লাকিংমে চাকমার লাশ কে নেবে জানাবে আদালত

fec-image

অপহরণের পর ধর্মান্তর এবং বিয়েতে বাধ্য হওয়া লাকিংমে চাকমার লাশ এখনো পড়ে আছে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে। লাশের অভিভাবক সংক্রান্ত কোন নির্দেশনাও আদালত দেয় নি। গত ১০ ডিসেম্বর থেকে লাকিংমে চাকমার মরদেহ পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। ঘটনার ১০ দিনেও সুরাহা হয় নি। যে কারণে সর্বমহলে বিরুপ মন্তব্য ও ধুম্রজাল সহসাই কাটছে না।

শনিবার (১৯ ডিসেম্বর) কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মোহাম্মদ শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী জানান, লাকিংমে চাকমা নামক তরুণির লাশ পুলিশের অধীনে হাসপাতাল মর্গে রয়েছে। আদালতের নির্দেশনা পেলে প্রকৃত অভিভাবকের নিকট হস্তান্তর করা হবে।

লাকিংমের লাশের বিষয়ে কক্সবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ মুনির উল গীয়াস বলেন, গত ১০ ডিসেম্বর তথ্য পেয়ে আমরা কক্সবাজার সদর হাসপাতালে গিয়ে লাকিংমেকে মৃত অবস্থায় দেখতে পাই। কিন্তু ভিন্ন ধর্মের দু’পক্ষ লাশ দাবি করায় বিস্তারিত তদন্তের জন্য এডিএম আদালত আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা তদন্ত রিপোর্ট আদালতের কাছে জমা দিয়েছি। লাশ কে পাবে-সে রায় দেবেন আদালত।

এই উপজাতি তরুণি কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শিলখালী চাকমাপাড়ায় মা-বাবার সঙ্গে থাকতো। স্থানীয় শামলাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ত সে। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় টেকনাফের আতাউল্যাহসহ এক দল যুবক।

এ বিষয়ে শামলাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনজুর আলম জানান, লাকিংমে চাকমা ২০১৭ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি ছিল। এরপর থেকে আর কোন খোঁজখবর নাই। স্কুলেও আসেনি। পরিবারের বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষও অবগত নন বলে জানান প্রধান শিক্ষক।

এদিকে, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে লাকিংমে চাকমার নিথর দেহ। মেয়ের লাশ নিতে গিয়েও পড়েছেন বিপত্তিতে অসহায় বাবা। অপহরণ, নাবালিকা বিয়ে এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরে বাধ্য করার অভিযোগে অভিযুক্ত আতাউল্যাহ বাদ সাধলেন। নিজেকে লাকিংমে চাকমার স্বামী দাবি করে লাশ নেওয়ার আবেদন করেন তিনি। ফলে এই আবেদন গড়িয়েছে আদালতে এবং গত ১০ দিন ধরে লাকিংমের মরদেহ পড়ে আছে মর্গে। সেই পটভূমিতে তদন্ত সাপেক্ষে মৃতের ‘ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত’ হয়ে র‌্যাবকে মরদেহ সৎকার করার নির্দেশ দেন কক্সবাজারের একটি আদালত।

গত ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় লাকিংমে চাকমা কয়েকজন অপহরণ করে বলে সেসময় অভিযোগ তোলেন মেয়েটির বাবা লালা অং। ওই সময় টেকনাফ মডেল থানায় মামলা করার চেষ্টা করলেও সেসময় পুলিশের কাছ থেকে আশানুরূপ সহায়তা না পেয়ে জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তিনি মামলা করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তিনজন আসামীর নাম উল্লেখ করে এবং আরো কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি রেখে লালা অং বাদী হয়ে মামলাটি করেন।ট্রাইব্যুনালের বিচারক ওই অপহরণের ঘটনার তদন্ত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন, পিবিআই’এর কাছে হস্তান্তর করেন।

পিবিআই অগাস্ট মাসে এ বিষয়ে তদন্ত শেষে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তদন্তের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয় যে বিভিন্ন ঘটনার ভিত্তিতে সেসময় মেয়েটি ”নিজে থেকেই অজ্ঞাত স্থানে চলে যায়” এবং যাদের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের ”অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়নি।

পিবিআইয়ের ওই তদন্ত প্রতিবেদনের সাথেই অন্তত তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য সংযুক্ত করা ছিল। যারা জবানবন্দী দিয়েছেন তারা বলেন, ৫ই জানুয়ারি লাকিং মে চাকমাকে তার ঘর থেকে কয়েকজন জোরপূর্বক ধরে নিয়ে সিএনজিতে করে পালিয়ে যাচ্ছে বলে তারা দেখতে পেয়েছেন।

লালা অং প্রথমবার তার মেয়ের খোঁজ পান নিখোঁজ হওয়ার ১১ মাসেরও বেশি সময়ের পর। ১০ ডিসেম্বর তিনি একটি ফোন পান কক্সবাজার সদর থানার উপ পরিদর্শক আবদুল হালিমের কাছ থেকে। আবদুল হালিমের কাছ থেকে লালা অং জানতে পারেন যে তার মেয়ে মারা গেছে।

কিন্তু মেয়ের মৃত্যুর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ লালা অং পান, যখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে বলা হয় যে মেয়ের মরদেহ তিনি নিতে পারবেন না। সেসময় তিনি জানতে পারেন যে তার মেয়ে ধর্মান্তর করে বিয়ে করেছে এবং তার স্বামীর পরিবার লাশ নিজেদের হেফাজতে নেয়ার জন্য আদালতে আবেদন করেছেন।

লালা অং বলেন, তারা আমার ১৪ বছর বয়সী মেয়েকে শুরুতে অপহরণ করেছে, তাকে ধর্মান্তরিত করে হত্যা করেছে। এখন তার লাশটা পর্যন্ত আমাকে নিতে দিচ্ছে না।

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই কক্সবাজার ইউনিটের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) ক্যশৈনু মারমা বলেন, লাকিংমে চাকমার বাবা তিনজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন। মামলায় আতাউল্যাহর নাম ছিল না। তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়নি। তারা নিরীহ মানুষ। এজাহারে যে পাঁচজনকে সাক্ষী রাখা হয়েছে, তারা লাকিংমে চাকমার আত্মীয়। লাকিংমে চাকমাকে তিনজন এবং অজ্ঞাত ৫-৬ লোক সিএনজি অটোরিকশায় তুলে নিয়ে গেছে বলে তারা জানিয়েছেন। আমি এসব সাক্ষী ছাড়াও প্রত্যক্ষদর্শী এবং এলাকার বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। এই পাঁচ সাক্ষী ছাড়া এলাকার আর কেউ অপহরণের কথা বলেনি। ফলে আমি তদন্ত প্রতিবেদনে লাকিংমে চাকমা নিজেই পালিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেছি।

ক্যশৈনু মারমা বলেন, বিষয়টি আমার কাছেও খারাপ লাগছে। আমি তাকে উদ্ধার করতে পারিনি। তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য সুনির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে। ৫-৬ মাস আমি চেষ্টা করেছি। লকডাউনের সময় তদন্তে কিছু সমস্যা হয়। তারপরও আমি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তবে, অভিযুক্ত আতাউল্যাহর বড় ভাই মনির উদ্দিন মুঠোফোনে বলেন, আমার ছোট ভাই এখন বাড়িতে আছে। তার মানসিক অবস্থা ভালো নয়। সে কথা বলতে পারবে না।

ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, আতাউল্যাহ ওই মেয়েটিকে নিয়ে তার কর্মস্থল কুমিল্লায় চলে গিয়েছিল। সেখানে ধর্মান্তরের পর বিয়ে করেছে। লাকিংমে চাকমার বর্তমান নাম হালিমাতুল সাদিয়া। প্রায় ছয় মাস আগে স্ত্রীকে নিয়ে আতাউল্যাহ টেকনাফের বাড়িতে আসে। গত ৯ ডিসেম্বর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আতাউল্যাহ তার স্ত্রীকে থাপ্পড় দেয়। এর পর রুমে ঢুকে সাদিয়া (লাকিংমে) বিষ পান করে। কক্সবাজার হাসপাতালে নেওয়ার পর সে মারা যায়।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আদালত, চাকমার, লাশ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন