বান্দরবানের সেরা ১০টি দর্শনীয় স্থান

fec-image

বাংলাদেশের সেরা দর্শনীয় স্থানের জেলা হিসেবে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় একটি জেলা। এ জেলাটি দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৭৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই জেলার বিশেষত্ব শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা হিসেবেই নয়, বাংলাদেশের সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোর জেলা হিসেবেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এই পাহাড়ি জেলাটি।

এখানকার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের মধ্যে সবচেয়ে পর্যটকদের কাছে বেশি নজর কাঁড়ে উচু নিচু সবুজে ঢাকা দেশের সর্বউচ্চ পাহাড় কেওকারাডং, তাজিংডং, বিজয় তাজিংডংসহ জেলার উন্মত্ত জলপ্রপাত এবং জেলায় বসবাসরত ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠীর বাঙ্গালীসহ ১২টি সম্প্রদায়ের মানুষগুলো। এই অভিজ্ঞতাগুলো পেতে হলে জানতে হবে কীভাবে পাহাড়ের সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করা যায়।

জেনে নেওয়া যাক বান্দরবান জেলার সেরা ১০ দর্শনীয় পর্যটন স্পট সম্পর্কে।

১। নীলাচল পর্যটন স্পট:
এই নীলাচল পর্যটন স্পটটি বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে টাইগারপাড়ায় অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০০ফুট উপরে এর অবস্থান। ঘুরে দেখা যাবে নীলাচলের বাইরের দিকটা ছিন্নভিন্ন পাহাড় দ্বারা সজ্জিত হলেও ভেতরটা খুবই প্রশান্ত। কোথাও বিস্তীর্ণ দিগন্তের ঢালে ঘোরাঘুরির আঁকা বাঁকা রাস্তা, পাহাড়ের পাদদেশে পাহাড়ি সম্প্রদায়গুলোর পাড়া, আর তার সঙ্গে রূপালী ঝর্ণা-ঝিরিতে যেন শিল্পীর আঁকা ছবি। মেঘহীন আকাশে এই নীলাচল থেকেই কক্সবাজার সমুদ্র বা চট্রগ্রামের আনোয়ারর পারকি সমুদ্র সৈকতের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন পর্যটকরা। শহর ছেড়ে বান্দরবান-চট্রগ্রাম সড়কের প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে বা গাড়িতে বাঁ দিকের ছোট্ট সড়কটিই নীলাচলের প্রবেশ পথ। এই পথে প্রায় দুই কিলোমিটার পাহাড়ে উঠতে হবে তবোই মিলবে বান্দরবান জেলা প্রশাসন পরিচালিত নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র।

২। নীলগিরি পর্যটন স্পট:
বাংলাদেশের দেশের সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০০ফুট উপরে অবস্থিত বান্দরবানের আকর্শণীয় পর্যটন স্পট নীলগিরি এটি দেশের অন্যতম একটি উঁচুপর্বত শৃঙ্গ। নীলগিরির পুরো এলাকাটি মেঘে ঢেকে থাকার কারণে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা নীলগিরিকে মেঘের রাজ্য বলে থাকেন। নীলগিরির সূর্যোদয়ের মুহূর্তটি আশ্চর্যজনক এবং কুয়াশাচ্ছন্ন সব মৌসুমেই এখানে শীতকালের মত লাগে। এই র্পটন স্পটটি যেকোনো পর্যটককে চমকে দিতে পারে। এখানে মনোরম হেলিপ্যাড নীলগিরির সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর একটি। পর্যটন এলাকাটির রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

৩। চিম্বুক পাহাড়:
বান্দরবান জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি পর্যটন কেন্দ্র। এটি বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম পর্বত শৃঙ্গ। চান্দের গাড়ি দিয়ে চিম্বুক ভ্রমণের সময় এর চারপাশের নয়নাভিরাম প্রকৃতির দৃশ্য দেখা পর্যটকদের মন ভরে যায়। এখানে আসা দর্শনার্থীরা যখন এই জায়গা থেকে নিচের দিকে তাকায়। এই স্পটটে নিছে মেঘের ভেলা দেখে অবাক হতেই হয় দর্শনার্থীদের। এখানে বান্দরবান শহর থেকে পৌঁছাতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। সে ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে বিকাল ৫টার পর চিম্বুক-থানচি রুটে কোনো যত্রীবাহী যানবাহন চলবে না। তাই চিম্বুক পাহাড়ে যেতে হলে সেই সময়ের আগেই যেতে হবে। সাধারণত পর্যটকরা চিম্বুক, নীলগিরি, মিলনছড়ি, এবং শৈলপ্রপাত ঝর্ণা একসঙ্গে দেখার জন্য গাড়ি ভাড়া করে থাকেন।

৪। শৈলপ্রপাত ঝর্ণা:
বান্দরবান সদর উপজেলার মিলনছড়ি এলাকার এ জলপ্রপাতটি জেলা শহর থেকে মাত্র ৫ মাইল দূরে অবস্থিত। এই জলপপাতটির পানি অত্যন্ত ঠাণ্ডা ও স্বচ্ছ এখানে প্রচুর পাথরও দেখা যায়। ঝর্ণাটি স্থানীয় ফারুক পাড়াবাসীদের জন্য বিশুদ্ধ পানির একটি বড় উৎস। জলপ্রপাতের বাইরে একটি ছোট বাজারও রয়েছে যেখানে পর্যটকরা তাঁত পণ্য এবং স্থানীয় খাদ্য সামগ্রী কিনতে পারেন। এখান থেকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংগ্রামী জীবন গভীরভাবে অবলোকন করা যায়। বান্দরবানের অন্যতম আকর্ষণ চিম্বুক পাহাড় ও নীলগিরির পথের মাঝেই পড়ে শৈলপ্রপাত। তাই নীলগিরি ভ্রমণের গাড়ি মাঝ পথে থামিয়ে এই ঝর্ণা দেখে নেয়া যায়।

৫। বগালেক:
জেলার বিস্ময়কর এই নীল পানির লেকটির সৌন্দর্য দেখতে প্রতি বছর প্রচুর পর্যটক এখানে আসেন। শীতের মৌসুমে পর্যটকরা ক্যাম্প ফায়ার করতে পারেন, যা নিঃসন্দেহে একটি দারুণ স্মৃতি। বান্দরবান থেকে রুমা বাজারের দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার। আর রুমা বাজার থেকে বগালেক পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটারের পথ। এক সময় বর্ষাকালে বগালেক পর্যটন স্পটটিতে যাওয়া বেশ কষ্টকর হয়েও একন আর সমস্যা হয় না। একন সড়ক যোগাযোগ আগের তুলনায় অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে।

৬। স্বর্ণ মন্দির:
এই বৌদ্ধ মন্দিরটির আসল নাম বুদ্ধ ধাতু জাদি, যেটি বান্দরবানের সেরা দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে একটি। মায়ানমারের কারিগরদের দারা তৈরি এ মন্দিরটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মন্দির। এই মন্দিরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬০০ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এই স্বর্ণ মন্দিরে যেতে হলে অবশ্যই সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে যেতে হবে। আর সকালে যেতে না চাইলে দুপুর পৌনে ১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে যেতে হবে। ২০ টাকা প্রবেশ ফি দিয়ে মন্দিরটিতে প্রবেশ করে দর্শনার্থীরা এর স্থাপত্য এবং চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।

৭। তিন্দু:
তিন্দুর পাশ দিয়ে পাহাড়ি নদী সাঙ্গু বয়ে যাওয়ার কারণে মেঘ, নদী, জলপ্রপাত, রহস্য, রোমাঞ্চ সবই এখানে পাওয়া যায়। তাই তিন্দু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ভ্রমণকারীদের জন্য অন্যতম প্রিয় আকর্ষণ। বান্দরবান থেকে থানচি উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৭৯ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ পথে চারপাশের সুন্দর প্রকৃতি দেখতে দেখতে চোখ ও মন দুটোই সতেজ হয়ে যায়। থানচি ঘাট থেকে ছোট ইঞ্জিনের নৌকা ভাড়া করে প্রায় দুই ঘণ্টায় থানচি থেকে তিন্দু পৌঁছানো যায়। এ সময় যাত্রাপথে সাঙ্গু নদীর মনোমুগ্ধকর রূপের অভিজ্ঞতা নেয়া যায়।

৮। কেওক্রাডং:
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার ১৭২ ফুট উঁচু এই পর্বতটি রুমা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ছোট ও বড় পাহাড় পর্বতের সমন্বয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই দুর্গম এলাকা। কেওক্রাডং বাংলাদেশ ও মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত। সবুজ পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য, শীতল ঝর্ণা, আঁকাবাঁকা পথ, পাহাড়ি রাস্তার ধারে, পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের লুকোচুরির খেলা। এই সব কিছু মিলে মনে নেশা ধরিয়ে দিবে। রুমা থেকে কেওক্রাডং যাওয়ার পথে মাঝে মুনলাই বম পাড়া নামে একটি সুন্দর গ্রাম রয়েছে। এই সড়কে বগালেকের পরে দার্জিলিং পাড়া নামে আরোএকটি বম নৃ গোষ্ঠীদের গ্রাম আছে যেটি দেখার মত সুন্দর। অনেক পর্যটকই যাত্রা বিরতি দিয়ে এই অপূর্ব গ্রামটিতে বিশ্রাম নেন।

৯। জাদিপাই জলপ্রপাত:
কেওক্রাডং পাহাড় থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটারের পথ জাদিপাই জলপ্রপাত। তিন হাজার ৬৫ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বান্দরবানের সর্বোচ্চ গ্রাম পাশিংপাড়া অতিক্রম করে জাদিপাইপাড়ার পথে উঠে গেছে খাড়া রাস্তা। পাশিংপাড়ার উপর থেকে জাদিপাই পাড়ার দিকে তাকালে মনে হবে সবুজের কোলে ঘুমিয়ে থাকা ছোট্ট গ্রাম। বর্ষায় এই রাস্তাটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। তাই বর্ষা-পরবর্তী মৌসুমে এখানে বেড়াতে আসাটা উত্তম। জাদিপাই ঝর্ণায় যেতে হলে যেতে হবে বান্দরবানের রুমা উপজেলা থেকে বগালেকে এবং তারপর কেওক্রাডং পাহাড়ের চূড়ায়। কেওক্রাডং পাহাড় থেকে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের দূরত্বে থাকা পাশিংপাড়ার খাড়া পথ ধরে ৪০ মিনিট হাঁটলেই জাদিপাই জলপ্রপাত পৌঁছানো যায়।

১০। নাফাখুম:
নাফাখুমের খুমের মানে হচ্ছে জলপ্রপাত আর এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাতগুলোর একটি। স্থানীয় লোকজন এটিকে রেমাক্রি জলপ্রপাত বলে থাকে। এখানে একবার ভ্রমণ করলে ভ্রমণকারীরা বারবার আসতে চায়। লোকেরা একে বাংলাদেশের নায়াগ্রা জলপ্রপাত বলে ব্যাখ্যা করে। সাঙ্গু নদী থেকে নৌকা নিয়ে রেমোক্রি হয়ে নাফাখুমে যেতে হয়। এই যাত্রা পথে তিন্দু, রাজাপাথর এবং পদ্মঝিরিও দেখে নেয়া যায়। বর্ষাকালে নদীতে পানির প্রবাহের অনেক চাপ থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাফাখুম যাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়া যায় না। অন্যদিকে শীতের মৌসুমে পানির স্তর অনেক নিচে থাকায় নৌকা নিয়ে যাওয়া যায় না। তদনুসারে, নাফাখুম ভ্রমণের সর্বোত্তম সময় বর্ষাকালের পরে এবং শীত মৌসুম শুরু হওয়ার আগে।

ঢাকা থেকে বান্দরবানের দর্শনীয় স্থানগুলোতে যাওয়ার উপায়:

প্রথমেই বান্দরবান যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে সরাসরি শুধু মাত্র বাস আছে। তবে চট্টগ্রামে সরাসরি যাওয়ার ক্ষেত্রে বিমান, ট্রেন, বাস, তিনটির যে কোনটি ব্যবহার করা যেতে পারে। অতঃপর চট্টগ্রাম থেকে লোকাল বাসে করে বান্দরবান।

এছাড়া, দর্শনীয় জায়গাগুলো ভ্রমণের জন্য আছে লোকাল বাস, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, জিপ এবং চান্দের গাড়ি। তিন জনের টিম হলে সাধারণত সবাই বড় গ্রুপগুলোর সঙ্গে এক সাথে হয়ে চান্দের গাড়িতে ভ্রমণ করে। এই গাড়িগুলো সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পাওয়া যায়। এই জায়গাগুলো ভ্রমণের একটি প্রয়োজনীয় ব্যাপার হচ্ছে- এই জায়গাগুলোতে গাইড অবশ্যই নিতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিদেশি পর্যটকদের জেলা বা উপজেলা প্রশাসন থেকে ভ্রমণের অনুমতি নিতে হয়। গাইডরা ভ্রমণের যানবাহন ঠিক করা থেকে শুরু করে এই অনুমতি নেয়ার যাবতীয় কাজ সমাধান করে দেয়।

এছাড়াও বান্দরবানের সেরা এই ১০টি দর্শনীয় স্থানসমূহ ভ্রমণে যে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে সেটি হচ্ছে- সেনাবাহিনীর চেকপোষ্টে চেকিংয়ের সুবিধার্থে সঙ্গে সব ধরনের পরিচয়পত্র থাকা বাঞ্ছনীয়। গাইড নেয়ার সময় অবশ্যই সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত গাইড সমিতি থেকে গাইড ভাড়া করা উচিত। বিকাল ৪টার পর আর্মি ক্যাম্প থেকে আর অনুমতি মেলে না। একই সঙ্গে যানবাহন পাওয়ারও কোনো উপায় থাকে না। তাই পুরো যাত্রাটি অনেক সতর্কতার সঙ্গে পরিকল্পনা করা উচিত। বর্ষাকালে বান্দরবানকে অধিক সুন্দর দেখালেও এই সময় জায়গাগুলোর বিপজ্জনক অবস্থার কথাও মাথায় রাখতে হবে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ঘুতে আসা পর্যটকদের।

সূত্র: যুগান্তর

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন