রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাধার অন্তর্নিহিত কারণ

Rangamati uni

জসীম উদ্দিন কবির ::

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। তা যে কোন জাতিরই হোক না কেন। একবিংশ শতাব্দীর এ যুগে উন্নত প্রযুক্তির শিক্ষা যেখানে অপরিহার্য, সেখানে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ চান না বা উচ্চ শিক্ষার সু-ব্যবস্থা তার দোরগড়ায় হোক তা চান না এ দেশে বা পৃথিবীর কোন প্রান্তে এমন ঘটনা বিরল। কিন্তু আমাদের এ পার্বত্য চট্টগ্রামে তার উদাহারণ যুগ যুগ ধরে ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা লজ্জাজনক অবস্থায় উপনীত হয়েছে।

এর কারণ কী? কার কী স্বার্থ এখানে লুকানো আছে? সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই-বা কী? তার ব্যাখ্যা ব্যক্তিভেদে আদর্শভেদে ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। পশ্চাৎপদ পার্বত্য জনগোষ্ঠীকে একটি স্বার্থান্বেষী মহল রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাদের ফায়দা হাসিল করে আসছে যুগ যুগ ধরে। তার সেই নোংরামির অব্যাহত ধারা এখনো চলমান।

এ অঞ্চলের সাধারণ জনগোষ্ঠী উচ্চ শিক্ষা লাভ করুক তা তদানিন্তন বৃটিশ সরকার বা তাদের দোসর সামন্ত রাজারা কোন দিন চাননি। বরং তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে এই জনগোষ্ঠীকে কখনো উপজাতি, কখনো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আখ্যায়িত করতে তারা কখনো কুন্ঠা বোধ করেননি। শোনা যায়, এ জনগোষ্ঠীর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ এবং উন্নত জীবন-যাপনে অতীতে সামন্ত রাজাগণ কর্তৃক প্রবল বাধা সৃষ্টি করেছিল। এমনকি সামর্থ্যবান হেডম্যান, কার্বারীদের সন্তানরাও এ প্রবল বাঁধা থেকে নিস্তার পেতেন না। সামান্য সংখ্যক উচ্চবর্ণের উপজাতীয় সম্প্রদায়ের সন্তানরাই শুধু উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেতেন। ভারত বিভাগের পর (পাক-ভারত) বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চলে গোত্র ভিত্তিক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর উপর পরিসংখ্যান চালালে এর কদর্য্য রূপ উন্মোচিত হবে।

এ সকল সমস্যায় জর্জরিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম সোচ্চার হন মানবেন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, যিনি একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তিনিই প্রথম এ শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, যাতে এ অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠীর মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে যোগ্যতা অনুসারে অবাধে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পায়। সমতলের অগ্রগামী ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে প্রতিযোগিতার মুখে যাতে ছিটকে না পড়ে তার জন্য উপজাতীয় কোটা/ পার্বত্য শিক্ষা কোটা এবং চাকুরীর কোটাও সরকার থেকে আদায় করেন। এ অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠী উল্লেখিত এসব সুযোগ-সুবিধা পাবার কথা থাকলেও কেন জানি তা এখনও সামন্তবাদের ধারক বাহক গোত্র প্রধানদের হাতেই কুক্ষিগত। পার্বত্যাঞ্চলের সকল সুযোগ-সুবিধা মুষ্ঠিমেয় কয়েকটি গোত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল।

মানবেন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা পশ্চাৎপদ এই জনগোষ্ঠীর সকলের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছাবার চেষ্টা করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল একটি সু-শিক্ষিত জাতি তৈরী করা। যারা উন্নত প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে এ অপার সম্ভাবনাময় অবহেলিত পার্বত্যাঞ্চলকে উন্নতির শিখরে পৌঁছাবে।

কিন্তু এ অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠী সমানভাবে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাবে, নিজের দোরগোড়ায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পাবে, মেডিকেল কলেজ পাবে; এ যেন সামন্তবাদী স্বার্থান্বেষী মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। তারা হয়তো ভাবছে, নিজের দোরগোড়ায় কোটামুক্ত উচ্চশিক্ষার এই অবাধ সুযোগ তাদের এত দিনের স্বেচ্ছাচারিতাকে খর্ব করবে। এহেন ধারণা থেকে তাদের এ অঞ্চলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এত গাত্রদাহ।

রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তা পরিচালনা এবং শিক্ষাদানের জন্য সমতল থেকে এ অঞ্চলে অনেক বাঙালির সমাগম ঘটবে। পাহাড়ের সামন্তবাদীদের ধারণা, এই বাঙালিরা হয়তো এ অঞ্চলে বাসিন্দা হয়ে থেকে যেতে পারে। এ সংকীর্ণ মানসিকতা থেকেই এই মহৎ উদ্যোগে বাধা প্রদান করছে তারা।

যে সকল মহৎ ব্যক্তি ও শিক্ষানুরাগী পার্বত্য অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছেন, তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। পক্ষান্তরে এই উদ্যোগে যারা বাঁধা প্রদান করছে, যারা উচ্চশিক্ষা থেকে এ জাতিকে বঞ্চিত করতে চায় তাদের এই হীন চক্রান্ত রুখে দিতে আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ হবার এখনই সময়।

জসিম উদ্দীন কবির: ব্যবসায়ী ও সাবেক সভাপতি, জাতীয় পার্টি, রাঙামাটি জেলা। 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন