রিপুরা নির্বাচনী যুদ্ধে থাকলেও প্রার্থী নেই সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জন সংহতি সমিতির। আর বান্দরবানে ইউপিডিএফ‘র ছোটন কান্তি তংচঙ্গ্যা নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়ালেও সেখানে প্রার্থী নেই অপর দুই অংশের।তবে সেখানে আওয়ামীলীগ থেকে বহিস্কৃত প্রসুন তঞ্চঙ্গাকে জেএসএস সক্রিয় সমর্থন দিচ্ছে বলে জানা গেছে। প্রসুন তঞ্চঙ্গা জেএসএস এর সামরিক শাখার সাবেক মেজর বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশের এককেন্দ্রীক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার সুযোগ নেই। বরং তা সম্পূর্ণ অবৈধ। তবু পাহাড়ের অনিবন্ধিত এসব আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নির্বাচনী লড়াইয়ে ভিন্নমাত্রা যোগ হচ্ছে এবারের সংসদ নির্বাচনে। তারা কোন না কোন রাজনৈতিক পরিচয় বহন করলেও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচনে লড়তে হচ্ছে ‘স্বতন্ত্র’ পরিচয়েই। নির্বাচন কমিশন আঞ্চলিক এসব সংগঠনকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধিত না করায় তাদেরকে দলীয় পরিচয় বাদ দিয়ে নির্বাচনী মাঠে থাকলেও লড়াইটা হবে ‘দলীয়’ পরিচয়েই। ইউপিডিএফ‘র প্রচার ও প্রকাশনা সেলের প্রধান নিরন চাকমা তাদের প্রার্থীর জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমরা জয়ের জন্যই মাঠে নেমেছি। তিনি বলেন, বরাবরই কিছু পাহাড়ী নামধারী ব্যক্তি বিজয়ী হয়ে সংসদে যায় কিন্তু তারা পাহাড়ীদের অধিকার আদায়ে কোন ভূমিকা না রেখে বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মীর ভূমিকা রাখেন। তাই আমরা মনে করি পাহাড়ীদের অধিকার আদায়ে আমাদের সংসদে যেতে হবে, সেই জন্যই আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি।

বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) কেন্দ্রীয় নেতা রূপায়ন দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্যই আমরা মনে করেছি সংসদে যাওয়া দরকার। সংসদে এবং সংসদের বাইরে চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ করা গেলে চুক্তি বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে বলেও মনে করেন তিনি। পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা যে যাই বলুক শেষ পর্যন্ত যদি তারা নির্বাচনের মাঠে থাকেন তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায় আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থীদের সাথেই মূল লড়াই হবে আঞ্চলিক দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। সেক্ষেত্রে আওয়ামীলীগের একাধিকবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য রাঙ্গামাটির দীপঙ্কর তালুকদার ও বান্দরবানের বীর বাহাদুর উশৈ শিং যেমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন তেমনি খাগড়াছড়িতে নবাগত কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা‘র নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া খুব একটা সুখকর হবেনা বলে মনে করছে পাহাড়ের রাজনীতি সচেতন মহল।

কেন্দ্রীয়ভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাটা ও নেতিবাচক ভাবমর্যাদা, দলের মধ্যে কোন্দল, আওয়ামীলীগ প্রার্থীদের দুর্নীতি, বঞ্চিত, অবহেলিত নেতাকর্মীদের ক্ষোভ, দুর্গম এলাকার ভোটারদের হুমকির মুখে ভোট আদায় এবং  প্রধান বিরোধী জোটের অনুপস্থিতির কারণে এবার তিন পার্বত্য জেলার আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর জয়লাভের প্রবল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন তিন পার্বত্য জেলার সচেতন জনগণ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন