মাটিরাঙা মিফতাহুল জান্নাহ মহিলা মাদ্রাসায় ছাত্রীদের উপর যৌন নিপীড়নসহ অনিয়মের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি/মাটিরাঙা:
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা উপজেলার পলাশপুর মিফতাহুল জান্নাহ মহিলা মাদ্রাসা ও এতিমখানায় ছাত্রীদের উপর যৌন নিপীড়নসহ নানা সীমাহীন দূর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আর এ সব অভিযোগ মাদ্রাসার পরিচালক মো: আব্দুল হাই ও শ্যালক শিক্ষক ক্বারী মো. আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে।

ছাত্রীদের যৌন নীপিড়নের কথা স্বীকার করায় শিক্ষক ক্বারী মো. আব্দুল খালেককে মাদ্রাসা থেকে বিদায় করে দেয়া হলেও আইনানুগ কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তার বিরুদ্ধে। বরং প্রতিবাদ করতে গিয়ে একজন শিক্ষক হয়েছেন চাকুরিচ্যুত ও শিক্ষার্থীরা হয়েছে মাদ্রাসা ছাড়া।

ফলে জনগণের অর্থে পরিচালিত এ পলাশপুর মিফতাহুল জান্নাহ মহিলা মাদ্রাসা ও এতিমখানাটির ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

পলাশপুর বিজিবি জোনের সহযোগিতায় ২০১০ সালে ৯১ শতক জমির উপর পলাশপুর মিফতাহুল জান্নাহ মহিলা মাদ্রাসা ও এতিমখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এক সময় বিজিবি তত্ত্বাবধানে এটি পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে স্থানীয়দের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। সে সুবাদে মো. আব্দুল হাই পুরো মাদ্রাসা ও এতিমখানাটিকে নিজের কজ্বায় নিয়ে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। শুরু হয় নানা দূর্নীতি-অনিয়ম।

অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, মাদ্রাসার পরিচালক আব্দুল হাইয়ের শ্যালক ক্বারী মো. আব্দুল খালেক ২০১৫ সালে মাদ্রাসায় যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন সময় তিনি শিক্ষার্থীদের অশ্লীল ছবি প্রদর্শন, ছাত্রীদের গায়ে হাত দেওয়াসহ নানাভাবে যৌন নিপীড়ন চালিয়ে আসছিল।

তিনি মাদ্রাসার পরিচালক মো: আব্দুল হাইয়ের শ্যালক হওয়ায় কেউ ভয়ে এসবের প্রতিবাদ করতো না। আর যারা প্রতিবাদ করেছেন তাদের মাদ্রাসা ছাড়তে হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, আবাসিক শিক্ষার্থীদের খাবারসহ অন্যান্য সব কিছু ঠিক মতো দেয়া হয় না। নূরানী, হেফজ, নাজারা ও কোরআন বিভাগের ১১ জন শিক্ষকের মধ্যে ৮ জনই পরিচালক মো. আব্দুল হাইয়ের স্ত্রী, ছেলে, ছেলে বউ, শ্যালক ও শ্যালকের স্ত্রীর নিকট আত্মীয়।

মাদ্রাসার ১৯৩ শিক্ষার্থী থেকে প্রাপ্ত ফি’র টাকাও বেহাত করার অভিযোগ রয়েছে পরিচালকের বিরুদ্ধে। এসব অর্থ দিয়ে পলাশপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় জায়গা জমি ক্রয় করেছেন মাদ্রাসার পরিচালক আব্দুল হাই।

ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের কথাটি জানাজানি হওয়ার পর গত ১৩ জুলাই সামাজিকভাবে মীমাংসার জন্য ছাত্রীদের অভিভাবক ও অভিযুক্ত শিক্ষকের উপস্থিতিতে সালিশ করেন স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর মোস্তফা, মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি দেলু মিয়া ও পরিচালক মো: আব্দুল হাইসহ স্থানীয়রা।

সালিশে অভিযুক্ত শিক্ষক মো: আব্দুল খালেক অভিযোগ অস্বীকার করায় তাকে মাদ্রাসা থেকে বাদ দেয়া হয়। সালিশ শেষে মাটিরাঙায় থানায় তাকে সোপর্দ করা হলেও পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয় বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী অভিভাবক ও সালিশে উপস্থিতরা।

যৌন নীপিড়নের শিকার ছাত্রীদের মধ্যে দু’জন মাদ্রাসা ছেড়ে গেলেও এতিম একজন ছাত্রীকে এখনো থাকতে হচ্ছে মাদ্রাসায়। নিপীড়নের শিকার এক ছাত্রী জানান, ক্বারী আব্দুল খালেক প্রায় তাকে কোলে নিয়ে চুমু দিত।

মা বাবাকে বিষয়টি জানানোর পর আমাকে ওই মাদ্রাসা থেকে অন্যত্র ভর্তি করেছেন। হুজুর ক্লাসের অনেক মেয়েকে কোলে বসিয়ে চুমু দিত।

খেদাছড়া এলাকার বাসিন্দা মো: জাফর জানান, মাদ্রাসার পরিচালক মো: আব্দুল হাই সকল নষ্টের মূল। বিভিন্ন অপকর্মের দায়ে তাকে বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। পলাশপুরে মাদ্রাসা করার আগে তিনি মানিকছড়ির তিনটহরী এলাকায় আরেকটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। সেখানে এতিম এক মেয়েকে বিয়ে করে তাকে ছেড়ে দেয়ায় এবং মাদ্রাসার অর্থ লুপাট করায় তাকে সেখান থেকে বিদায় করে দেয়া হয়।

এর আগে তিনি রামগড়ের বড় পিলাক ও পানছড়িতে শিক্ষকতা করেছেন। পানছড়িতে তার নামে গুচ্ছগ্রামের একটি রেশন কার্ডও রয়েছে। পলাশপুরে আসার পর সে তার পরিবারের সদস্যদের শিক্ষক সাজিয়ে শিক্ষার্থী যোগাড় করছে। আর তার শ্যালক সহ অন্যান্য আত্মীয়রা মাদ্রাসায় নানা অপকর্ম করছে।

নাম না প্রকাশের অনুরোধে এক অভিভাবক জানান, শিক্ষক আব্দুল খালেক তার মেয়েকে কোলে বসিয়ে প্রায় চুমু দিত বলে বাসায় এসে বলত। এ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দিতাম না। ঈদে তার আরেক সহপাঠীর কাছ থেকে কথাটি জানতে পারি। পরে বিষয়টি মাদ্রাসার সভাপতি দেলু মিয়াকে জানালে তিনিও আমাকে হেয় করেন।

লোক জানাজানি হওয়ার পর সালিশের মাধ্যমে ওই হুজুরকে বিদায় করা হয়। বিদায় করা হলেও তাকে যথাযথ শাস্তি দেয়া প্রয়োজন।

আরেক অভিভাবক জানান, আমাদের মেয়েরা বাড়ি থেকে গিয়ে পড়ালেখা করত। তাদের সাথে এমন আচরণ করা হতো। আর যারা সেখানে আবাসিক রয়েছে তাদের দেখভাল করা অন্তত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।

অনিয়মের প্রতিবাদ করায় চাকরীচ্যুত শিক্ষক নুরুজ্জামান জানান, মাদ্রাসার ১১ শিক্ষকের মধ্যে ৮ জনই পরিচালকের স্ত্রী, মেয়ে, জামাতা, শ্যালক ও অন্যান্য নিকট আত্মীয়। শিক্ষকতা করার মতো ন্যূনতম যোগ্যতাও নেই তাদের।

কিন্তু পরিচালক ও সভাপতি মিলে তাদের শিক্ষক স্বীকৃতি দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ফি ও বিত্তশালীদের দেওয়া দান নিজেরা মিলে ভাগ ভাটোয়ারা করছেন। পরিচালক বিভিন্ন এলাকায় জায়গা কিনছেন। তার শ্যালক আব্দুল খালেক ছাত্রীদের বিভিন্ন সময় উত্ত্যক্ত করত। এসবের প্রতিবাদ করায় আমাকে বিদায় করে দেয়া হয়।

সালিশে উপস্থিত থাকা বাদশা মিয়া জানান, চুমু দেয়াসহ বিভিন্ন সময় ছাত্রীদের গায়ে হাত দেয়ার কথা সালিশে হুজুর আব্দুল খালেক স্বীকার করেছেন।

অভিযুক্ত শিক্ষক(হুজুর) ক্বারী আব্দুল হাই অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, ছাত্রীরা ক্লাসে পড়া পারায় তাদের স্নেহ করে চুমু দিতেন। এটি যে অনৈতিক তিনি তা জানতেন না। সালিশের পর তিনি জানতে পারেন তিনি অন্যায় করছেন। তাই তিনি মাফ চেয়ে মাদ্রাসা থেকে বিদায় নিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট এলাকার পৌর কাউন্সিলর আলাউদ্দিন লিটন জানান, পলাশপুর মহিলা মাদ্রাসার বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে শুনেছি। অভিযোগ প্রমাণিতও হয়েছে। টাকা আত্মসাৎ করার জন্য এলাকার কিছু লোক হুজুরদের সাথে জড়িত হয়ে এসব অপকর্মে উৎসাহ দিচ্ছেন।

মাদ্রাসার সভাপতি দেলু মিয়া জানান, মাদ্রাসার কয়েক জন ছাত্রীকে চুমু দেয়ার অপরাধে হুজুর আব্দুল খালেককে অব্যহতি দেয়া হয়েছে। সামাজিক সালিশে তা মীমাংসা হয়েছে। আর্থিক সংকট থাকায় একই পরিচালক তার পরিবারের লোকজনকে দিয়ে মাদ্রাসা পরিচালনা করছেন তাতে কোন সমস্যা তো হচ্ছে না।

মাদ্রাসার পরিচালক মো. আব্দুল হাই বহু বিবাহসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মাদ্রাসায় চাকরীর কথা স্বীকার করে জানান, তার শ্যালক আব্দুল খালেক অন্যায় করায় তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে।

মো: আব্দুল হাই জানান, আমার চেষ্টায় মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আর্থিক হিসেব নিকেশ কাউকে দেয়ার দরকার হয় না। তাই কোন ব্যাংক একাউন্ট খোলাসহ আর্থিক হিসেব রাখা হয় না।

মাটিরাঙা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম জানান, মাদ্রাসার এতিম শিশুদের দিকে তাকিয়ে আমরা সবাই সাধ্যমত আর্থিক সহযোগিতা করি। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই। পরিচালক আব্দুল হাই নিজেই সব কিছু করেন।

মাটিরাঙা থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) সাহাদাত হোসেন টিটু জানান, যেসব ছাত্রীরা যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করছেন, তাদের দেয়া জবানবন্দীতে যৌন নীপিড়নের কোন লক্ষণ পাওয়া না যাওয়ায় ক্বারী মো: আব্দুল খালেককে ওইদিন ছেড়ে দেয়া হয়। এরপরও কেউ যদি থানায় লিখিত অভিযোগ করে তাহলে পুলিশ তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিবে।

অপর একটি সূত্র জানায়, স্থানীয় পৌর কমিশনার লিটনকে পাশ কাটিয়ে প্রতিবেশী পৌর কমিশনার মোস্তফাকে দিয়ে শালিস বসিয়ে মীমাংসার নামে ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, সালিশে অভিযুক্ত শিক্ষক খালেককে কিছুই বলা হয়নি বরং অভিযোগকারীদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ রয়েছে।

সূত্রটি জানায়, অভিযোগ অনেকদিন ধরেই পেয়েই পলাশপুর বিজিবি দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষক ও পর্যালোচনা করে ঘটনার সত্যতা পেয়ে অভিযুক্ত শিক্ষককে মাটিরাংগা থানায় হস্তান্তর করেন। কিন্তু পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়।

পলাশপুর বিজিবি সত্য উদঘাটনের পর অভিযুক্ত শিক্ষককে বহিষ্কার এর নামে শাস্তি থেকে আড়াল করা হয়েছে।

স্থানীয়দের দাবী অভিযুক্ত আ. হাই পরিবার থেকে মাদ্রাসা ও এতিমখানাটি মুক্ত করে বিজিবি জোনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হোক।

১৯৩ জন এতিম ও হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সমাজ ও প্রশাসন এগিয়ে আসবেন এমনি প্রত্যাশা সকলের।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন