ভারী বৃষ্টিপাত হলেই পাহাড় ধসের আশংকা কক্সবাজারে

কক্সবাজার প্রতিনিধি:

কক্সবাজারে ভারী বৃষ্টিপাত হলেই ভয়াবহ পাহাড় ধসের আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কক্সবাজারের বিভিন্ন পাহাড়ে যেভাবে অবৈধ বসবাসকারীর সংখ্যা বেড়েছে এতে সকলকেই সতর্ক থাকতে হবে না হয় ভয়াবহ বিপর্যয় আসতে পারে।

শনিবার (৯ জুন) থেকে টানা ভারীবৃষ্টিতে অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে। এ কারণে ঈদের কেনাকেটায় কোন মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারেনি। ব্যবসায়ীরা অনেকটা অলস সময় পার করছেন। তবে এ ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ পাহাড় ধস ও সাধারণ মানুষের মাঝে দুর্ভোগ নেমে আসবে। অপরদিকে পাহাড় ধসে প্রাণ হারাবে অসখ্য মানুষ।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সংখ্যা আরও বেড়েছে।

কক্সবাজারের সচেতনমহল জানিয়েছেন, কক্সবাজার ভুমিকম্প ঝুঁকি প্রবণ এলাকা। পাহাড়ে বসতি গড়তে পাহাড় কাটতে হয়। পাহাড় ধস হবে এমন চিন্তা না করেই তারা বসতি গড়ে তুলেন। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে যেভাবে কক্সবাজারের বিভিন্ন পাহাড়ে বসতি স্থাপন করা হয়েছে তা চরমভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

অধ্যাপক জাফর আলম বলেন, বিগত সময়ে কক্সবাজারে অনেকবার পাহাড় ধস হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যথা সময়ে বৃষ্টি হচ্ছে না। অসময়ে বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসের ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়াও ভারী বৃষ্টি ও একই সাথে ৬ মাত্রার ভুমিকম্প হলেই বড় ধরণের পাহাড় ধস হতে পারে। তাই আগে ভাগেই ঝুঁকিতে বসবাসরতদের সরিয়ে আনা প্রয়োজন।

কক্সবাজারের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট রমিজ আহমদ জানান, কোন বাধা ছাড়াই পাহাড়ে বসতি গড়তে পারাই দিনদিন ঝুঁকিপূর্ণ বসতবাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। কক্সবাজারের পাহাড় দেখা গেলেও কোন গাছপালা দেখা যায় না। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই বসতবাড়ি। এভাবে অবৈধ বসতবাড়ি গড়ে তুললেও কোন বাধা আসছে না প্রশাসন থেকে। অনেকেই পাহাড় দখল করে ব্যবসায় নেমেছে। প্লট বানিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে পাহাড়ি জমি। প্রভাবশালীদের দৃষ্টি এখন পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ে যে বসতবাড়ি রয়েছে তার অধিকাংশই পাহারাদাররা বসবাস করে। মালিক পরিবর্তন হলে পাহারাদারও পরিবর্তন হয়। অনেক বসতবাড়ি সন্ত্রাসিদের আস্তানা হিসাবে ব্যবহার হয়ে থাকে।

শহরের বৈদ্যঘোনা এলাকার আরফাত বলেন, ‘আমরা সবাই জানি পাহাড় সরকারী খাস জমি। কিন্তু খাস জমি যে যুগ যুগ ধরে শক্তিশালী গোষ্ঠি দখল করে বেচা বিক্রি করছে তখন প্রশাসন কোথায় ছিল? প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল পাহাড়ে ঘর বাধার আগেই তা নজরে আনা। এখানে ১ গন্ডা জমি ৪/৫ লাখ টাকাও কিনে মানুষ বসবাস করছে।
এখন তার ক্ষতিপূরণ বা তাদের জীবনের মূল্য কে দেবে। আমরা দরকার হলে জীবন দেব তবুও পাহাড়ের জমি ছেড়ে কোথাও যাব না।’

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, প্রতিবছর কক্সবাজারে পাহাড় ধসে নিহতের ঘটনা ঘটে। পরে নামেমাত্র অভিযান চালিয়ে গুটিকয়েক পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হয়।
কক্সবাজারে প্রায় ৩ লাখ মানুষ রয়েছে পাহাড় ধসের চরম ঝুঁকিতে।

২০১০ সালের ১৫ জুন ভোরে টানা বৃষ্টির কারণে জেলাব্যাপি ব্যাপক জলাবদ্ধতার পাশাপাশি ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এতে রামু উপজেলার হিমছড়ি এলাকার ১৭ ইসিবি সেনা ক্যাম্পের ৬ জন সেনা সদস্যসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে মারা যায় প্রায় ৬২ জন। ২০১৩ সালের ৪ ও ৬ জুলাই টেকনাফে ফকিরামুরা ও টুইন্যার পাহাড় ধসে একই পরিবারের চারজনসহ ১৩ জনের মৃত্যু হয়।

২০১২ সালে ২৬ ও ২৭ জুন পাহাড় ধসের ঘটনায় মারা গেছেন ২৯ জন। একই ভাবে ২০০৯ ও ২০০৮ সালেও পাহাড় ধসে মারা যায় প্রায় ১৯ জন লোক। এছাড়া গেল বছর শহরের লাইটহাউস এলাকায় পাহাড় ধসে মারা গেছে ২ জন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের ঘোনারপাড়া, মোহাজের পাড়া, বৈদ্যঘোনা, বইল্যাপাড়া, জাদিপাহাড়, খাজামঞ্জিল এলাকা, বাদশাঘোনা, ফাতেরঘোনা, ইসলামপুর, হালিমা পাড়া, লাইট হাউস পাড়া, সার্কিট হাউজ সংলগ্ন এলাকা, আবু উকিলের ঘোনা, রহমানিয়া মাদ্রাসা এলাকা, পাহাড়তলী, বাঁচামিয়ারঘোনা, হাশেমিয়া মাদ্রাসার পেছনে, সাহিত্যিকা পল্লী, বিডিআর ক্যাম্পের পিছনে, লারপাড়া, সদর উপজেলা কার্যালয়ের পিছনে, পাওয়ার হাউস, লিংকরোড, কলাতলী বাইপাস সড়কের দুই পাশের বিশাল পাহাড়ী এলাকা, হিমছড়িসহ জেলা শহরের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে।

কক্সবাজার সদরের পিএমখালী ইউনিয়নের তোতকখালী, মাঝেরপাড়া, কাওয়ারপাড়া, ছয় ভাইয়েরপাড়া, জুমছড়ি, পাতলী, মাছুয়াখালী, ধাউনখালী, পুতিরমারঢালা, চেরাংঘর, উসমানেরঢালা, পরানিয়াপাড়া, পুরাকাটা, সিকদারঘোনা, টাইমাঝিরঘোনা, কাঠালিয়ামোরা, সিকদারপাড়া, ঘাটকুলিয়াপাড়া, টাইমোহাম্মদের ঘোনা, সাতঘরিয়াপাড়া, ছনখোলা, নয়াপাড়া, মালিপাড়া, পশ্চিমপাড়া, মাদলিয়াপাড়াসহ ২৯টি এলাকার ৩৭টি পাহাড় নিধন চলছে প্রকাশ্যে।

টেকনাফ, রামু, সদর উপজেলা, চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে গড়ে তুলেছে অবৈধ বসতি। এসব বসতি রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।

কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র মাহবুবুর রহমান বলেন, মূলত কেউ পাহাড়ে শুরুতে ছোট ঘর তৈরি করে। পরে আস্তে আস্তে পাহাড় কেটে সব জমি নিজেদের দাবী করে। আমি সব সময় বলি পাহাড় কাটা বন্ধ হলে শহরের অর্ধেক সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। আর সরকার মানুষের উপকারের জন্য কাজ করছে এটা মানুষের বুঝা উচিত।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, মানবিকতা এক জিনিস। জীবনের নিরাপত্তা সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে। আবেগ দিয়ে নয়, বাস্তবতা বুঝা উচিত। সহায়-সম্পদ, ঘর-বাড়ি মানুষ চাইলে আবার অর্জন করতে পারবে। কিন্তু জীবন চলে গেলে তা আবার আসবে না। তার জন্য সারা জীবন কান্না করতে হবে।

তিনি বলেন, সরকারী জমিতে বসবাস অপরাধ। সে অর্থে জেলা প্রশাসন তার দায়িত্ব পালন করছে। কক্সবাজারের পাহাড়ে ঝুকিপূর্ণ বসাবাসকারীদের উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে পৌর শহরের সকল ওয়ার্ডে ঝুকিপূর্ণ বসতবাড়ি উচ্ছেদ ও সতর্ক করতে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন