ফিরে দেখা ২০১৪: খাগড়াছড়িতে পাহাড়ী বাঙ্গালী সংঘর্ষে অপহৃত শহীদুলের খোঁজ মেলেনি এখনও

শহীদুল

এম সাইফুর রহমান:

শিশু শহীদুলের খোঁজ আজো মেলেনি

২৫ ফেব্রুয়ারী পাহাড়ী-বাঙ্গালী সংঘর্ষের জের ধরে উপজাতীয় দুস্কৃতিকারী কর্তৃক অপহৃত হয় কিশোর শহীদুল ইসলাম (১৩)। গৃহপালিত ছাগল আনতে গেলে কমলছড়ি-ভুয়াছড়ির পাহাড়ী এলাকা থেকে উপজাতীয় দুস্কৃতিকারীরা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। দীর্ঘ প্রায় ১০মাস পার হলেও এখনও তার সন্ধান মিলেনি।

নিষ্পাপ এ ছেলেটির বাঙ্গালী হওয়াই কি তার অপরাধ ছিল? কবে মিলবে তার সন্ধান। এসব কথা বলছিলো স্থানীয়রা। নিখোঁজ শহীদুলের সন্ধান নিয়ে তার মা ফরিদা বেগম অভিযোগ করেন, উপজাতীয় কোন ব্যক্তির কিছু ঘটতে না ঘটতেই প্রশাসন যে ভাবে তৎপর হয়ে উঠে শহীদের জন্য তেমন কারো মাথা ব্যথা নেই।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নিখোঁজ শহীদুলকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খুঁজে বের করা যাবে এমন প্রতিশ্রুতিতে সবাই নীরব ছিল। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ছেলেটিকে খুঁজে বের করে দেওয়া হবে বলেও দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তবে কেন এখনও সে নিখোঁজ? অপহরণকারীদের নাম শনাক্ত হলেও কেন তাকে উদ্ধার সম্ভব হচ্ছে না- এটাই এখন সবার প্রশ্ন।

এদিকে শহীদুলের পিতা খাগড়াছড়ি সদর থানায় মামলা করতে বার বার ধরণা দিয়ে আসলেও অজ্ঞাত কারণে অপহরণের ১৪দিন পর মামলা গ্রহণ করে পুলিশ। অপহৃত কিশোরকে উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর ‘চিরুণী অভিযান’ পরিচালনা করলেও আসেনি কোন ফল।

সালতামামি

মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার হয় সেতু উন্নয়ন প্রকল্পের অপহৃত ৪ বাঙ্গালী শ্রমিক

গত ৬ জুলাই রাতে খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সড়কের মাটিরাঙা উপজেলার ব্যাঙমারা এলাকায় নির্মাণাধীন সেতু উন্নয়ন প্রকল্পের একটি ব্রিজের সাইট থেকে একজন বুলড্রোজার চালকসহ ৪ শ্রমিককে অপহরণ করে নিয়ে যায় দুর্বত্তরা। ওই চার শ্রমিক হলেন-ময়মনসিংহের রাজু, ফেনীর হাসান ও ফারুক এবং চট্টগ্রামের লিয়াকত। এসময় তাদেরকে মোটা অংকের চাঁদার দাবীতে অপহরণ করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠে পাহাড়। পাহাড়ের বাঙ্গালী সংগঠনগুলো মিছিল, সমাবেশ ও হরতাল কর্মসূচী পালন করেছে অপহৃতদের মুক্তির দাবীতে।

অপহৃত মো. রাজু মিয়ার বাবা মো. হাবিব মিয়া বাদী হয়ে ১০/১২ জন অজ্ঞাত পরিচয় পাহাড়ি সন্ত্রাসীকে আসামি করে মাটিরঙ্গায় থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। অপহৃতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও পুলিশ অভিযান চালানো হয়। পরবর্তীতের মোটা অংকরে মুক্তিপণ দিয়ে অপহৃত চার শ্রমিকে উদ্ধার করা হয়।

বাবুছড়া বিজিবি ক্যাম্প


বিজিবি ক্যাম্প নিয়ে দীঘিনালা উপজেলায় ১৪৪ ধারা

চলতি বছরের ২২মে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়ায় ৫১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আনুষ্ঠানিক ভাবে পালন করা হয়। এরপর থেকে জায়গা-জমি নিয়ে বিজিবির সঙ্গে স্থানীয় পাহাড়িদের বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নেয়। ১০ জুন সন্ধ্যায় কয়েকশ’ সংঘবদ্ধ পাহাড়ি নারী-পুরুষ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে নির্মাণাধীন বাবুছড়া ৫১ বিজিবি সদর দপ্তরে হামলা চালায়। এতে ছয় বিজিবি ও এক পুলিশ সদস্যসহ ১৫ জন আহত হন। এ হামলায় বিজিবির দুটি রাইফেলসহ বেশকিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুলিশ পাঁচ রাউন্ড শর্টগানের গুলি ও পাঁচ রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এই ঘটনায় বিজিবি’র দায়ের করা মামলায় বেশ কয়েকজন কারাগারে আটক রয়েছে।

এঘটনাকে কেন্দ্র করে দীঘিনালা উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলার বাবুছড়ায় বিজিবি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন’কে কেন্দ্র করে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সমর্থিত কয়েকটি পাহাড়ি সংগঠনের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের আশঙ্কায় এই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।

এদিকে ঘটনার পর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আর্ন্তজাতিক কমিশন (সিএইচটি কমিশন)’-এর একটি প্রতিনিধি দল বিজিবি ব্যাটালিয়নের প্রস্তাবিত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে। প্রতিনিধি দলটিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এড. সুলতানা কামাল, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক ড. স্বপন আদনান, মানবাধিকার নেত্রী খুশী কবির এবং টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ছিলেন।

বিজিবি সদস্য নিহত


অনুশীলনকালে গ্রেনেড বিষ্ফোরণে রামগড় ১৬ বিজিবির দুই সদস্য নিহত, ৪ জন আহত

১৬ নভেম্বর খাগড়াছড়ি সেনানিবাসে বিজিবি’র বার্ষিক প্রশিক্ষণ অনুশীলনকালে গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়ে বিজিবির দুই সদস্য নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছেন। প্রশিক্ষণ চলাকালে অসাবধানতা বশত একটি গ্রেণেডের পিন খুলার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই বিজিবির নায়েক সুবেদার আবুল কাশেম (৫৫) নিহত হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় অপর বিজিবি সদস্য হাসান (৪০) মারা যায়। নিহত নায়েক সুবেদার আবুল কাশেমের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কিলোরী গ্রামে এবং সিপাহী হাসানের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর মাছপুকুর এলাকায়।

আহতরা হলেন, ৪০ বিজিবি’র মেডিকেল অফিসার ক্যাপ্টেন তাইফুল ইসলাম, রামগড় ১৬ বিজিবির নায়েক সুবেদার মাসুদ রানা, ল্যান্স নায়েক নাসেরুল ইসলাম ও সিরাজুল ইসলাম। আহতদের দ্রুত হেলিক্যাপ্টার যোগে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।

খাগড়াছড়ির তিন উপজেলায় একইদিন, একই সময়ে একই কায়দায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে ১স্কুল শিক্ষক নিহত, ২ জেএসএস সদস্যসহ আহত ৪ প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে পাহাড়।

একই দিন, একই সময়ে, একই কায়দায় খাগড়াছড়ি তিন উপজেলায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে ১জন নিহত ও ৪জন আহত হয়েছে। জেলার মানিকছড়িতে সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে নিহত হয় চিংসামং চৌধুরী (৪২) নামের স্কুল শিক্ষক। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে মংসাজাই মারমা ওরফে জাপান নামের মানিকছড়ি উপজেলা জেএসএস সভাপতি। মানিকছড়ি বাজার সংলগ্ন রাজপাড়ায় ঘটনাটি ঘটে। নির্মম এ হত্যার প্রতিবাদে রবিবার সকাল থেকে দিনব্যাপী মানিকছড়ি উপজেলা সদরের সকল দোকান-পাঠ, স্কুল-কলেজ অঘোষিত বন্ধ রেখে রাস্তায় নেমে এসে সড়ক অবরোধ করে হরতাল পালন করেছে স্কুলের ছাত্র/ছাত্রী ও স্থানীয়রা।

অপরদিকে একই সময়ে জেলার পানছড়ি উপজেলার মগপাড়া (হলধর পাড়া) এলাকায় অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের গুলিতে রমজান আলী (৫৫), ও তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৪০) গুরুতর আহত হয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতালে প্রেরণ করে।

এছাড়াও একই সময়ে জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছেন চুক্তি স্বাক্ষরকারী সন্তু লারমা সমর্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতা আশুতোষ ত্রিপুরা (২৬)। মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদরের অদুরে ধলিয়া ব্রিজের কাছে এ ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ আশুতোষ ত্রিপুরা মাটিরাঙ্গা উপজেলার তপ্তমাষ্টার পাড়ার অন্নশশী ত্রিপুরার ছেলে। সাংগঠনিক কাজে তিনি দীর্ঘদিন ধরে মাটিরাঙ্গা সদরের ভুইয়াপাড়ায় ভাড়া বাসায় সপরিবারে বসবাস করে আসছে।

এসব ঘটনার প্রতিবাদে রবিবার জেলার গুইমারা, রামগড়, পানছড়ি, মানিকছড়িসহ বিভিন্ন উপজেলায় বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, পার্বত্য নাগরিক কমিটি, পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ ও মারমা সমাজ বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন