সংরক্ষিত বনভূমি ও মাতামুহুরীর তীরে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাকের আগ্রাসন

চকরিয়া প্রতিনিধি:

কক্সবাজারের চকরিয়ায় ফের তামাকের আগ্রাসন শুরু হয়েছে। চলতি মৌসুম থেকে তামাক আবাদে নিরুৎসাহিত করতে মাঠপর্যায়ের চাষিদের নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা র‌্যালি ও মানববন্ধসহ সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তা কোন কাজে আসেনি। প্রতিবছরের মতো এবারও রেকর্ড পরিমাণ জমিতে তামাক উৎপাদনে জোরেশোরে মাঠে নেমেছে চাষিরা। ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি জমির পাশাপাশি তামাক আবাদের ভয়াবহ আগ্রাসন শুরু হয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের খাস জমিতে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সংরক্ষিত বনের ভেতর ও নদীর তীরে তামাক চাষে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এমনকি সরকারি খাস জমিতে তামাক চাষ বন্ধে প্রশাসনেরও কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছেনা। এতে অনেকটাই নির্বিঘ্নে চাষাবাদ চলছে পরিবেশের বারোটা বাজানো তামাকের আগ্রাসন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে চকরিয়া উপজেলার বমুবিলছড়ি ইউনিয়নের বমু বনবিট ও সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নের মানিকপুর বনবিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এবং উপজেলার মাতামুহুরী নদী তীরের বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, কৈয়ারবিল, বরইতলী, ফাঁসিয়াখালী, ডুলাহাজারা ও চিরিঙ্গা ইউনিয়নের অন্তত এক হাজার একর খাস জমিতে তামাকের আবাদ শুরু হয়ে গেছে।

সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ এলাকায় ইতিমধ্যে রোপন করা তামাকের চারা বড় হতে শুরু করেছে। মাস দু’য়েকের মধ্যে শুরু হবে তামাক শোধনের কাজ। এজন্য বনাঞ্চলের আশপাশে ও লোকালয়ে কয়েক হাজার তামাক চুল্লী নির্মাণকাজও চলছে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ঢাকা টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো ও রাঙ্গুনিয়া সমিতিসহ অসংখ্য তামাক কোম্পানী চাষিদের প্রলোভনে ফেলে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষে মাঠে নামিয়েছে।

বিভিন্ন সূত্র জানায়, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের আওতাধীন বমু বনবিটের প্রায় ২ হাজার ২শ একর বনভূমি যথাযথ রক্ষণাবেক্ষনের জন্য ২০০৫ সালে লামা বনবিভাগের কাছে হস্তান্তর করে। বর্তমানে এ বনবিটটি লামা সদর রেঞ্জের নিয়ন্ত্রণাধীন। বেশ কয়েক বছর ধরে স্থানীয় কাঠ পাচারকারী চক্র ও সংশ্লিষ্ট বনবিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশে এক সময়ের বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ বমু বনবিট এখন ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। এছাড়া বেশ কবছর ধরে বন কর্মকর্তাদের যোগসাজসে ভিলেজারেরা (বন জায়গীরদার) তামাক চাষের পর তা শোধনের জন্য নির্বিচারে বনজ সম্পদ উজাড়ের কারণে এই বনবিটে এখন আর অবশিষ্ট কিছুই নেই বললেই চলে।

চকরিয়া সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি অধ্যাপক এ কে এম শাহাবুদ্দিন বলেন, তামাকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলতে হবে। চকরিয়া উপজেলার অন্তত আটটি ইউনিয়নের মধ্যে কম করে হলেও ১২ হাজার একর জমিতে তামাকের আগ্রাসন চলছে। তন্মধ্যে সংরক্ষিত বনের কিছু অংশ এবং মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের খাস জমি মিলিয়ে আরো অন্তত এক হাজার একর জমিতে তামাকের আবাদ শুরু হলেও প্রশাসনের কোন নজরদারী নেই।

তিনি আরও বলেন, মুলত তামাক কোম্পানীগুলোর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রান্তিক কৃষকদের প্রলোভনে ফেলে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করে আসছে। এমনকি বিনাসুদে ঋণ দেওয়া ছাড়াও তামাক ক্রয়ের সময় ভাল দাম দেওয়ার কথা বলায় প্রতিবছর খাস জমিতেও তামাকের আবাদ বাড়ছে। স্থানীয় পরিবেশ সচেতন লোকজন মনে করছেন, জরুরী ভিত্তিতে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে মাতামুহুরী নদীর দুই তীর ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলে রোপিত তামাক ধ্বংস না করলে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানো যাবেনা। এতে মাতামুহুরী নদীর পানি দুষিত হয়ে পরিবেশের বারোটা বাজাবে।

চকরিয়া পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সাংবাদিক এম আর মাহমুদ বলেন, তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করতে কয়েকমাস আগে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তৎপরতা দেখা যায়। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও মাঠ পর্যায়ের চাষিদের নিয়ে সচেতনতামূলক র‌্যালি, মানববন্ধনসহ নানা কার্যক্রম হাতে নেয়। কিন্ত প্রশাসনের এই কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। বরাবরের মতোই তামাকের আগ্রাসন শুরু হয়ে গেছে চকরিয়ায়।’তিনি আরও বলেন, ব্যক্তি মালিকানাধীন বিপুল পরিমাণ জমির পাশাপাশি মাতামুহুরী নদীর দুই তীর ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর আবাদি জমিতেও ব্যাপকহারে তামাকের চাষ শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে যদি উপজেলা প্রশাসন অভিযান পরিচালনা না করে তাহলে পরিবেশের বারোটা বাজবে। পাশাপাশি সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় ও ব্যক্তি মালিকানাধীন গাছ নিধন হবে দেধারছে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) খোন্দকার ইখতিয়ার উদ্দিন মো. আরফাত বলেন, চলতি বছরও মাতামুহুরী নদীর দুইতীরের খাস জমিতে ব্যাপক হারে তামাকের চাষ হচ্ছে বলে আমি শুনেছি। তাই কোন কোন এলাকায় তামাকের চাষ হচ্ছে তার খোঁজ নিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার তহসিলদারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন