বাঘাইছড়ি থেকে বলছি: উপজেলা নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট

রাঙামাটি প্রতিনিধি:

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় ভোট গ্রহণ শেষে নির্বাচনী সরঞ্জাম নিয়ে ফেরার পথে বাঘাইছড়ির নয় মাইল এলাকায় পার্বত্য আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনের ব্রাশ ফায়ারে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ নিহত ৮ এবং ২০ এর অধিক আহত হয়েছে।

হৃদয়বিদারক সেই ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা উঠে এসেছে বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বর্ণনায়। সেই ঘটনার ভয়াবহতা নিয়ে ইমদাদুল হক তালুকদার নামে ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফেসবুকে পোস্ট দেন। ‘বাঘাইছড়ি থেকে বলছি’ শিরোনামে ওই ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি।

পাঠকদের জন্য সেই ফেসবুক পোস্টটি হুবুহু তুলে ধরা হলো-

‘এসেছিলাম নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে। ভোট বর্জনের মাধ্যমে ক্ষুব্দ প্রার্থী সরে দাঁড়ালেন শান্তিপূর্ণভাবে। সারাদিন খুব স্বাভাবিক, শান্ত পাহাড়ি জনপদ। সন্ধায় হুট করে রক্তারক্তির খবর! দৌড়ে গেলাম হাসপাতালে। তিনটি চান্দের গাড়ীতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ, হাসপাতালের সিড়ি আর মেঝেতে রক্তের ছটা আর ভেতরে তীব্র আর্তনাদ। পুরো ওয়ার্ডে রক্তাক্ত মানুষ; কিছু মৃত, কিছু আর্ত-চিৎকারে হতবিহ্বল। কান্না, রক্ত, অসহায়ত্ব, মাতম। ৬ জন ততক্ষণে নিথর মৃত। আশংকাজনক ১১ জন ভয়াবহ আশংকাজনক। বাকিরা চিকিৎসারত।’

‘ইউএনও স্যার, আমি, আর আরেক ম্যাজিস্ট্রেট রুহুল দিকবিদিকশুন্য ছুটছি রক্তাক্ত সিড়ি, করিডোর আর ওয়ার্ডে। কাতরদের পাঠাতে হবে হেলিকপ্টারে করে চট্রগ্রাম। তাহলে হয়তো বাঁচবে। আমি পুলিশ সাথে নিয়ে চিৎকার করছি গাড়ীযোগে হেলিপ্যাড এ পাঠাতে। আমাদের গাড়ীতে একটার পর একটা গুলিবিদ্ধ মানুষকে পাঠাচ্ছি। তারপর হেলিপ্যাডের দিকে যাত্রা। ৬ টি লাশ হাস্পাতালে রেখে সবুজ হেলিপ্যাডের মাঠে আমরা। লাইন ধরে শুয়ে থাকা বিক্ষত মানুষ। কারো বুক থেকে, কারও মগজ থেকে, কারো উরু থেকে, কারও ডানা থেকে সস্তা রক্ত ঝরছে। প্রথম দফায় ৬ জনকে উড়ানো হলো। ’

‘তার মধ্যে পোলিং অফিসার (প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক) আবু তৈয়বও ছিলেন। তার বড় ভাই বারবার কান্নায় ভেংগে পড়ছিলেন আর আমাকে ধরে বলছিলেন, “স্যার, আমার ভাইটাকে বাচান; আমার ভাই ছাড়া আমার বেচে থেকে লাভ কী। আমার ভাইটা কিছুদিন আগে চাকরি পেয়েছে স্যার। অনেক কষ্টে আমি ভাইটারে পড়ালেখা শিখাইছি।” আমি নিরুত্তর’।

‘কিছুক্ষণ পর জনা গেলো তৈয়ব আকাশপথে মারা গেছে। ওর ভাই আমাকে এসে কেবল বললো, “স্যার, আপনে না কইছিলেন আমার ভাইয়ের কিচ্ছু হবে না। স্যার, আমার ভাই তো নাই স্যার।”

‘এদিকে অনেকের মাঝে আনুমানিক ১০ বছরের শিশু, চান্দের গাড়ীর হেল্পার সাদ্দাম কাতরাচ্ছে। ওর লিঙ্গ ভেদ করে গুলি বের হয়ে গেছে। কপালে, মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে কেমন গলা ধরে এলো।’

‘সাড়ে এগারোটায় শেষ লটে সবাইকে বিদায় জানিয়ে শুণ্যতা নিয়ে ফিরে এলাম।’

‘এখন পাহাড়ে শূন্যতা, জোস্না স্নিগ্ধ আলোয় ছাপিয়ে রেখেছে অরণ্য। অরণ্যের গহিনে পাখিরা ঘুমোচ্ছে, আর চোখে জল নিয়ে জেগে আছে আর্তদের স্বজনেরা।’

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন