বাংলাদেশি-রোহিঙ্গা যোগসাজশে মানব পাচার, মিয়ানমারে নির্যাতন ও মুক্তিপণ দাবি

fec-image

দালালচক্রের প্রলোভনে মালয়েশিয়ায় উন্নত জীবনের আশায় নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের যুবকদের মিয়ানমারে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি ও নির্যাতনে একজনের মৃত্যুর ঘটনায় আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। বাহিনীটি জানিয়েছে, ওই তিনজনের মধ্যে পাচার চক্রের বাংলাদেশের হোতা মো. ইসমাইল রয়েছেন। গ্রেপ্তার তার দুই সহযোগী হলেন মো. জসিম ও মো. এলাহী।

র‌্যাব-১১-এর একটি দল শুক্রবার রাতে নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে শনিবার দুপুরে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

র‌্যাবের ভাষ্য, গত ১৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার ২২ যুবক মানব পাচার চক্রের মাধ্যমে টেকনাফ থেকে নৌপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় মিয়ানমারের কোস্টগার্ডের কাছে আটক হন। পরবর্তী সময়ে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা ১০ জুলাই আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে গিয়ে তাদের স্বজনদের ফিরে পেতে সরকারি উদ্যোগ নেয়ার আবেদন জানান। আবুল কালাম আজাদ নামের একজন বাদী হয়ে আড়াইহাজার থানায় মানব পাচার আইনে মামলাও করেন।

এই চক্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়া যাওয়া জহিরুল ইসলাম গত ২৪ মে দেশটির একটি হাসপাতালে মারা যান। গত ২৮ মে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তার মরদেহ দেশে আনা হয়। বাকি দুইজন এখন মালয়েশিয়া আছেন। ১৯ জন আছেন মিয়ানমারে।

আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র‍্যাবের মুখপাত্র বলেন, গ্রেফতার ইসমাইল ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় অবস্থানকালে মিয়ানমারের রাখাইনের রোহিঙ্গা রশিদুল ও জামালের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। পরবর্তী সময়ে ইসমাইল দেশে ফিরে রশিদুল ও জামালের সঙ্গে যোগসাজশে ১০ থেকে ১২ জনের একটি আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র গড়ে তোলেন। স্থানীয় এজেন্টদের যোগসাজশে বাংলাদেশে মানব পাচার চক্রটির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে।

র‌্যাবের কমান্ডার বলেন, চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার তরুণদের কোনো ধরনের অর্থ ও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌঁছানো হবে এবং মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে প্রলোভন দেখাত। এ টাকার ভাগের ৩০ হাজার করে পেতেন ইসমাইল, জসিম ও আলম। চক্রের অন্য সদস্যরা ১০ হাজার করে পেতেন। বাকি ২ লাখ ২০ হাজার টাকা মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রশিদুলের কাছে মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো হতো।

যেভাবে যাত্রা
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রথমে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসে করে কক্সবাজারের টেকনাফের মানব পাচার চক্রের আরেক সদস্য বাংলাদেশি আলমের কাছে যুবকদের হস্তান্তর করা হয়। টেকনাফের আলম ভুক্তভোগীদের কয়েক দিন রেখে সুবিধাজনক সময়ে ট্রলারে করে মিয়ানমারে জামালের কাছে পাঠিয়ে দেন।

পরবর্তী সময়ে মিয়ানমারের জামাল তার ক্যাম্পে বাংলাদেশি যুবকদের রেখে নির্যাতন করেন এবং তা ভিডিও করে গ্রেপ্তারকৃত ইসমাইলের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে ছয় লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে যাদের পরিবার মুক্তিপণের টাকা দিত, তাদের মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় রশিদুলের কাছে পাঠানো হতো।

র‌্যাব জানায়, রশিদুল প্রায় ২৫ বছর মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে মানব পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত।

২২ জনের যে পরিণতি
র‍্যাব জানায়, মানব পাচার চক্রটি গত ১৯ মার্চ ২২ জনকে ট্রলারে করে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাচার করছিলেন। ওই সময় মিয়ানমার উপকূলে দেশটির কোস্টগার্ড ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করে। বাকি তিনজনকে চক্রের সদস্য জামাল কৌশলে ছাড়িয়ে তার ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করেন। এর মধ্যে জহিরুলের পরিবারের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়।

র‍্যাব আরও জানায়, জহিরুলের পরিবার গত ১০ মে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা পাঠায় এবং অবশিষ্ট ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর পাঠাবে বলে জানায়। জহিরুলকে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে সিঙ্গাপুরের পাশ দিয়ে মালয়েশিয়া পাঠানো হয়। নির্যাতনের কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে মালয়েশিয়া পুলিশের মাধ্যমে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তী সময়ে গত ২৪ মে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যু সনদে প্রাণহানির কারণ হিসেবে শরীরে নির্যাতনের কথা উল্লেখ আছে।

র‍্যাবের মুখপাত্র বলেন, ২৮ মে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মালয়েশিয়া সরকারের তত্ত্বাবধানে জহিরুলের মৃতদেহ বাংলাদেশে এনে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মিয়ানমার কোস্ট গার্ডের হাতে আটক বাকি ১৯ জনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে।

এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘যখন তারা মিয়ানমার পৌঁছায়, তখন চক্রটিকে ভুক্তভোগীদের ২০ হাজার টাকা দিতে হতো। এই ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাদের মালয়েশিয়া পৌঁছে দেয়া এবং চাকরির ব্যবস্থা করার কথা ছিল। এরপর থেকে তাদের মানবিক নির্যাতন শুরু করে কেউ ১ লাখ, কেউ দুই লাখ এভাবে পাঁচ লাখ পর্যন্ত টাকা দাবি করত। পরে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমানা হয়ে সিঙ্গাপুর সমুদ্র সীমানা দিয়ে মালেশিয়ার নীরব একটা জায়গায় যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পৌঁছাতে পারে না, সেখানে রাখা হয়েছে।

‘এর আগে যে আটজন জহিরুল ইসলামের সঙ্গে মালয়েশিয়ায় অবস্থায় করেছে, এই আটজনের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। কারণ পরিবার থেকে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি। এই আটজনের কী অবস্থা, আমরা জানি না।’

চক্রটির সঙ্গে কোনো রোহিঙ্গা আছে কি না, তাদের পরিচয় কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রশিদুল ও জামাল মিয়ানমারের নাগরিক। ইসমাইল বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশে এ চক্রের ১০ থেকে ১৩ জনের সন্ধান পেয়েছি।

‘মিয়ানমারের যে জামাল রয়েছে তিনি মালয়েশিয়ার নাগরিক রোহিঙ্গা হিসেবে সবাই জানে। তার সঙ্গে ইসমাইলের ভালো সম্পর্ক। জামালের নেতৃত্বেই এই আটজনকে যে নৌকা দিয়ে নেওয়া হয়েছে, এটি মিয়ানমারের নাগরিকের।’

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশ, মানব পাচার, মিয়ানমার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন