প্রতিপক্ষ নির্ধারণ করে তরুণদের লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে: সন্তু লারমা

fec-image

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিপক্ষ নির্ধারণ করে আবারও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার তরুণদের তরুণদের লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে বলে মনে করছেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) রাজধানীতে এক সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি সন্তু লারমা বলেন, অনেক লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এ চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর হয়ে গেলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৪ বছর ধরে চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থেমে গেছে। চুক্তি বাস্তবায়নে আবারও বড় লড়াই করতে হবে। সেটাও (লড়াই) হবে না যদি নীতি ও আদর্শ নিয়ে যুবসমাজ এগিয়ে না আসে।

৯ আগস্ট বুধবার ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২৩’ উপলক্ষে মঙ্গলবার এই জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করে অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামসহ ২৩টি সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২৩ উদ্‌যাপন জাতীয় কমিটি।

‘আদিবাসীদের ভূমি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় যুবশক্তির ভূমিকা ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব’ শিরোনামের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সিরডাপের টিএম শামসুল হক মিলনায়তনে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আদিবাসী তরুণেরাই মূল শক্তি’।

সেমিনারের শুরুতে পৃথক দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উন্নয়নকর্মী ফাল্গুনী ত্রিপুরা এবং লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ ।

প্রধান অতিথি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, আমি তরুণদের দ্বারাই উজ্জীবিত। এই সংকট মুহূর্তে ‌’আদিবাসী’ তরুণদের করণীয় বলতে গিয়ে সমাজব্যবস্থা শ্রেণী বিভক্ত ও বৈষম্যযুক্ত বলে জানান। আমাদের প্রতিপক্ষকে জানতে হবে। আবেগে কোন কাজ করা যাবে না। প্রতিপক্ষ নির্ধারণ করে লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের স্বজাতির মধ্যে বিভক্তি কাটিয়ে নীতি আদর্শ মেনে লড়াই করলে অধিকার পাওয়া যাবে। সরকার ১৩টি জাতিগোষ্ঠির অধিকার আদায়ের বিষয় লিখে বাস্তবায়ন করেনি, সরকার এখন অস্বীকার করে।আমাদের তরুণদের নের্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং স্বার্থ নির্ধারণ করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, বল প্রয়োগ ছাড়া কিছু হয় না।

তিনি বলেন, বিলুপ্ত হতে না চাইলে নীতি আদর্শ মেনে প্রতিপক্ষ চিনতে হবে। আর তা না হলে আন্দোলনে বিভ্রান্তি তৈরি হবে ।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ‘আদিবাসী’দের নিয়ে বৈষম্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এই সরকার লুটের মহোৎসব করছে।কিসের জন্য এই দেশ স্বাধীন করেছি, আর পেলাম বৈষম্যবাদী আর লুটের রাজ্য।পুরো দেশে চলছে অস্থিরতা। তাই তরুণদের সৃজনশীল পথে পরিচালিত হয়ে পরিবর্তন করতে হবে। অন্যকে নিরাপদ রাখলে নিজে নিরাপদ থাকা যায়। ‘আদিবাসী’ ও বাঙালি একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি বলেন , সরকার অর্থ দিয়ে বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে । সময় এসেছে অন্যায় ঝেড়ে ফেলার। তবে এক্যবদ্ধ হওয়া অতিব জরুরি তা না হলে দেশটা পরিত্যক্ত হবে। এই দৈত্য দানব বান্ধব সরকারকে সবাই সচেতনভাবে দায়িত্ব নিয়ে অধিকারের কথা জানান দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির বলেন, ‘আদিবাসী’দের নিয়ে যে সার্কুলার জারি করা হয়েছে, তা মেনে নেওয়া যাবে না। তাদের জয় অবশ্যই হবে। তাদের সমঅধিকার দিতে হবে। অন্যদিকে সরকার দ্বারা প্ররোচিত হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের কথা বলে তিনি তরুণদের এইসব অন্যায় রুখে দেয়ার আহ্বান জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব কর্তব্য হচ্ছে সকল নাগরিককে ধারণ করা। সরকারের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০৩০ সাল। এই অবস্থায় ‘আদিবাসী’দের অধিকার আদায় না করে সরকার কোনভাবেই তা পূরণে সফল হবে না। আত্মনিয়ন্ত্রণ মানে স্বাধীনতা ঘোষণা নয়। এ বিষয়টি সরকার বুঝতে চায় না। তারা মনে করে আত্মনিয়ন্ত্রণ মানে বিচ্ছিন্নতাবাদ। আমরা বলব, এর সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদের কোনো সম্পর্ক নেই । এটা হচ্ছে এ রাষ্ট্রের সমনাগরিকত্বের অধিকার ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে জমি দখলের কারণে বহু ‘আদিবাসী’ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। এই জন্য তারা উন্নয়নকে ভয় পায়। লাকি নামে ১৩ বছরের একটা চাকমা মেয়েকে জোরপূর্বক বিয়ে করে এক মুসলিম বাঙালি যুবক। তাকে বাধ্য করে মুসলিমে ধর্মান্তরিত করা হয়। পরবর্তীতে জানা যায় ওই মেয়েকে হত্যা করে কক্সবাজার হাসপাতালে রেখে চলে যায়। এইসব ঘটনা দিয়ে বুঝা যায় রাষ্ট্র কী পরিমাণ নিপীড়ন চালাচ্ছে তাদের উপর ।

তিনি আরও বলেন, সরকার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিস্থাপন করে মূলত বর্ণ বৈষম্য করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাড়াচ্ছে। তাই আমি বলব, ‘আদিবাসী’ তরুণদের অধিকার ধাবায়ে রাখা যাবে না। এক সময় সরকার বাধ্য হবে এদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আমাদের দেশে প্রচুর বেকার রয়েছে, সেখানে ‘আদিবাসী’দের কথা না বললেই নয়। আমরা একটা নিষ্ঠুর দেশে বাস করছি । আমি কিছু দিন আগে ব্যাংকক গিয়েছিলাম, সেখানে দেখেছি প্রবাসীরা কত কষ্টে আছে। এই সরকার কারো অধিকার রক্ষা করতে পারছে না। এই সরকার যদি একটা সাওতাল, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ, সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করতো তাহলে বুঝা যেতো দেশের মানুষ শান্তিতে আছে। কিন্তু তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।অথচ, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে কিস্তু সরকার কিছু বলছে না। সরকার আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা শুনলে ভয় পায়। ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ নেই। ‘আদিবাসী’দের অধিকার সংবিধানে যথাযথভাবে স্থাপন করার জন্য বিশেষ লড়াই সংগ্রাম করে যেতে হবে। বাংলাদেশ বহুজাতিক রাষ্ট্র। ৫০টি জাতিগোষ্ঠির জনগণ সংবিধানে যুক্ত হতে চায় এবং এক সাথে পথ চলতে চায়।

আদিবাসী ফোরামের নেত্রী সারা মারান্ডি তার বক্তব্যে বলেন , ব্রিটিশ আমলে আমরা আমাদের প্রতিপক্ষ চিনেছি। কিন্তু এই বাংলাদেশে আমরা কোন দিক দিয়ে আত্রুমণের শিকার হই আমরা জানি না । প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে শুধু বাকি সব আগের মত চলছে। আমরা চরম আত্মপরিচয় সংকটে ভুগতেছি। যেখানে কোন অধিকার আমরা সঠিকভাবে পাচ্ছি না। এই রাষ্ট্র আমার জন্য কি চিন্তা করছে! অনেকটা সুকান্তের ঝলসানো রুটির মত।আমাদের সংবিধানে আর দলিল দস্তাবেজে দারুণ সব মন ভুলানো কথা আছে, বাস্তবে আমরা কিছুই পাচ্ছি না।

সম্মেলনে অন্যন্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন, ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এসএম রেজাউল করিম, আদিবাসী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রিয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক তরুন মুন্ডা, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক টনি চিরান প্রমুখ।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: তরুণ, প্রতিপক্ষ, লড়াই
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন