রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ‘এনভিসি কার্ড’ নিতে বাধ্য করছে সেনারা
পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:
মিয়ানমারের রাখাইনে জাতীয় যাচাইকরণ প্রক্রিয়ায় ওই প্রদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) গ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি মোবাইল ফোনে রাখাইনের মংডুতে থাকা একাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বললে তারা এ অভিযোগ করেন। এছাড়া, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছেও এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১ অক্টোবর রাখাইনে শুরু হয় ওই যাচাইকরণ প্রক্রিয়া।
মাসখানেক আগে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন মংডুর ওয়ামইজ্জাদি পাড়ার বাসিন্দা জাকির হোসেনের ছেলে ইয়াসির আরাফাত (৩০)। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিলিটারিরা এনভিসি কার্ড নিতে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করছে। তারা (মিলিটারিরা) পাড়ায় পাড়ায় এসে রোহিঙ্গাদের বলছে, “এনভিসি কার্ড নিলে কিছু করব না। আর যদি না নাও তাহলে পুড়িয়ে মারব।”’
বাংলাদেশে আসার পর ইয়াসির দুবার রাখাইনে গিয়েছিলেন। একবার মা-বাবাকে এবং দ্বিতীয়বার ভাইকে নিয়ে আসতে তিনি দেশে ফিরে যান।
ইয়াসির আরাফাতপরে তার মোবাইল ফোন দিয়ে মিয়ানমারের মংডুর দংখালী চরে অবস্থান করা আরও দুজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। ইয়াসির প্রথমে তার ছোট ভাই বশির আহমেদকে কল করেন। পরে তাকে বললে তিনি ওই চরে থাকা তার দুই প্রতিবেশীকে ধরিয়ে দেন। মিয়ানমারে থাকা ওই দুই রোহিঙ্গাও একই অভিযোগ করেন।
বুচিদং হরমুরা পাড়ার আব্দুর রহিমের ছেলে আব্দুর রহমান মোবাইল ফোনে বলেন, ‘বৌদ্ধরা আমাদের পাড়ায় এসে বলে, “তোমাদের এনভিসি কার্ড নিতে হবে। যদি এনভিসি কার্ড নাও, তাহলে তোমরা যেকোনও বাস, গাড়িতে চড়তে পারবা। দেশের যেকোনও জায়গায় যেতে পারবা। আর না নিলে তোমাদের মিলিটারিরা এখানে থাকতে দিবে না।” মোবাইল ফোনে সৈয়দ নূর নামে রাখাইনে থাকা আরেক রোহিঙ্গাও একই অভিযোগ করেন।
শুধু ইয়াসির, আব্দুর রহমান ও সৈয়দ নূর নয়, গত সপ্তাহে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের কাছে জানতে চাইলে তারাও জোর করে এনভিসি কার্ড দেওয়ার কথা জানান।
মুনির আহমদগত বৃহস্পতিবার পরিবার নিয়ে বালুখালী ক্যাম্প-১ এসে আশ্রয় নিয়েছেন মুনির আহমদ। শনিবার ওই ক্যাম্পে গেলে ৭০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধকে থাকার জন্য ঘর তৈরি করতে দেখা যায়। তার কাছে এনভিসি কার্ড সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা মিয়ানমারে এখনও আছেন তাদের সেনারা এনভিসি কার্ড নিতে বাধ্য করছে। প্রথমে খাবার দেওয়া হবে, স্বাধীনভাবে চলতে পারবে এসব বলে এনভিসি কার্ড নিতে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের কথায় রাজি না হলে তারা ভয়ভীতি দেখি এনভিসি কার্ড নিতে বাধ্য করে। না হয় মেরে ফেলার হুমকি দেয়। যারা নিতে চায় না তাদের মিয়ানমার ছেড়ে যেতে হুমকি দেয়।’
এনভিসি কার্ড না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যদি আমরা এই কার্ডটি নেই, তাহলে আমাদের যেসব সম্পদ আছে সব হুকুমতের (সরকার) হয়ে যাবে। আমরা শুধুমাত্র ৫০ হাজার কিয়াতের মালিক হতে পারব। আমাদের বাকি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হুকুমত নিয়ে যাবে। এছাড়া, যে কার্ডটি দেওয়া হচ্ছে তাতে আমাদের রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। তাই আমরা এটি গ্রহণ করতে আগ্রহী নই।’
১৯৮২ সালের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনে মিয়ানমারের প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। এতে মিয়ানমারে বসবাসকারীদের Citizen, Associate এবং Naturalized পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এমনকি দেশটির সরকার রোহিঙ্গাদের প্রাচীন নৃগোষ্ঠী হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়নি। ১৮২৩ সালের পর আগতদের Associate আর ১৯৮২ সালে নতুনভাবে আবেদনকারীদের Naturalized বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
ওই আইনের ৪ নম্বর ধারায় শর্ত দেওয়া হয়, ‘কোনও জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্রের নাগরিক কিনা তা আইন-আদালত নয়; নির্ধারণ করবে সরকারের নীতিনির্ধারণী সংস্থা কাউন্সিল অব স্টেট।’ এ আইনের কারণে রোহিঙ্গারা ভাসমান জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত হয়। পরে ২০১২ সালে রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হোয়াইট কার্ড দেওয়া হয়েছিল। ২০১৫ সালে সেটিও বাতিল করে দেওয়ার পর জাতীয়তার স্বীকৃতিস্বরূপ রোহিঙ্গাদের আর কোনোকিছুই দেওয়া হয়নি।
সম্প্রতি সেনা অভিযানের কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসলে আন্তর্জাতিক চাপের কারণে রাখাইন প্রদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মিয়ানমার সরকার। জাতীয় যাচাইকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত ১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই প্রক্রিয়ার আওতায় ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত সাত হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে এনভিসি কার্ড দেওয়া হয়েছে।
চীনের সিনহুয়া নিউজ এজেন্সিকে উদ্ধৃত করে বার্তাসংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ যাচাইকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। রাখাইনের অভিবাসন ও জনসংখ্যাবিষয়ক বিভাগের পরিচালক উ অং মিনের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রদেশটির যেসব এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে সেখানে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে এ যাচাইকরণের কাজ চলছে।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন