লামায় পাহাড় কেটে বনাঞ্চল-জনবসতিতে ২২ ইটভাটা

Bandarban Eitvata Pic-2

স্টাফ রিপোর্টার:

প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বান্দরবানের লামায় পাহাড় ও ফসলি জমি কেটে বনাঞ্চল-জনবসতির ভেতরে ২২টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এতে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়েরও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইটভাটাগুলোতে মানা হচ্ছে না কোনো নিয়মনীতি। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র ছাড়া সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বনাঞ্চল, জনবসতি ও প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে এ সব ইটভাটা। ভাটাতে জ্বালানির যোগান দিতে সরকারী-বেসরকারী বনাঞ্চল উজাড় করে সংগ্রহ করা হচ্ছে কাঠ। আর ইট তৈরি করতে পাহাড় ও ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে মাটির উর্ব্বতা শক্তি নষ্ট করা হচ্ছে।

জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বনাঞ্চল, জনবসতি ও স্কুল-কলেজের একশ’ গজের মধ্যে কোনো ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু বান্দরবানের লামায় মানা হচ্ছে না এই নিয়ম। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে বনাঞ্চল, জনবসতি এবং প্রাইমারি স্কুলের পাশেই অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে সবকটি ইটের ভাটা। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকাতে সরকারি অনুমোদন ছাড়া ইটের ভাটাগুলো বন্ধে সম্প্রতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও কার্যত কিছুই হয়নি।

স্থানীয়ভাবে প্রশাসনের তদন্ত রিপোর্টে ইটের ভাটাগুলোকে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এ সব ভাটা স্থাপন বন্ধে প্রশাসনের ভূমিকা রহস্যজনক বলে দাবি করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি,সুশীল সমাজ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

লামার ফাসিয়াখালী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জাকির হোসেন ও ফাইতং ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শামসুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, পাহাড় ও ফসলি জমি কেটে অবৈধভাবে ইটের ভাটাগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। টিনের ড্রাম ও ব্রয়লার চিমনি বানিয়ে গড়ে তোলা ইটের ভাটাগুলোতে ইট পোড়াতে প্রকাশ্য কাঠ জ্বালানো হচ্ছে। জ্বালানির যোগান দিতে পাশের সরকারী বনাঞ্চল উজাড় করে ফেলা হচ্ছে। ইট তৈরি করতে পাহাড় ও ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে মাটি মওজুত করা হয়েছে। ইটের ভাটাগুলোতে সরকারি কোনো নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। অভিযোগ দেওয়ার পরও ব্যবস্থা নিচ্ছে না জেলা-উপজেলা প্রশাসন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের শস্য উৎপাদন বিশেষজ্ঞ আলতাফ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ইটের ভাটাগুলোর ফসলি মাঠ গ্রাস প্রক্রিয়া চলতে থাকলে অচিরেই বান্দরবানে বড় রকমের খাদ্য সঙ্কট দেখা দিবে। পাহাড়ি জেলা হওয়ায় এখানে এমনিতেই ফসলি জমির পরিমাণ কম, তার ওপর ইটের ভাটার কারণে ফসলি জমি নষ্ট হওয়ায় জেলার কৃষির ভবিষ্যত নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। ইট ভাটাগুলো শুধু ফসলি জমি গ্রাস করছে তাই নয়, ভাটার মাটি যোগান দিতে কাটা হচ্ছে পাহাড়। আর জ্বালানি যোগান দিতে নির্বিচারে সরকারি-বেসরকারি বনাঞ্চল উজাড় করে কাটা হচ্ছে কচিকাঁচা গাছ। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ইটভাটা তৈরির আগে লাইসেন্স গ্রহণ, পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও নিয়ম কানুনকে বৃদ্ধাগুলি দেখিয়ে অধিকাংশ ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. ইসলাম বেবী জানান, আইন সকলের জন্য সমান, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে ইটের ভাটা গড়ে তোলার কোনো সুযোগ নেই। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও অনুমোদনবিহীন ইটভাটাগুলো বন্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন দলেরই হোক কিংবা বিরোধী দলের, আইনের ঊর্ধ্বে কেউই নয়।

বিএনপি নেতা মজিবুর রশিদ জানান, ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় জেলায় অবৈধ ইটের ভাটাগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। ভাটা মলিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতার সংখ্যাই বেশি। পরিবেশ বান্ধব নয়, এমন ইটের ভাটাগুলো বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ইটের ভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধে সরকারি সংস্থাগুলোকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের অনুরোধ করেন।

বান্দরবান মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহাবুবুল ইসলাম জানান, পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ হচ্ছে ইটের ভাটা। পাহাড় কেটে ও বনাঞ্চল উজাড় করে গাছ কেটে ইট ভাটাগুলোতে পোড়ানোর কারণে বান্দরবানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পাহাড় ধসের ঘটনা বাড়ছে। ইটের ভাটার কারণে ঝিরি-ঝর্ণা পানির উৎস স্থলগুলো ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক কেএম তারিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, অবৈধ ইটের ভাটার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট ইউএনও’দের পাহাড় কাটা এবং ইট ভাটাগুলোতে কাঠ পোড়ানো বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন