মার্কিন প্রতিনিধি দলকে যা বললেন রোহিঙ্গারা

বুধবার (১২ জুলাই) কক্সবাজারের উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গেছেন ঢাকায় সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে দেশটির প্রতিনিধিদল। পরিদর্শনকালে তাদের সাথে মতবিনিময় করেছেন বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। এসময় উজরা জেয়ার কাছে দ্রুত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।

সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের এই কর্মকর্তা রোহিঙ্গারা বর্তমানে কী অবস্থায় আছেন তা জানতে চান। এ সময় ক্যাম্পে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি তাদের প্রত্যাশার কথাও শোনেন। মতবিনিময়কালে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা কার্যক্রম, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, স্বদেশে প্রত্যাবাসন ও ক্যাম্পে বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেন। মতবিনিময়ে অন্তত ২৫ জন রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। বৈঠকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাঁদের ওপর চালানো গণহত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়নের বর্ণনা দেন। পাশাপাশি নিরাপদ, টেকসই ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

বৈঠক শেষে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইমাম বলেন, উজরা জেয়া তাঁদের (শিক্ষক ও ইমাম) কাছে জানতে চেয়েছেন, আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গারা ঠিকমতো ধর্মকর্ম করতে পারছেন কি না? আশ্রয়শিবিরে নিরাপত্তাব্যবস্থা কেমন? জবাবে তাঁরা বলেছেন, আশ্রয়শিবিরে স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম করা গেলেও নিরাপত্তার অভাব খুবই। প্রায় প্রতিদিন খুনখারাবি, অপহরণ, ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। মিয়ানমারের একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর গোলাগুলিতে রোহিঙ্গারা মারা যাচ্ছেন। পুলিশের সঙ্গেও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে।

আরেক রোহিঙ্গা নারী বলেন, বৈঠকে তিনি উজরা জেয়াকে বলেছেন, আশ্রয়শিবিরে দাতাগোষ্ঠীর সাহায্য কমিয়ে দেওয়ায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ বেড়েছে। ঝুঁকি নিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। মিয়ানমারে ফেরানোর লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে যত দিন থাকতে হয়, তত দিন যেন রোহিঙ্গাদের সাহায্য–সহযোগিতা আগের মতো থাকে, সেই সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

বৈঠকে কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বর্বর নির্যাতন, অত্যাচার, গণহত্যা ও নিপীড়নের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার যে মামলা চলমান, তা দ্রুত কার্যকর (নিষ্পত্তি) করতে উজরা জেয়ার সহযোগিতা চেয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা। একজন রোহিঙ্গা নেতা আশ্রয়শিবিরে শিশুশিক্ষা কার্যক্রম বাড়ানোর কথা বলেছেন।

পরিদর্শনকালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মাস্টার জুবায়ের একটি অনুরোধপত্র দেন সেক্রেটারি উজরা জেয়াকে। পরে মার্কিন প্রতিনিধি দলটি আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) পরিচালিত রোহিঙ্গা সাংস্কৃতিক স্মৃতি কেন্দ্র ও ইউএনএফপিএ পরিচালিত নারী ও মেয়েদের নিরাপদ কেন্দ্র পরিদর্শন করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলকে তারা জানিয়েছেন, তারা মিয়ানমারের নাগরিক অধিকার, নিরাপত্তা নিয়ে নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরে যেতে চান। তারা এখন বাংলাদেশের বোঝা। যত দ্রুত সম্ভব নিজ দেশে ফিরে যেতে এবং মিয়ানমারে তাদের ওপর করা গণহত্যার বিচার চান।

রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, উজরা জেয়াসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা রোহিঙ্গা নারীদের সঙ্গেও কথা বলেন। মিয়ানমারে সেনারা কীভাবে তাদের গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে উচ্ছেদ করেছে, নারীরা তার বর্ণনা দেন। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলকে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে আমরা বলেছি- বাংলাদেশের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। ক্যাম্পে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা রয়েছে। তবে যথেষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা নেই। এই জীবন তাদের কাছে বন্দি মনে হয়। যত দ্রুত সম্ভব স্বদেশে ফিরে যেতে চাই। প্রত্যাবাসনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যেন মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে।

এ সময় উজরা জেয়া রোহিঙ্গাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানান। রোহিঙ্গাদের তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অবশ্যই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিচার হবে। রোহিঙ্গারা যাতে নিজ দেশে সম্মানের সঙ্গে নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে ফিরতে পারে সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছে।’

কক্সবাজারের উখিয়া ৮ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার (অপস্ এন্ড মিডিয়া) মো. ফারুক আহমেদ সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, “বুধবার সাড়ে ৯টার দিকে বিমানে করে কক্সবাজার পৌঁছান তারা। এরপর রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে এ দিন বিকালে কক্সবাজারে সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন (আরআরআরসি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। পরে বিকালে ঢাকায় ফিরে যান আন্ডার-সেক্রেটারি উজরা জেয়া, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু এবং সফরে তাদের সঙ্গে থাকা ঢাকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়ায় শরণার্থী বিষয়ক সমন্বয়কারী ম্যাককেঞ্জি রোয়েসহ ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল।

নিউজটি ভিডিওতে দেখুন:

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: মার্কিন প্রতিনিধি দল, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন