পেকুয়ায় ক্রস বাঁধ নির্মাণে ব্যয় ৩০ লাখ টাকার স্থলে বরাদ্দ ১ কোটি!

fec-image

কক্সবাজারের পেকুয়ার টইটং ইউনিয়নের একটি খালে চলতি বছরের শুরু দিকে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদের সুবিধার্থে একটি মাটির ক্রস বাঁধ নির্মাণে ৩০ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হলেও প্রকল্পটিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় কোটি টাকা!

গত জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া ও টইটং ইউনিয়নের অনাবাদি জমি চাষাবাদের আওতায় আনার জন্য ওই ইউনিয়নের টইটং-সোনাইছড়ি খালে একটি অস্থায়ী মাটির ক্রস বাঁধ তৈরি করেন পেকুয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়। মাটির ক্রস বাঁধ তৈরি করার সময় কোন বরাদ্দ না থাকলেও পেকুয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে বাঁধটি তৈরি করা হয়েছিল।

চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব জাফর আলম, পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার পূর্বিতা চাকমা, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আবু তাহের, টইটং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারাণ সম্পাদক জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী ও বারবাকিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মাওলানা বদিউল আলম জিহাদীকে সঙ্গে নিয়ে ক্রস বাঁধটির নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন।

উদ্বোধন শেষে সংসদ সদস্য জাফর আলম স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অধিক চাষাবাদ ও ফলনের লক্ষ্যে বিকল্প হিসেবে চাষাবাদের সুবিধার্থে টইটং-সোনাইছড়ি খালে অস্থায়ী মাটির ক্রস বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ব্যয় হবে আনুমানিক ৩০ লাখ টাকা। উদ্বোধনের দুইদিনের মধ্যেই টইটং খালের বারবাকিয়া নতুন পাড়া ও টইটং ইউনিয়নের নাপিতখালী পয়েন্টে মাটির ক্রস বাঁধটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। তবে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বোরো আবাদ শেষ হওয়ায় অস্থায়ী বাঁধটি কেটে দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, টইটং-সোনাইছড়ি খাল একটি প্রবাহমান খাল। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) টইটং-সোনাইছড়ি খালের ওপর একটি মিনি রাবার ড্যাম নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে দরপত্রের আহ্বান করে। কিন্তু এলসি খুলে রাবার ব্যাগ আনতে হবে সুদূর চায়না থেকে। সেজন্য ড্যাম নির্মাণের কাজ স্থবির হয়ে পড়ায় টইটং-সোনাইছড়ি খালে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শুরু দিকে বোরো মৌসুমে অস্থায়ী মাটির ক্রস বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। যাতে শুষ্ক মৌসুমে খালের মিঠা পানি আটকিয়ে টইটং ও বারবাকিয়া ইউনিনের বিপুল পরিমাণ চাষাবাদের জমিতে রবিশস্যের চাষাবাদ নির্বিঘ্নে করা যায়।

পেকুয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জানুয়ারি মাসে স্থানীয় কৃষকদের জমি চাষাবাদের সুবিধার্থে টইটং-সোনাইছড়ি খালে অস্থায়ী ভিত্তিতে বাঁধটি তৈরি করা হয়েছিল। তখন বাঁধটি নির্মাণের জন্য বরাদ্দ ছিলনা। এরপরে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব জাফর আলম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সুপারিশের ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প দেখিয়ে ২০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ নিয়ে আসে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে। গত মে মাসে বরাদ্দ আসার পর টইটং ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও একই ইউনিনের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হাজী শাহাব উদ্দিনকে প্রকল্প সভাপতি করে পেকুয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে একটি প্রকল্প কমিটি জমা দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত সপ্তাহে প্রকল্প কমিটির সভাপতি হাজী শাহাব উদ্দিন পেকুয়া পিআইও অফিস থেকে ১০০ মেট্রিক টন চালের বরাদ্দের ছাড়পত্র নিয়ে চকরিয়া খাদ্য গুদাম থেকে উত্তোলন করে বাইরে বিক্রি করে দেন। বর্তমান প্রতি টন গমের সরকারি বাজার মূল্য প্রায় ৫০ হাজার টাকা। সে হিসেবে ১০০ মে. টন চালের মূল্য প্রায় ৫০ লক্ষাধিক টাকা। বরাদ্দের আরও ১০০ মেট্রিক টন চাল চলতি জুন মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে পিআইও অফিস থেকে বরাদ্দের ছাড়পত্র নিয়ে উত্তোলনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রকল্প কমিটির সভাপতি!

বাঁধটির নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করার সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য ৩০ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হবে বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাঁধ নির্মাণে ২০০ মেট্রিক টন চাল যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদানের বিষয়টি কোনোভাবেই মানতে পারছেনা স্থানীয় এলাকাবাসী।

বারবাকিয়া ইউনিয়নের কৃষক রাসেল অভিযোগ করে জানান, টইটং-সোনাইছড়ি খালে অস্থায়ী মাটির ক্রস বাঁধ নির্মাণে সর্বোচ্চ ব্যয় হবে ১০-১৫ লাখ টাকার মতো। কিন্তু সেখানে ২০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া ব্যাপরাটি চরম ‘রহস্যঘেরা’। সংশ্লিষ্টরা বরাদ্দ লুট করতেই প্রকল্পে বেশি বরাদ্দ দেখিয়ে এই কান্ড ঘটিয়েছেন বলে দাবি করেছেন ওই কৃষক।

এ বিষয়ে প্রকল্প কমিটির সভাপতি ও পেকুয়া উপজেলার টইটং ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হাজী শাহাব উদ্দিন বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য তাকে ওই প্রকল্প কমিটির সভাপতি বানিয়েছেন। গত সপ্তাহে বরাদ্দের ১০০ মেট্রিক টন চাল উত্তোলন করেছি। বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করে বলেন, আমি গত দুইদিন ধরে অসুস্থ। এ বিষয়ে আর কথা বলতে পারবনা।

পেকুয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. আবু তাহের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে উপজেলার টইটং-সোনাইছড়ি খালে তার কার্যালয়ের অধীনে একটি অস্থায়ী মাটির ক্রস বাঁধ তৈরি করা হয়েছিল। তখন বরাদ্দ ছিলনা। পরে সংসদ সদস্য ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সুপারিশের ভিত্তিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে ২০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ইতোমধ্যেই বরাদ্দের অর্ধেক তুলে নেওয়া হয়েছে। সামান্য মাটির বাঁধ তৈরিকে ২০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ কেন দেওয়া হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমপি সাহেব ঢাকায় গিয়ে তদবির করে বরাদ্দ নিয়ে এসেছেন। তবে প্রকল্পে যদি অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে তিনি অবশ্যই তদন্ত করে দেখবেন।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পেকুয়ার টইটং খালে মাটির ক্রস বাঁধের জন্য বরাদ্দ অতিরিক্ত হয়ে গেলে তিনি অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন