ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫ লাখ টাকায় ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ দ. কোরিয়ার পতাকা

fec-image

বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। ফুটবলপ্রেমীরা পছন্দের দল ও দেশের পতাকা নিয়ে কত কিছুই না করে থাকেন। ফুটবল নিয়ে এমন একটি আবেগ আর উন্মাদনার ঘটনা ঘটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে।

তবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার নয়, তিনি তাক লাগিয়েছেন বিশ্ব ফুটবলে প্রায় অখ্যাত দক্ষিণ কোরিয়ার চার কিলোমিটার পতাকা টানিয়ে।

স্ত্রীর ব্যাংকে জমানো টাকা এবং শখের আম বাগান বিক্রি করে এই পতাকা তৈরি করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার দক্ষিণ কোরিয়াফেরত যুবক আবু কাউছার মিন্টু।

নিজের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকাজুড়ে পতাকা তৈরি করে পুরো এলাকায় তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। মিন্টুর এই কাজে সহযোগী হয়েছেন তার স্ত্রীও। দেশটির প্রতি তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এই কাজ করেছেন বলে জানান মিন্টু। তার এমন কাজে এলাকাবাসীসহ স্বজনেরা উৎসাহিত করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জীবিকার তাগিতে ১৯৯৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাড়ি জমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার দরিকান্দি ইউনিয়নের খাল্লা গ্রামের বাসিন্দা আবু কাউছার মিন্টু। ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপটি তিনি গ্যালারিতে বসেই দেখেন। সে সময় দক্ষিণ কোরিয়ার এক ফুটবলারের নৈপুণ্য দেখে মুগ্ধ হন। এরপর থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবলের ভক্ত হয়ে যান তিনি। পরে ২০১৩ সালে দেশে ফেরেন। গাজীপুরে ব্যবসা শুরু করেন। তবে প্রবাস থেকে ফিরলেও দক্ষিণ কোরিয়া দলের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা কমেনি।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের সময় রাজধানীর বিমানবন্দরের ওভারব্রিজ এলাকায় দেশটির একহাজার মিটার দৈর্ঘ্যের পতাকা টানিয়ে ছিলেন। কিন্তু পূর্বের সেই পতাকা নিয়ে নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাই ২০২২ বিশ্বকাপের আসর শুরুর আগেই নিজের বাড়ি থেকে পাশের ইউনিয়ন তেজখালি পশ্চিম পাড়া পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার পতাকা তৈরির পরিকল্পনা করেন। তার স্ত্রী সাবরিনাও একই দলের সমর্থক। তারা গত বিশ্বকাপের পর থেকে অর্থ সঞ্চয়ের চিন্তা করেন। পরে দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা যুক্ত আটটি মাটির ব্যাংকে টাকা জমানো শুরু করেন সাবরিনা।

সেখানে জমা হয় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। অন্যদিকে, কাউছার তার একটি আম বাগান বিক্রি করেন। সেখান থেকে আরও তিন লাখ ২০ হাজার টাকা যুক্ত করে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে তৈরি করেন দীর্ঘ এই পতাকা। শুধু তাই নয়, তাদের ব্যবহৃত পানি ও চা-পান করার কাপ প্লেটেও দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকার ছবি রয়েছে।

রত্না বেগম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, মিন্টু ভাই কোরিয়া থেকে আসার পর থেকেই সেই দেশের প্রতি তার টান বেড়ে যায়। এরপর থেকে কোরিয়ার জন্য কিছু করার চেষ্টা করছিলেন তিনি। এর অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে তিনি মাটির ব্যাংকে টাকা জমানো শুরু করেন। পৈতৃকভাবে পাওয়া নিজের শখের আম বাগানটি বিক্রি করেন। এবার পুরো এলাকায় প্রায় পৌনে চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোরিয়ার পতাকা টানান। আমরাও তাকে উৎসাহ দিচ্ছি। আমরা চাই, কোরিয়া এবারের বিশ্বকাপে ভালো ফলাফল করুক।

হাসিবুল আলম নামে এলাকার এক যুবক বলেন, তিনি (কাউছার) অনেক দিন ধরেই বলছিলেন, কোরিয়ার জন্য নজিরবিহীন একটি পতাকা বানাবেন। কারণ তিনি দীর্ঘদিন দেশটিতে ছিলেন। সে দেশের প্রতি তার আলাদা টান ও ভালোবাসা আছে। এরপর থেকেই পতাকা বানানোর জন্য টাকা জমাতে থাকেন। আজকে সেই নিজের বাড়ি খাল্লা থেকে পাশের ইউনিয়ন তেজখালি পশ্চিম পাড়া পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার এলাকায় পতাকা লাগিয়েছেন। মিন্টু ভাই, কোরিয়ার একজন বিরাট সাপোর্টার। আমরাও চাই তার মনের আশা যেন পূরণ হয়।

সাবরিনা বলেন, মিন্টু যখন কোরিয়া থেকে দেশে এসেছিল, তখন দেশটি সম্পর্কে আমাদেরকে অনেক কিছুই বলতো। এরপর থেকে কোরিয়াকে আমারও ভালো লাগে। সেই ভালো লাগা থেকেই এই পতাকা বানানো হয়েছে। পতাকাটি বানানোর জন্যে আমি মাটির ব্যাংকে টাকা জমানো শুরু করি। সেখান থেকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। এই টাকায় যখন কিছু হচ্ছিল না। তখন আম বাগানটি বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে পাওয়া টাকা খরচ করে এই পতাকা তৈরি করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, অনেক আগেই একবার আমাকে কোরিয়া নেওয়ার কথা বলেছিল। তবে নানা কারণে সেটি আর সম্ভব হয়নি। আমারও স্বপ্ন আছে, দেশটিকে নিজ চোখে একবার দেখার। এ ছাড়া কয়েকদিন পর ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হবে। সে জন্য কোরিয়ার প্রতি ভালোবাসা থেকেই এই পতাকা লাগানো হয়েছে।

কাউছার বলেন, আমি ১৯৯৮ সালে প্রথম কোরিয়া গিয়েছিলাম। ২০০২ সালে সেখানে আমি ফুটবল বিশ্বকাপ দেখেছিলাম। সে এক ফুটবলার খুব ভালো খেলতেন। সেখান থেকে আমি কোরিয়ার অনেক বড় ভক্ত। পরে ২০০৩ সালে দেশে এসে বিয়ে করে আবারও কোরিয়া যাই। ২০১৩ সাল পর্যন্ত আমি সেখানেই অবস্থান করে দেশে ফিরে আসি। পরে ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে রাজধানীর বিমানবন্দর ওভারব্রিজ এলাকায় একহাজার মিটার দৈর্ঘ্যের দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা লাগিয়েছিলাম। এরপরে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের পর আমার স্ত্রী বলেছিল, কোরিয়ার জন্য আমরা কিছু করতে পারি কি-না। এরপরে স্ত্রী মাটির ব্যাংকে অল্প অল্প করে টাকা জমানো শুরু করে।

তিনি আরও বলেন, সেখান থেকে পাওয়া এক লাখ ৮০ হাজার টাকা আমাকে দেয়। আমি বাজারের পাশে আমার একটি আম বাগান বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করে এই পতাকাটি বানিয়েছি। মূলত সেই দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এই কাজ করেছি। সে দেশের মানুষগুলো খুবই ভালো। এখন আমার চাওয়া তারা আমার দেশ বাংলাদেশকে আরও ভালো জানুক ও চিনুক। প্রত্যাশা করি, এবারের বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়া অনেক ভালো খেলবে এবং এবারের বিশ্বকাপ দলটি জিতবে।

তবে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বলেন, বাংলাদেশের মানুষ খুবই আবেগি। সেই আবেগ বিশ্বকাপের আগে বিভিন্ন জায়গাতেই দেখা যায়। অতিরিক্ত আবেগ থেকেই তিনি এমনটা করেছেন বলে মনে হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে কিছু বলার বা করার নেই। এবার শহরের বিভিন্ন স্থানে বড় পর্দায় বিশ্বকাপের খেলা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে।’’’

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন