বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কঃ প্রেক্ষিত বিকল্প প্রস্তাব

fec-image

বাংলাদেশের দু’ টি মাত্র প্রতিবেশী; ভারত ও মিয়ানমার। স্থলভাগে ভারতের সঙ্গে প্রায় ৪,০৯৬ কি: মি: সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্ত কেবল দৈর্ঘ্যেই সামান্য নয়; বিরোধেও নগন্য। তুলনায় পরাক্রমশালী ভারতের রাজধানী দিল্লী, ভৌগলিকভাবেও ইয়াঙ্গুনের তুলনায় অনেক দুরে। মাত্র দুই প্রতিবেশী ঘেরা দেশের সংখ্যা বিশ্বে খুব বেশী নেই; বড় জোর ২৬টি। দু’য়ের অন্যতম প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের অসন্তোষ তৈরীর উৎস নেই বললেই চলে; অমীমাংসিত সীমান্ত নেই, অভিন্ন নদীর পানি বন্টন নিয়ে ঝামেলা নেই। সমুদ্র সীমা নিয়ে দু’দেশের মধ্যে যে বিরোধ ছিল, তাও আন্তর্জাতিক সালিশের মাধ্যমে কেটে গেছে। তারপরও বাংলাদেশের কাছে মিয়ানমার যেন অনেক দুরের দেশ। অপর প্রতিবেশী ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ, মিয়ানমারের সঙ্গে ততটাই যেন দুরত্ব।

যদিও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং মিয়ানমারের  আরাকান অঞ্চলের মধ্যে ভৌগলিক, সাস্কৃতিক ও নৃ-তাত্ত্বিক সাদৃশ্য রয়েছে; যদিও মধ্যযুগের বাঙ্গালী মুসলিম সাহিত্যে বার্মা ও আরাকান সবিস্তারে উপস্থিত; যদিও সীমান্তের দু’পাশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন কয়েকশ’ বছরের পুরনো, তবু ভৌগলিক অবস্থানের বিষয়ে অন্ধকারে থাকা যে কারও, ঢাকায় দাঁড়িয়ে ভাবা অস্বাভাবিক নয় যে, মিয়ানমার; চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনামের চেয়েও অনেক দুরের দেশ।

অবকাঠামোগত দুর্গমতা, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দুরত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে, মিয়ানমারের দিকে চলে যাওয়া “আরাকান রোড” দিয়ে বড়জোর সীমান্তের ওপাশের শহর মংডু পর্যন্ত যাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার হয়ে ‘এশিয়ান হাইওয়ে’ কিংবা ‘ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে’ তে যুক্ত হওয়া অথবা আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে সড়ক পথে “মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং” পর্যন্ত যাওয়ার কথা শোনা গেছে কেবল, বাস্তবে মেলেনি কিছু। বঙ্গোপসাগরের দু’কোলে থাকা দুই বন্দর, ‘চট্টগ্রাম ও ইয়াঙ্গুন’ এর মধ্যে সম্ভাবনাময় সামুদ্রিক যোগাযোগও অনুন্মোচিত রয়ে গেছে। এর প্রধান কারণ  “আরাকান রাজ্য” তথা মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের পরিস্থিতি।

আমরা যেমন মিয়ানমারকে, ‘আরাকান’ দিয়ে চেনার চেষ্টা করেছি; মিয়ানমারও তেমনি বাংলাদেশকে বিবেচনা করে, আরাকানের ‘রোহিংগা জনগোষ্ঠী’ দিয়ে। মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের, ভৌগলিক ও সাস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক হিসেবে, আরাকান যেখানে দু’ দেশের জন্য ঐক্যের সেতু হতে পারত, দুর্ভাগ্যবশতঃ সেখানে এটি হয়ে গেছে “বিভাজন রেখা”। আরাকান বা রাখাইন স্টেট এখন মিয়ানমারের অংশ হলেও, এ স্টেটটি যেন সে দেশের আর দশটা অংশ থেকে আলাদা। এ স্বাতন্ত্রের, ঐতিহাসিক অনেক কারণ রয়েছে। ব্রিটিশদের দখলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত, মিয়ানমারের বৃহদাংশ এবং প্রাসঙ্গিক আরাকান, আলাদা একটি দেশ ছিল।

আরাকানের স্বতন্ত্র সাহিত্য- সংস্কৃতি তো বটেই, মুদ্রা, এমনকি রাষ্ট্রব্যবস্থাও ছিল, আলাদা। শুধু মধ্যযুগ নয়, খ্রীস্ট পূর্ব আড়াইহাজার বছর আগেও আরাকান রাজ্য, মিয়ানমার (বার্মার) রাজাদের বাইরে, ভিন্ন রাজাদের অধীনে শাসিত হতো। বস্তুত এ অঞ্চল থেকে বৃটিশরা চলে যাওয়ার কিছুদিন পূর্বে ১৯৩৫ সালে প্রথমবারের মতো আরাকান তৎকালীন বার্মার সাথে এক রাষ্ট্রভূক্ত হয়। ব্রিটিশ শাসনামলেই আরাকানের মুসলিমরা আলাদা সম্প্রদায় হিসেবে এ এলাকায় সংগঠিত হতে থাকে। তারা নিজেদের পরিচয় দিতে থাকে ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় তখন আরাকানেও ‘মুসলিম লীগ’  গঠিত হয়েছিল এবং এর নেতারা তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর সঙ্গে একীভূত হওয়ার জন্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’ র সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেছিলেন। পঞ্চাশের দশকে গঠিত হয়েছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন  “মুজাহেদীন”। মূলত ঐ সময় থেকেই আরাকানে মুসলিম- অমুসলিম বিভাজন ও সংঘাত বাড়তে থাকে।

এর কারণ অনুসন্ধানে ভৌগলিক মানচিত্র দেখলেই বুঝা যায় যে, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে উত্তরে ভারতের মণিপুর পর্যন্ত পুরো এলাকাকে বাকি মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রাকৃতিক প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সুউচ্চ আরাকান পর্বতমালা। এর দৈর্ঘ্য কম-বেশী একহাজার কি. মি. সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ব্রিটিশ আমলের মাউন্ট ভিক্টোরিয়া বা হালের নাত মা টংয়ের(Mount  Khawnusoum) গড় উচ্চতা দশ হাজার ফুটের বেশী। এ পর্বতমালার কারণেই আরাকানের সমুদ্র অঞ্চলও মিয়ানমারের বাকি তটরেখা থেকে বিচ্ছিন্ন। বস্তুত: আরাকান পর্বতমালাই হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সীমান্ত রেখা। এ সীমান্তরেখা, দু’ অংশের ইতিহাসকেও করেছে বিভাজিত।

ব্রিটিশ দখলদারিত্বের আগ পর্যন্ত দু’ অংশের রাজনৈতিক ইতিহাস দু’ ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। আরাকান পর্বতমালার কারণেই চীনা বা বার্মিজ যোদ্ধারা/ রাজারা, কখনো আরাকানে সফল  আগ্রাসন চালাতে পারেনি এবং এখানে স্বতন্ত্র সভ্যতা গড়ে উঠেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীন ও মিয়ানমারসহ গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানের জয়রথ, আরাকানের এই পর্বতমালার প্রান্তে এসে থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এ কারণেই মণিপুরের কোহিমা, মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন বিজিত হলেও সে সময় বাংলার চট্টগ্রাম রয়ে গিয়েছিল অধরাই। কয়েক দশক আগেও আরাকানের সাথে মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের স্থল যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। এখন অবশ্য আরাকান পর্বতমালার মধ্য দিয়ে একাধিক সড়কপথ তৈরী করে নিয়েছে ইয়াঙ্গুন; রয়েছে বিমান রুটও। বলাবাহুল্য, প্রযুক্তির কল্যাণে পর্বতমালা যখন আর যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা নয়, তখন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আরাকান পর্বতের প্রাকৃতিক প্রাচীরের প্রতিবন্ধকতার  “মানব সংস্করণ” হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে ‘রোহিংগা জনগোষ্ঠী’।

বিশ্ববাসী দেখেছে, বছরের পর বছর ধরে আরাকানে বিভিন্ন দাঙ্গাও সহিংসতার জেরে নৌ ও স্থল পথে, দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসছে। সীমান্ত রক্ষীরা ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে খাবার ও ঔষধ দিয়েছে। এর মধ্যে তাদের সর্বমোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ লক্ষাধিক; যারা ‘৮০ এর দশক থেকে এদেশে বহুল পরিমাণে আশা শুরু করেছে। এ কারণে তথা রোহিঙ্গা সংকটের কথা বিবেচনায় নিয়ে আরাকানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় মিয়ানমার এখনো আগ্রহ দেখাচ্ছেনা। সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না বলেই মিয়ানমারের  বিপুল সম্ভাবনাময় অর্থনীতিতে, বাংলাদেশ প্রবেশ করতে পারছে না; আর পারছেনা বলেই এ ইস্যুতে দূরত্ব কমছে না।

এদিকে অনেক রোহিঙ্গা অনৈতিক পথে বাংলাদেশী পাসপোর্ট সংগ্রহ করে, মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সৌদী আরবে চলে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় তারা ঐ দেশে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে বিবিধ অনিয়মে জড়িত হয়ে পড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের সুনাম ও জনশক্তি রপ্তানীতে। জানা গেছে তাদের সংখ্য প্রায় ৫৫ হাজার। এই ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার উত্তরাধিকার সন্তান- সন্ততিগন বাংলাদেশী ভোটার হিসেবেই বর্তমানে এদেশে বসবাস করছে। এসব কথিত বাংলাদেশী রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইদানীং মিয়ানমার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদ উসকে দেয়ার চেষ্টা করছে বলেও নির্ভরযোগ্য সূত্রে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে; যা সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে অংকুরেই বিনষ্ট করা সম্ভব। জানা যায়, সৌদী আরব সরকারও ইতোমধ্যে আলোচ্য ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠানোর জন্য কুটনৈতিক পর্যায়ে ক্রমশঃ  বাংলাদেশকে আহবান জানাচ্ছে। এসবে বোঝা যায়, রোহিঙ্গা সংকট সহসা কমবে, এটি দুরাশা মাত্র। ওদিকে মিয়ানমারের সাথে তার অন্যান্য প্রতিবেশীসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ যখন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে, তখন বাংলাদেশ, আরাকান পর্বতের মতো

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বোঝা মাথায় নিয়ে সম্ভাব্য সমাধান খুঁজছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট উপকূলে বিপুল তৈল ও গ্যাসের বিপরীতে বাংলাদেশের বিনিয়োগের সুযোগ, প্রাসঙ্গিক অবকাঠামো এবং মনস্তাত্ত্বিক বাধার কারণে হারাচ্ছে অবিরাম। ঢাকা- ইয়াঙ্গুন সম্পর্ক বিষয়ে গত কয়েক দশকের পর্যবেক্ষন সূত্রে ধারণা পাওয়া যায়, এরও “বিকল্প পথ” রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট শিগগিরই না কাটলেও, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার অন্যান্য ইস্যুতে পরস্পরের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। দু’পক্ষ আন্তরিক হলে  প্রতিকী অর্থে আরাকান পর্বতমালাসম বাধাও এড়ানোর অন্তত: একটি “বিকল্প উপায়” অবশ্যই রয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক বিরোধ থাকবার পরও চীনের সাথে ভারতের এবং মিয়ানমারের সাথে ভারতের, সর্বোপরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়ান ফেড়ারেশনের বা চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির বিকল্প প্রচেষ্টা বাংলাদেশের জন্য উদাহরণ হতে পারে; যার সামান্য কিছু এ পরিসরে আলোচনা করা যেতে পারে:

ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে বেশ কিছু জটিল ও স্পর্শকাতর বিরোধ থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে বর্তমান সম্পর্ক উন্নয়ন কূটনৈতিক সম্পর্কের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভারত-মিয়ানমার সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে বিরোধীয় বিষয় হচ্ছে নিরাপত্তা ইস্যু। ভারত প্রায়শই অভিযোগ করে থাকে, তার দেশের উত্তর-পূর্বাংশের বিচ্ছিন্নবাদীরা মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে আশ্রয়, প্রশ্রয় ও প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরামের বিচ্ছিন্নবাদীরা, মিয়ানমারের বন-পর্বত সঙ্কুল সীমান্ত এলাকায় অসংখ্য ঘাঁটি গেঁড়ে থাকে- এমন অভিযোগ ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় প্রায়শঃ দেখা যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করার পর তারা মিয়ানমারের দিকে সরে গেছে বলে অভিযোগ করা হয়। ভারত- মিয়ানমার সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও একটি স্পর্শকাতর বিষয় হলো, মিয়ানমারে গণচীনের দীর্ঘদিনের শক্তিশালী অবস্থান। ভারতের অভিযোগ চীন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। অন্যদিকে মিয়ানমারের দিক থেকেও একইরূপ অভিযোগ রয়েছে যে, তাদের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি ভারতের উত্তর- পূর্বাংশে প্রশ্রয় পেয়ে থাকে।

স্মর্তব্য যে, বিগত ২০১৫ সালের ১০ জুন মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানসহ তৎপূর্ববর্তী সপ্তাহে মিয়ানমারের ভূ-খণ্ডে অবস্থানরত ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্তৃক ভারতের মণিপুর রাজ্যে অভিযান পরিচালনা করে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনাকে হত্যার অভিযোগ ভারত উত্থাপন করেছিল। এহেন স্পর্শকাতর ঘটনা ও অভিযোগ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও পারস্পরিক উন্নয়নের স্বার্থে ভারতের সহিত মিয়ানমারের সাম্প্রতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক উন্নয়ন বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে বিবেচ্য।

অন্যদিকে চীন মিয়ানমারের আকিয়াবে (পুরানো নাম) গড়ে তুলেছে গভীর সমুদ্র বন্দর। এ বন্দরের মাধ্যমে চীন জ্বালানীসহ তার দেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে পণ্য সরবরাহ করতে চায়। ভারত ও চীনকে বন্দর ও করিডোর সুবিধা দিয়ে মিয়ানমার দক্ষিণ এশিয়ার আরেক সিংগাপুর হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। আবার আরব সাগরের পাড়ে পাকিস্তানের গোয়াদারে  একটি ভারত মহাসাগরের শ্রীলংকায় একটি এবং মিয়ানমারে দুইটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করতঃ চীন ‘মুক্তার মালা’ র মতো ভারত মহাসাগরকে একদিকে যেমন বেষ্টন করে ফেলেছে, অন্যদিকে তেমনি  তার   মোট আমদানী-রপ্তানীর প্রায় ৮৫% ভাগ যে মালাক্কা প্রণালী দিয়ে সম্পাদিত হয়, তার বিকল্পও সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের এ প্রভাবে ভারসাম্য আনতে মিয়ানমার সরকারের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পূর্ব থেকেই প্রবলভাবে আগ্রহী ছিল। তাই সামরিক শাসনে দীর্ঘদিন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর প্রাথমিকভাবে গণতন্ত্রের পথে যাত্রার প্রাক্কালে মিয়ানমারের প্রতি বিশ্বের বিশেষ আগ্রহকে কাজে লাগাতে তৎকালীন মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন এবং কূটনীতিকেরা যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। মিয়ানমারের গণতন্ত্রের যাত্রা যে নিরঙ্কুশ  ছিল না, তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। তবে সামরিক প্রশাসক ও বেসামরিক রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে প্রবল বিরোধ থাকা সত্ত্বেও এটা নিশ্চিত হয়েছে যে জাতীয় নিরাপত্তা, স্বার্থ ও উন্নয়নে তাদের মধ্যে সম-ধারণা বিরাজমান। আর এ সুযোগটিই দক্ষতার সাথে কাজে লাগাচ্ছে মিয়ানমার।

বিগত ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ সালে রাশিয়ান ফেডারেশন কর্তৃক ইউরোপের অন্যতম স্বাধীন দেশ ইউক্রেন এ আগ্রাসন চালানোর প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশসমুহ রাশিয়ান ফেডারেশনের বিরুদ্ধে প্রায় ৫ হাজারেরও অধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ধারাবাহিকতায় বর্ণিত দেশের মূল রপ্তানী সামগ্রী, জ্বালানী তৈল, আমদানী-রপ্তানীর উপরও তা কার্যকর করে। অথচ অদ্ভূত ব্যাপার হলো, উক্ত রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্বে যে পরিমাণ জ্বালানী তৈল আমদানী করতো  তা বন্ধ না করে পরোক্ষ পদ্ধতিতে তা চলমান রেখেছে।

এদিকে ভারত- যুক্তরাষ্ট্র সমীকরণের বাইরে তিব্বত, কাশ্মীর, অরুণাচলসহ বিভিন্ন বিষয়ে চীনের সহিত ভারতের প্রবল বিরোধ থাকা সত্ত্বেও দু’দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। নুতন আদলে চালু হচ্ছে ‘সিল্ক রুট’। চীনের হার্ডওয়্যার ও ইন্ডিয়ান সফটওয়্যার তথ্য- প্রযুক্তির যৌথ শিল্প, যুক্তরাষ্ট্রকে পিছনে ফেলেছে বহু পূর্বেই। এতদ্ব্যতীত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা সত্ত্বেও চীন-যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে সবচেয়ে  বড় অভ্যন্তরীণ বাজার সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন অনেকাংশে টিকে আছে চীনের বিনিয়োগের উপর নির্ভর করে।

এদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ ইস্যূতে পশ্চিমা দেশসমুহ এবং চীনের অবস্থান আপাতদৃষ্টিতে বেশ মুখোমুখি মনে হলেও এতে বর্ণিত রূপ দ্বিবিধ অবস্থানের উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় চোখ এড়িয়ে যায় না। যেমন, এ যুদ্ধ শুরু হবার পর,মার্চ, ২০২২ মাসের শুরুতে এআইআইবি(AIIB),  আর্থিক ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে, রাশিয়া এবং বেলারুশের সাথে সব ব্যবসা স্থগিত করে এবং এনডিবি(NDB)  রাশিয়ায় নুতন লেনদেন আটকে রেখেছে। এতে বুঝা যায়, অভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অভিন্ন আদর্শ ও মূল্যবোধ একমাত্র উপায় নয়, বরং এ ক্ষেত্রে ব্যবহারিক বিবেচনা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এতদ্ব্যতীত লক্ষণীয় যে, চীন- ভারতের দ্বি-পক্ষীয় বাণিজ্যও গত অর্থ বছরে(২০২১-২০২২) বে শ বেড়েছে। উক্ত অর্থ বছরে দেশ দু’ টির মধ্যেআমদানী- রপ্তানীর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১১ হাজার ৫৪২ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে; যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ৮ হাজার ৬৪০ কোটি ডলার।

ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, দেশটি গত অর্থ বছরে চীনে ২ হাজার ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানী করেছে। এর আগের অর্থ বছরে রপ্তানী করেছিল ২ হাজার ১১৮ কোটি ডলারের পণ্য। একই সময়ে চীন থেকে ভারতে পণ্য আমদানীও বেশ বৃদ্ধি পায়। যেমন গত ২০২০-২১ অর্থ বছরে তারা চীন থেকে মোট  ৯ হাজার ৪১৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানী করেছে। এর আগের অর্থ বছরে আমদানীর পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৫২১ কোটি ডলারের।

একইভাবে ভারত-চীন বিদ্যমান বিরোধ সত্ত্বেও এশীয় রাজনীতিতে রাশিয়াকে সঙ্গে করে গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী নয়া এক্সিস- ব্রিকস। অনুরূপ নিরাপত্তা সংক্রান্ত বেশ কিছু স্পর্শকাতরতা সত্ত্বেও ভারত-মিয়ানমার সামরিক সহযোগিতা বর্তমানে অনেক উচু্ঁ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সর্বশেষ চীনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির অন্যতম প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে। গত ১০ জুন, ২০১৫ মিয়ামারের তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী অংসান সূচির ৫ দিনব্যাপী চীন সফর লক্ষণীয়। অথচ মিয়ানমারের পুর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ কোকাং এলাকায় দেশটি বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছে; যার সাথে চীনের ইয়ানুন প্রদেশের সীমান্ত রয়েছে। এ সীমান্তে সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ে চীন উদ্বিগ্ন। গত মার্চ, ২০১৫ বিদ্রোহী দমন অভিযান কালে মিয়ানমার বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধ বিমান বর্ণিত সীমান্তের ঠিক ওপারেই চীনের ইয়ানুনের একটি আখ ক্ষেতে বোমা ফেললে ৫ জন নিহত হয়; যার প্রতিক্রিয়ায় সে সময় চীন ঐ এলাকায় সেনা পাঠায়। এত কিছুর পরও মিয়ানমারের সাথে চীনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা গভীর, দৃঢ় ও ক্রমশ উন্নতির দিকে প্রবহমান রয়েছে।

বিশ্ব রাজনীতির এ জটিল সমীকরণগুলো থেকে বাংলাদেশকে শিক্ষা লাভ করার প্রয়োজনীয়তা কোনভাবে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব আলোচনায় আমরা সর্ব প্রথমেই যদি বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও এর গুরুত্ব তুলে ধরি। এতে মিয়ানমারের ভৌগলিক অবস্থান যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে সহজেই চোখে পড়ে বিশ্ব মানচিত্রে রাজনীতি, বাণিজ্য, সামরিক ক্ষেত্র প্রভৃতিতে মিয়ানমারের ভৌগলিক অবস্থান বাংলাদেশের চাইতে অধিকতর গুরুত্বপুর্ণ। এটা যে শুধু কোন তত্ত্ব  বা বিশ্লেষণ নয় তা ইতোপুর্বে গণতন্ত্রের জানালা খোলার সাথে সাথে বিশ্বের প্রভাবশালী ও পরাশক্তিসমুহ যেভাবে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে উঠেপড়ে লেগেছিল তাতে এ কথা সহজেই বুঝা যায়। উল্লেখ্য ২০১২ সালের নভেম্বরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজ আগ্রহে তাঁর এশিয়া সফরসূচিতে মিয়ানমারকেও অন্তর্ভুক্ত করেন। পাশের দেশ ঘুরে গেলেও সে সময় আমরা অনেক লবিং করেও মার্কিন প্রেসিডন্টকে কয়েক ঘন্টার জন্যও বাংলাদেশে সফরে আসতে, রাজি করাতে সক্ষম হইনি। যেটা এবারেও সম্ভব হয়নি জি-২০ সামিটের সময়। এ থেকেই বিশ্ব রাজনীতিতে মিয়ানমারের গুরুত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়।

মিয়ানমারের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর তথা ভারত মহাসাগরে মিয়ানমারের যে সুদীর্ঘ কোস্ট লাইন বা সমুদ্রতট রয়েছে, তার অবস্থান বাংলাদেশের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ ও পূর্ব ভারত মহাসাগরে, চীনের বিশাল প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের উক্ত ভৌগলিক অবস্থান তার জন্য বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বাণিজ্য, রাজনীতি ও সামরিক প্রত্যকটি ক্ষেত্রেই তা সত্য। সুপ্রাচীনকাল থেকেই মিয়ানমারের সমুদ্র বন্দর বিশ্ব বাণিজ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কাছে সুপরিচিত একটি স্থান। সামরিক ও বাণিজ্যিক সুবিধার পাশাপাশি মিয়ানমারের এ সমুদ্রসীমায় পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসসহ বিভিন্ন খনিজ সম্পদের আবিস্কৃত ও অনাবিস্কৃত মজুদ রয়েছে। ইতোমধ্যে চীন ও ভারতীয় বিভিন্ন মিনারেল এক্সপ্লোরেশন কোম্পানী মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস আবিস্কার ও উত্তোলনে নেমে পড়েছে। শুধু সমুদ্রসীমা নয়, বিশাল আয়তনের এ দেশটির স্থলভাগেও তেল-গ্যাস সহ বিভিন্ন ধরণের খনিজ সম্পদ মজুদ রয়েছে। জ্বালানী ক্ষুধার্ত বিশ্বে এ সম্পদ মিয়ানমারের গুরুত্বকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিয়েছে এবং প্রত্যেকেই এখান থেকে তার সুবিধা লাভ করতে মরিয়া। এছাড়াও বিশ্বে মিয়ানমার এমন একটি দেশ, যার সীমান্তে রয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের বাস। ভারত, চীন, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, লাওস মিলে এ বিশালাকার বাজার বিস্তৃত। আর এসব সুযোগ কাজে লাগিয়ে মিয়ানমার  তার দেশকে উন্নয়নের নুতন উচ্চতায় নিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে তার গতি কমে গেলেও তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি। দুরের দেশ এসব সুবিধা গ্রহণ করলেও একই সীমান্তের প্রতিবেশী হয়েও বাংলাদেশ অধিক সম্ভাবনাময় অবস্থানে থেকেও এ সুযোগ থেকে কোন ফায়দা নিতে পারেনি।

ভৌগলিক বিবেচনায় প্রায় তিনদিক থেকে ভারত বেষ্টিত বাংলাদেশের জন্য, মিয়ানমার একমাত্র খোলা জানালা। ভবিষ্যতে ভারতের সাথে যেকোনো সঙ্কটে বাংলাদেশের সহিত বহির্বিশ্বের যোগাযোগ ও সহায়তার ক্ষেত্রে মিয়ানমারই হতে পারে একমাত্র গেট-ওয়ে। প্রাকৃতিক জ্বালানীর ক্ষেত্রেও মিয়ানমার বাংলাদেশের সবচেয়ে সহজ উৎস হতে পারে। আসিয়ান রাষ্ট্রসমুহের সহিত সরাসরি সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের অবস্থান আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে ও রেলওয়ে তৈরী করে বাংলাদেশ একই সাথে আসিয়ান, সার্ক, বিমসটেকসহ প্রাচ্যের বাণিজ্য ও যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। চীন ইদানীং বাংলাদেশের  কক্সবাজারের মহেশখালীতে নির্মাণাধীন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর সুবিধাকে কাজে লাগাতে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে একটি আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী।

এছাড়া বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মিয়ানমার হচ্ছে উৎকৃষ্ট একটি বিকল্প। নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া বিবিধ ঘটনায় ভারত থেকে খাদ্য আমদানী ব্যহত হলে মিয়ানমারকে বিকল্প হিসেবে পাওয়া গেছে সহজেই। বাংলাদেশ এখনো চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মাছসহ বিভিন্ন খাদ্য- সামগ্রীর জন্য মিয়ানমারের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। আমদানী খরচ কম হওয়ায় তা বাংলাদেশের জন্য লাভজনকও বটে। মিয়ানমারের রয়েছে বিপুল পরিমাণ মুল্যবান কাঠ। বাংলাদেশের রয়েছে ফার্নিচার শিল্পের বিরাট সংখ্যক দক্ষ ও সস্তা শ্রমিক। এ ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগে শিল্প প্রতিষ্ঠা করে দুই দেশই ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারে। এছাড়া মিয়ানমারে বিপুল পরিমাণে অনাবাদী চাষযোগ্য জমি পতিত রয়েছে। বাংলাদেশের কৃষকেরা দীর্ঘমেয়াদে সেসব জমি লীজ নিয়ে চাষাবাদ করলে দুই দেশই তা থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারে। এমনকি এসব বিষয়াদী নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হলেও নানা কারণে তা সফল হয়নি।

অন্যদিকে মিয়ানমারও বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে নানা ভাবে লাভবান হতে পারে। বিশেষ করে মিয়ানমার-ভারত দীর্ঘ সীমান্ত থাকলেও ভারতের মূল ভূ-খন্ডের সাথে সংযোগ স্থাপনে তা মোটেই উপযোগী নয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রস্তাবিত ট্রান্স এশিয়ান সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাই একমাত্র বিকল্প। বাংলাদেশ ছাড়া মিয়ানমারের পক্ষে অন্যান্য সার্ক সদস্য দেশ ও পশ্চিমের দেশসমুহের সাথে সড়ক যোগাযোগ সম্ভব নয়। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ সংক্রান্ত যে   “MOU” সম্পাদিত হয়েছে, তাতে অন্য কোন দেশ ইচ্ছে করলে এ পথ ব্যবহারে যোগদানের সুযোগ রাখা হয়েছে বিধায়, মিয়ানমার ইচ্ছে করলে এতে যোগ দিতে পারে। অর্থাৎ স্থল আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের অবস্থান ও সুবিধা গ্রহণ বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে তেমন একটা সম্ভব নয়। সার্বিক বিষয়াদী পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধের জায়গা খুবই সংকীর্ণ এবং পারস্পরিক উন্নয়নে পরিপূরক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ- মিয়ানমার সম্পর্ক কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নীত হয়নি।

সারা বিশ্ব যখন একসময় মিয়ানমারের জন্য দরজা রুদ্ধ করে রেখেছিল, সে নব্বয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের জন্য দরজা খুলে বলেছিল, ‘লুক ইস্ট’ (Look East)।  এরপর এ নীতি নিয়ে যতো কথা হয়েছে ইস্টে তাকানো ততটাই হয়নি। পরবর্তীতে মিয়ানমারে ঈষৎ খোলা জানালা দিয়ে বিশ্ব ঢুকেছে বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের মতো  কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ নির্বিকার দর্শক। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময় দক্ষিণ এশিয়াকে ভারতের চোখ দিয়ে দেখতে চায়। কিন্তু আজকের বাংলাদেশ বলছে, ভারতের চোখের বাইরেও নিজস্ব স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব চোখ রয়েছে। এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষনীয় যে, ‘ভারত- যুক্তরাষ্ট্র’ সম্পর্কের ‘হানিমুন’ পিরিয়ডেও ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বি রাশিয়ার সাথে তার সম্পর্ককে নূন্যতম শীতল করেনি। বিশ্বে এমন কোন দেশ পাওয়া যাবে না, যার প্রতিবেশীর সাথে নূন্যতম সমস্যা নেই। ব্যক্তি জীবনেও, এটা সত্য। তবু সম্পর্ক ও সহযোগিতা থেমে থাকে না। হাজার মতের অমিল থাকার পরও  তাকে পাশ কাটিয়ে পারস্পরিক প্রয়োজন ও নির্ভরশীলতার স্বার্থেই সম্পর্ক গভীর করতে হয়। বাংলাদেশ-মিয়ানমারকেও তাই পারস্পরিক স্বার্থে সম্পর্ক গভীর করতে হবে। বিদ্যমান বিরোধ মিমাংসা করে কিংবা আপাতত তাকে পাশ কাটিয়েই এ সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হবে; যার আপাত কোন বিকল্প নেই।

প্রসঙ্গত: বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যখন আকস্মিক ধাক্কায় সম্ভাব্য জরুরী পদক্ষেপ সম্পর্কে বিবিধ পন্থা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে, তার সাথে সাজুজ্য রেখে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন’ বিষয়ের চেয়ারম্যান জনাব রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর এর বক্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি গত ২৮ মে, ২০২২ ‘ কোন পথে অর্থনীতি ও আগামীর বাজেট’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন,”নিত্যপণ্য ও জ্বালানী আনতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা যেতে পারে। এর ফলে দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেও গেটওয়ে খুলে যাবে।” এহেন পটভূমিতে বাংলাদেশকেই বের করে আনতে হবে বিকল্প পথ। আর বর্ণিত বিকল্প পথেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।

বর্তমানে এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, কোন আন্তঃদেশীয় সীমান্তে যদি স্থলপথের আধিপত্য না থাকে তাহলে বিমান ও নৌ- যোগাযোগ নিছক আনুষ্ঠানিকই থেকে যায়। কারণ বিমানে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্বই কেবল যাতায়াত করতে পারেন; মূল বাণিজ্যিক বিনিময় হয় স্থল পথেই। ট্রাক ও লরির সারি যত লম্বা ও অভ্যন্তর ভেদী হয়, বাণিজ্যের স্বাস্থ্য তত টেকসই হয়। আর অধিকাংশ সাধারণ মানুষের যাতায়াত হয় স্থলপথেই। স্থলপথ ধরে যুগে যুগে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাণিজ্যিক বিনিময় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা দিয়েই সমৃদ্ধ ও টেকসই হয় বৃহত্তর লেনদেন। ‘ঢাকা- ইয়াঙ্গুন’ এর সম্পর্ক, সত্যিকার অর্থে ঘনিষ্ঠ করতে হলে স্থল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। আর দু’ দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়লেই বাড়বে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা।

এটা ঠিক দুই দেশই স্থল বা সড়ক যোগাযোগ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এসেছে অন্তত গত  কয়েক দশক থেকে। পরিকল্পনা ছিল কক্সবাজারের নাইক্ষংছড়ির ঘুনধুম এলাকা দিয়ে আরাকানে প্রবেশ করবে বহুমাত্রিক সম্পর্কের মহাসড়ক। কিন্তু বাঁধা হিসেবে এলো সেই আরাকান পর্বতমালার ন্যায় রোহিঙ্গা সংকট। আরাকান স্টেট যদি স্থিতিশীল থাকতো তাহলে এর মধ্য দিয়ে বৃহত্তর মিয়ানমারে প্রবেশে বাংলাদেশের জন্য কোন ইস্যুই থাকতো না। চারপাশের প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিয়ানমারের সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধির যে হাইওয়ে রেনেসাঁ চলছে, তা থেকে বাংলাদেশের বঞ্চিত থাকার কোন সুযোগ বা শংকা ছিল না। এ ক্ষেত্রে আপাতত আরাকান বা রোহিংগা সংকটকে বিবেচনায় নিয়েও একে এড়ানোর বিকল্প নেই। ভবিষ্যতে রোহিংগা সংকটের সমাধান হলে তখন আরাকানের মধ্য দিয়েও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। তাতে দু’ দেশের যোগাযোগও বহুমাত্রিকতা পাবে বৈকি । এ মুহুর্তে সবচেয়ে অন্যতম বিকল্প হচ্ছে, বাংলাদেশের বান্দরবান পার্বত্য জেলার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের চিন স্টেট এর সঙ্গে মহাসড়ক নেটওয়ার্ক তৈরী করা, যে রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের কম বেশী ১২ কি. মি. দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে।

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের পথে চকরিয়ার পর (ফাঁসিয়াখালি সেনা বিগ্রেড এলাকা), কক্সবাজার- চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে লামা- আলিকদম আঞ্চলিক সড়ক ইতোমধ্যেই বান্দরবানের  আলিকদম পর্যন্ত পৌঁছে, সেখান থেকে ডিম পাহাড়  হয়ে তা সম্প্রসারিত হয়েছে বান্দরবানের থানচি উপজেলা সদর পর্যন্ত। উক্ত চকরিয়া পয়েন্ট থেকে নির্মিয়মান মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের গড় দুরত্ব সর্বোচ্চ ১০ কি. মি. যার পাশ দিয়ে নির্মিয়মাণ চট্টগ্রাম- কক্সবাজার রেলওয়ে সড়ক অবস্থিত। প্রাসঙ্গিক পাহাড়ি সড়কটির গড় উচ্চতা সমুদ্র- পৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই হাজার ফুট। সড়কটির মাধ্যমে আন্ত: জেলা যোগাযোগ ব্যবস্থা সুগম হওয়ায় ইদানীং দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আনা- গোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোপূর্বে আলীকদম থেকে থানচি যেতে বান্দারবান সদর হয়ে নূন্যতম ১৯০ কি. মি. পথ পাড়ি দিতে হতো। বর্তমানে প্রাসঙ্গিক আলীকদম- থানচি আঞ্চলিক সড়কের দুয়ার খুলে যাওয়ায় সড়কটি দিয়ে কক্সবাজারসহ, চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে থানচি আন্তর্জাতিক সীমান্তের যোগাযোগে নুতন মাইল ফলক উন্মোচিত হয়েছে।

বর্ণিত থানচি  সদর  থেকে আরো একটি কাঁচা সড়ক এখনই উক্ত উপজেলার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন রেমাক্রি পার হয়ে অগ্রসর হয়েছে। বর্ণিত আন্তর্জাতিক  সীমান্তের ওপাশেই মিয়ানমারের চিন স্টেট। চিন যদিও ১৯৭৪ সালে স্টেটের মর্যাদা প্রাপ্তির পূর্বে  আরাকানেরই অংশ ছিল, তবু এর সঙ্গে আরাকানের জনমিতির পার্থক্য ব্যাপক। এ স্টেটে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি তেমন একটা নেই বললেই চলে; নেই কারেন বা কাচিন স্টেটের মতো অ-রোহিঙ্গা জাতিগত সংঘাতও। আরাকানের প্রতিবেশী হলেও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে” চিন স্টেট সম্পূর্ণ উল্টো।  স্থিতিশীলতাই এ স্টেট টিকে যোগাযোগ ও উন্নয়নে আরাকানের তুলনায় অনেক দুর এগিয়ে দিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে চিন স্টেট প্রায় প্রতিদিনই বদলে যাচ্ছে, মাইলের পর মাইল সড়ক ব্যবস্থা। কাঁচা রাস্তাগুলোয় ইট বিছানো হচ্ছে; ইট বিছানো রাস্তাগুলোতে কার্পেটিং চলছে। গত কয়েক বছরে সেখানে তৈরী হয়েছে এক ডজনেরও বেশী বড় ও মাঝারী সেতু। শুধু তাই নয়, আসিয়ান মহাসড়ক নেটওয়ার্কও চিন স্টেট স্পর্শ করে যাচ্ছে। এ স্টেটের গোটা সড়ক সড়ক পথ উন্নয়নে তারই হাওয়া লেগেছে। স্টেটটিতে ধূম পড়েছে বিদ্যুতায়ন ও শিল্পায়নেরও। প্রথাগত জলবিদ্যুতের পাশাপাশি ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ অনায়াসে  ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে  চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক ( আরাকান সড়ক) ও তৎপরবর্তীতে আলীকদম ও থানচি হয়ে মিয়ানমারের চিন স্টেটে ঢুকে যেতে পারে। উক্ত পয়েন্টে বাংলাদেশ- মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্ত রেখা থেকে আনুমানিক ১৮ কি: মি: দুরে বর্ণিত চিন স্টেটের প্যালেটাও টাউনশীপ এর অবস্থান। এ টাউন শিপের সঙ্গে স্টেট রাজধানী হাখা শহরের সড়ক যোগাযোগ প্রায় প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশ আগ্রহী হলে আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপাশের ছোট্ট টাউনশিপটির গুরুত্ব স্বভাবত:ই বেড়ে যাবে এবং মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ প্যালেটাও- হাখা সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে মনযোগ দেবে। আর  হাখা যাওয়া মানেই মিয়ানমারের প্রাচীন নগরী মান্দালয়, বর্তমান রাজধানী নেপিডো ও প্রধান নগরী ইয়াঙ্গুনকে সড়ক যোগাযোগের আওতায় পাওয়া। হাখা যাওয়া মানে আসিয়ান মহাসড়ক হয়ে মিয়ানমার  ছাড়াও থাইল্যান্ড, লাওস সহ দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়াকে আরও কাছে পাওয়া।

কেবল সড়ক যোগাযোগই নয় বরং চিন স্টেটের জল বিদ্যুতও পেতে পারে বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুত ঘাটতিও নিয়ন্ত্রণে আনার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। আর এরই ফলে বাংলাদেশের বান্দরবান পার্বত্য জেলার থানচি উপজেলাধীন উল্লেখযোগ্য এলাকা তথা TINDU, REMAKRI, CHUTO MODUK,  BORO MODUK, MONGWA, MRONGONG, YRANGBAG, LINKRIM, MALINGA, MROKHYANG, KAYINKGANG, TANKHOYAI, LAPAI, KHAI- JUNG এলাকা দেশের  ব্যবহারে আসবে। একই সাথে মিয়ানমারের PITHONG JHIR, KALAJONG, PROM এলাকা হয়ে চিন প্রদেশের সাথে থাইল্যান্ড সীমান্তের চিয়াং- মাই সহ গণ-চীনের সীমান্ত হয়ে LUANGPROBANG ও HANOY TOWN পর্যন্ত বিস্তির্ণ অঞ্চল বাংলাদেশের সাথে বহুমূখী যোগাযোগের প্রভাবে কর্মমূখর হয়ে উঠতে পারে। তাই মিয়ানমারের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে আপাতত: আর কোন বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আরাকান এড়িয়ে ঢাকার সাথে যেকোন যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধিতে আপত্তি নেই ইয়াঙ্গুনেরও। এক পাশে গণচীন এবং অপর পাশে ভারতের মতো দৈত্যকায় প্রতিবেশী এবং থাইল্যান্ডের সঙ্গে বিদ্যমান ঐতিহাসিক ও বহুমাত্রিক বিরোধকে বিবেচনায় নিয়ে মিয়ানমার স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গেই সম্পর্ক বৃদ্ধি করায় বেশী আগ্রহী হওয়ার কথা।

এতদ্ববিষয়ে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে মিয়ানমারের সাথে আলোচনাপূর্বক উভয় দেশের  উপযুক্ত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে একটি স্থায়ী নিরাপত্তা সংলাপ বিষয়ক বডি/ কমিটি গঠন, এখন সময়ের দাবী বলে, পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত।

♦ লেখক: নিরাপত্তা গবেষক।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশ, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক, মিয়ানমার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন