বিদ্রোহীদের কাছে হেরে যাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী

fec-image

হেরে যাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ‘মিলিট্যান্ট’ বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছ থেকে ভয়াবহতার মুখোমুখি তারা। অনলাইন বিবিসিতে সাংবাদিক জোনাথন হেড-এর লেখা খবরের শিরোনাম এমনই। ওই রিপোর্টে তিনি লিখেছেন, একজন বৌদ্ধভিক্ষু পাউক কো তাওয়ার চমকপ্রদ পরামর্শ শুনতে মিয়ানমারের পাহাড়ি শহর পাইন ওও লুইনের ছোট্ট একটি স্কয়ারে গত মঙ্গলবার জমায়েত হয়েছিল কয়েক শত মানুষ। ওই শহরে এই বৌদ্ধভিক্ষু ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। সমাবেশে তিনি বললেন, দেশের সামরিক জান্তা মিন অং হ্লাইংয়ের উচিত পদ থেকে সরে যাওয়া এবং তার ডেপুটি জেনারেল শয়ে উইনের উচিত ক্ষমতায় যাওয়া।

গণতান্ত্রিক উপায়ে মিয়ানমারে নির্বাচিত হয়ে সরকার চালাচ্ছিলেন অং সান সুচি। কিন্তু নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক জান্তা মিন অং হ্লাইং। এর ফলে দেশে ভয়াবহ এক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এতে আন্তর্জাতিক তীব্র চাপে পড়ে মিয়ানমার। নানা দিক থেকে নিষেধাজ্ঞা আসতে থাকে।

এমনকি সামরিক জান্তার এমন ভূমিকার কড়া সমালোচনা ওঠে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পক্ষ থেকেও। ভিক্ষু পাউক কো তাওয়া হলেন বৌদ্ধ ধর্মের উগ্র-জাতীয়তাবাদের একজন নেতা। তারা সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত সামরিক জান্তাকে সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জাতিগত বিদ্রোহীদের হাতে ধারাবাহিকভাবে পরাজিত হচ্ছে সামরিক জান্তা। ফলে মিন অং হ্লাইংয়ের এক সময়কার এসব ‘চিয়ারলিডার’রা তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা শুরু করেন। পাউক কো তাওয়া জনতার উদ্দেশে বলেন, জেনারেল শয়ে উইনের মুখের দিকে তাকান। তার মুখটা একজন প্রকৃত সেনার। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠতে পারছেন না মিন অং হ্লাইং। তার উচিত বেসামরিক ভূমিকায় চলে যাওয়া।
সামরিক বাহিনীতে পাউক কো তাওয়ার কি রকম সমর্থন আছে তা পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। তবে সামরিক জান্তার অন্য যেসব সমর্থক আছে, তাদের কণ্ঠের সঙ্গে তার কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তারা দেখতে পারছে তাদের বিরোধীদের সঙ্গে লড়াইয়ে সক্ষমতা দেখাতে পারছে না সামরিক নেতারা। এতে হতাশা শুধু বাড়ছেই। এমন সময়ে পাইন ওও লুইনে দেয়া পাউক কো তাওয়ার ভাষণ আরও হতাশা বাড়াবে। এক সময়কার বৃটিশ ঔপনিবেশ এখন অভিজাত ডিফেন্স সার্ভিস একাডেমি। এখানে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় প্রশিক্ষিত। তারা যে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে তা অনুধাবন করতে পারছে না।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা নতুন কিছু নয়। ভিক্ষুদের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার দীর্ঘ রীতি আছে। এমনকি কখনো কখনো তারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও সক্রিয় হন। ২০২১ সালে যখন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, তখন অনেকেই এর বিরোধিতা করেন। তাদের প্রচলিত পোশাক ছেড়ে জান্তার বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নেন। কিন্তু তাদের কিছু কিছু রয়ে যান। তারা জেনারেলদের সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। তাদের সঙ্গে অভিন্ন বিশ্বাস স্থাপন করেন যে, বাইরের প্রভাব থেকে বৌদ্ধ মতবাদ এবং মিয়ানমারের সংস্কৃতিকে রক্ষা করা প্রয়োজন। ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে স্থানীয় বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ হয়।

এরপর উইরাথু নামে একজন ভিক্ষু ‘মা বা থা’ বা এসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন নামে আন্দোলন গড়ে তুলতে সহায়তা করেন। এর ফলে মুসলিমদের মালিকানাধীন বাণিজ্য বর্জনে উৎসাহিত করে। দাবি করা হয়, মুসলিমদের কারণে মিয়ানমারে বৌদ্ধইজম ঝুঁকিতে। কিন্তু এই মুসলিমরা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীর মধ্যে শতকরা মাত্র ৮ ভাগ। অবশেষে ২০১৭ সালে ওই ‘মা বা থা’ আন্দোলন নিষিদ্ধ করা হয়। তা সত্ত্বেও তাদের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী সমর্থন পেতেই থাকে। উউরাথুকে জাতিগত সংঘাতে উস্কানি দেয়ার কারণে এর আগে জেল দেয়া হয়েছিল। ২০২০ সালে তাকে আবার জেল দেয়া হয়েছে। কিন্তু এক বছরের কম সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনী তাকে মুক্ত করে দিয়েছে। তাকে সম্মান ও অর্থ সহায়তা দিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছেন মিন অং হ্লাইং।

মিন অং হ্লাইংয়ের ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের ফলে দেশটিতে ব্যাপক জনরোষ দেখা দেয়। গণতান্ত্রিক শাসনের দাবিতে দেশজুড়ে বিশাল প্রতিবাদ র‌্যালি হতে থাকে। কিন্তু তাদেরকে বর্বরভাবে দমন করেছে সামরিক জান্তা। তখন থেকেই নিজেকে বৌদ্ধ মতবাদের একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখানোর মাধ্যমে ৬৭ বছর বয়সী জেনারেল মিন অং হ্লাইং তার বৈধতাকে পোক্ত করছেন। রাষ্ট্রীয় মিডিয়ায় এমন সব রিপোর্টে সয়লাব, যেখানে দেখানো হচ্ছে যে- তিনি বিভিন্ন উপসনালয়ে বিলাসবহুল উপহার সামগ্রী দান করছেন। সিনিয়রদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিচ্ছেন।

রাজধানী ন্যাপিড’তে পাথরে তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মূর্তি স্থাপনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে দেখা যায় তাকে। এতেও অর্থ সহায়তা দিচ্ছে সামরিক প্রশাসন।

মিয়ানমারে সর্বোচ্চ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বুদ্ধিস্ট কাউন্সিল বা স্টেট সংঘ সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেনি বললেই চলে। তাদের কিছু কিছু সদস্য জেনারেলদেরকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন নীরবে। কিন্তু সংঘের অন্যতম একজন সিনিয়র ভিক্ষু সিতাগু সায়াদাওয়া প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেন। এমনকি তিনি মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে অস্ত্র কেনার জন্য রাশিয়া সফর করেন। অন্য ভিক্ষুরা আরও দূরে গিয়েছেন। উইরাথু’র একজন অনুসারী ওয়াথাওয়া সাগাইং রাজ্যে সশস্ত্র মিলিশিয়া গ্রুপ সৃষ্টিতে সহায়তা করেন।

পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের স্বেচ্ছাসেবকদের চ্যালেঞ্জ জানাতে এটা করেন। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই গ্রুপ ছড়িয়ে পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা স্থানীয় লোকজনকে জোর করে তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য করছে। বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে বহুবিধ নৃশংসতা ঘটাচ্ছে। তবে তারা অল্প কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেদের শিকড় গাড়তে পেরেছে। তার দলের একজন বলেছেন, তিনি প্রতিটি গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ জনকে রিক্রুট করতে পেরেছেন। এটা করা হয়েছে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে। তিনি আরও বলেছেন, যাদেরকে দলে নেয়া হয়েছিল তার অনেকেই পালিয়ে গেছে। তারা গ্রামের লোকজনকে পালাতে সহায়তা করেছে।
সম্প্রতি জাতিগত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যেভাবে লজ্জাজনকভাবে হেরে যাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাতে এর সমর্থকদের মনে সন্দেহের বীজ বপন করেছে। প্রথম সারির একজন ব্লগার বলেছেন, মিন অং হ্লাইং অযোগ্য হয়ে পড়েছেন। তার অধীনে দেশ পরাজিত হচ্ছে। ইতিহাসে লজ্জাজনক অবস্থায় পড়েছে দেশ। এর মূল্য তার দেয়া উচিত। তার উচিত পদত্যাগ করা।

ব্রাদারহুড এলায়েন্সের বিদ্রোহীরা উত্তরের শান রাজ্যের বিশাল এলাকা তাদের দখলে নিয়েছে। এরপর তারা সেসব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। গত বছর অক্টোবরে এসব বিদ্রোহী তাদের অভিযান শুরু করেছে। এতে তারা কয়েক হাজার সেনাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে। তাদের সব অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করেছে। এই লড়াই তীব্র হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এতে সামরিক জান্তা ভেঙে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন