বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুতা : চলছে বেপরোয়া অপহরণ, লুটতরাজ ও হামলা: আতঙ্কে জেলেরা

জলদস্যু

স্টাফ রিপোর্টার:
বঙ্গোপসাগর এখন জলদস্যুদের সেভ জোনে পরিণত হয়েছে। বেপরোয়াভাবে সেখানে চলছে জলদস্যুতা। বিশেষ করে উপকুলীয় দ্বীপ মহেশখালী-কুতুবদিয়া সমুদ্র চ্যানেলে জলদস্যুদের তান্ডব আশংকাজনকহারে বাড়ছে।

নিয়মিত চলছে অপহরণ, লুটতরাজ ও জেলেদের উপর হামলা। এসব জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় সমাজের মুখোশধারী জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীরা কয়েকজন ব্যক্তি। গত কয়েক ১০ দিনে ১৫ টিরও অধিক ট্রলার জলদস্যূতার শিকার হয়েছে। ফলে আতংকে রয়েছে জেলা মৎস্য সংশ্লিষ্টরা।

সুত্র জানায়, সম্প্রতি মহেশখালী ও কুতুবদিয়া চ্যানেলে জলদস্যুদের তান্ডব আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে। জলদস্যুদের সিন্ডিকেটের রয়েছে একাধিক আস্তাানা। ওসব আস্তানা থেকে তারা দস্যুতার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব জলদস্যুদের দিয়ে চলছে ডাকাতি, মাঝি মাল্লাদের অপহরণ, খুন, চোরাচালান, দস্যুতা, মুক্তিপন আদায় ও টোকেনের মাধ্যমে চাদাঁবাজির ঘটনা। সাগরে মাতামুহুরী নদীর মোহনা মহেশখালীর সোনাদিয়া চ্যানেল ও নদীর মোহনা সন্নিহিত এলাকায় নৌযান নিয়ে চলাচলকারী জেলেরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। ফলে জেলে পরিবার গুলো সব সময় আতংক, উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠার মধ্যে থাকে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে অব্যাহত ডাকাতি ও চাদাঁবাজির কারণে র্সবশান্ত হয়ে অনেক জেলে এ পেশা পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছে।

কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতি সূত্র জানিয়েছেন, গত এক সপ্তাহে সমিতিভুক্ত এফবি শাহ মজিদিয়া, এফবি ফারিয়া, এফবি লিলি, এফবি আল্লাহর দান ও এফবি সুমা ফিশিং ট্রলারসহ ৫০ জন জেলেকে অপহরণ করেছে জলদস্যুরা। একই সঙ্গে এফবি নাহিদা, এফবি আল সমর ও এফবি জুবাইদা ফিশিং ট্রলার থেকে মাছ ও জালসহ মূল্যবান মালামাল লুট করে তারা। এতে অনন্ত ৩০ জেলে আহত হয়েছে।

অপহরণকৃত বোট মালিকরা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে তাদের ফিসিংবোটসহ জেলেদের ছাড়িয়ে নিতে মোবাইল ফোনে মোটা অংকের টাকা দাবি করেছে জলদস্যুরা। কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক জানান, অন্যান্য ফিসিংবোট থেকেও ধারাবাহিক মুক্তিপণ চাওয়া হতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে সমুদ্রে আন্ত:জেলা জলদস্যু গ্রুপের অন্তত ৩/৪’শ সদস্য সক্রিয় রয়েছে। যারা প্রতিনিয়ত সাগরে বিভিন্ন মাছ ধরার ট্রলার ডাকাতি করে চলছে।

কক্সবাজার মৎস্য ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের সভাপতি জয়নাল আবেদীন জানান, “কক্সবাজার, মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার বোট মালিকরা সাগরের মাছ আহরণ করার জন্য ট্রলার পাঠিয়ে দ্বীপে ফিরে না আসা পর্যন্ত ডাকাতের কবলে পড়ার আশংকায় থাকে।”

জলদস্যুদের কবল থেকে ফিরে আসা একাধিক জেলেরা জানায়, “বিশেষ করে সোনাদিয়া, ঘটিভাংগা, ধলঘাটা, মাতারবাড়ী, কালারমার ছড়া, চকরিয়া ও কুতুবদিয়া এলাকার একটি সঙ্গবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এছাড়া সুন্দরবনের ডাকাতরা তো রয়েছেই।”

বোট মালিকদের অভিযোগ, “পুলিশের র্সোস পরিচয়দানকারী বেশ কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে এ সিন্ডিকেটের যোগসুত্রতা রয়েছে।”

কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতি সুত্র জানায়, কালারমারছড়া এলাকার একটি গ্রুপের সঙ্গে কুতুবজোম, ঘটিভাঙ্গা, সোনাদিয়া ও ধলঘাট এলাকার খন্ড খন্ড কয়েকটি দস্যু গ্রুপের মধ্যে সেল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জলদস্যুতা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।”

গত দুই বছর ধরে এ সিন্ডিকেটটি মহেশখালী, কুতুবদিয়া, বাশঁখালী ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকটি মাছ ধরার ট্রলারে দস্যুতা ও মোটা অংকের চাঁদাবাজি করছে। ওই বাহিনীর সদস্যরাই সাগরে জেলেদের হত্যা করে নৌকার মাছ ও মালামাল লুটপাট ও টোকেনের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করছে। এ পরিস্থিতিতে জলদস্যুদের কাছ থেকে টোকন না নিয়ে সাগরে যেতে ভয় পাচ্ছে জেলেরা।

সুত্র আরো জানায়, টোকেন বিক্রি করে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা আদায় করে চলেছে ওই জলদস্যুরা। ডাকাতদের প্রতিমাসে বোট মালিক ও মাঝিরা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতো। কোনো মাসে চাঁদা দিতে না পারলে নেমে আসতো নির্মম অত্যাচার। আর এ চাঁদার টাকা লেনদেন হতো মোবাইল ব্যাংক বিকাশ-এর মাধ্যমে। ফলে জলদস্যুদের হাতে জেলে পরিবার গুলো সব সময় জিম্মি থাকে।

এ ব্যাপারে একাধিক ট্রলার মালিকরা জানান, “নিয়মিত মাসোহারা দিতে অপারগ হলে পরবর্তি এই ট্রলার সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া মাত্রই ওই জলদস্যুদের কবলে পড়ে।”

জলদস্যুরা ট্রলারের ইঞ্জিন, জাল, আহরণকৃত মাছ, তেল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি লুট করে নিয়ে যায়। খালি ট্রলারটি ফুটো করে সাগরে ডুবিয়ে দেয়। ফলে কিছু মাঝি মাল্লারা সাতাঁর কেটে তীরে ফিরে আসলেও অনেকে সাগরে প্রাণ হারায়। অনেক সময় জলদস্যুরা মাঝি মাল্লাদের অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে জিম্মী করে মুক্তিপন আদায় করে।

এছাড়া এই চ্যানেল দিয়ে মায়ানমার থেকে আসা বেল্ডার লবন, বিভিন্ন ব্রান্ডের বিদেশী মদ, সিরামিক পণ্যসহ এবং এখান থেকে মায়ানমারে যাওয়া, জন্ম নিয়ন্ত্রন বডি, বিভিন্ন প্রকার ওষুধ, চোরাই কাঠসহ বিভিন্ন চোরাচালান নিয়ন্ত্রন করছে এ সিন্ডিকেটটি।

মায়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যের দস্যুদের সঙ্গে এদের মোবাইলে যোগাযোগ থাকায় সিন্ডিকেটের সঙ্গে বনিবনা না করে কোন চালান পাচার হতে গেলে দস্যুরা এসব ট্রলার উপকুলে নিয়ে এসে মালামাল খালাস করে নেয়।
অপরদিকে বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের ভয়ে কক্সবাজার জেলার অন্তত ৫০ হাজার জেলে চরম আতংকে জীবনবাজি রেখে সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছে।

এব্যাপারে মহেশখালী থানার ওসি আলমগীর হোসেন জানিয়েছেন, “জলদস্যূতা বন্ধে মহেশখালী চ্যানেলের আশে পাশে পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে। তবে দস্যুরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করায় পুলিশকেও বেগ পেতে হচ্ছে তাদেরকে ধরতে।”

কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুুর রহমান চেয়ারম্যান জানান, “মহেশখালী ও কুতুবদিয়া চ্যানেল বাঁশখালী এবং মহেশখালীর ডাকাতরা বেশি তান্ডব চালায়। এদেরকে রোধ করা না গেলে মাছ আহরণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

এব্যাপারে জেলা পুলিশ সুত্র জানায়, “গত কয়েক বছর থেকে এ পর্যন্ত জলদস্যুদের বেশ কয়েকজন সর্দারকে অস্ত্র সহ আটক করে জেলে পাঠানো হয়েছে। যার কারণে জলদস্যুতা কমে এসেছিল। সম্প্রতি মহেশখালী ও কুতুবদিয়া চ্যানেলে জলদস্যুতার খবরও পুলিশের কাছে রয়েছে। পাশাপাশি সাগরে অন্যান্য পয়েন্টেও জলদস্যুদের ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছে প্রশাসন। শীঘ্রই নৌ বাহিনী ও কোস্টগার্ডকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ অভিযান শুরু করবে।”

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন