সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে জমি দখলের পায়তারা করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা

Rangamati pic-03-14.08.13

আলমগীর মানিক, রাঙামাটি:
ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাঙামাটি শহরের মুসলিম পাড়ায় কয়েকটি বাঙালি পরিবারের ভূ সম্পত্তি দখল করার পায়তারা করছেন সরকারের মধ্যমপদস্থ এক কর্মকর্তা। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বেআইনী ভূমি পরিমাপ ও জমি দখলের কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন প্রশাসনকে। মুসলিম সম্প্রদায়ের সর্ব বৃহৎ উৎসব ঈদ সামনে রেখে সকলে যখন উৎসবের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত ঠিক তখন প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করে দুই যুগেরও বেশী সময় ধরে নিজ বৈধ সম্পত্তিতে দখলে থাকা কয়েকটি পরিবারের জমি পরিমাপ করে সেখানে লাল পতাকা টানিয়ে দিয়েছেন তিনি। ঈদের পূর্বক্ষণে জেলার যুগ্মজজ আদালতের বিচারকগণ ছুটিতে থাকায় এই বেআইনী পরিমাপ ও মহড়ার বিরুদ্ধে কোনো আইনী প্রতিকারও নিতে পারেনি ভূক্তভোগীরা। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছে সদ্য পদোন্নতি পাওয়া সরকারের এই যুগ্ম সচিব শুধু ভূমি পরিমাপ করেই ক্ষান্ত হননি। থানা পুলিশকে শিখন্ডি হিসেবে দাঁড় করিয়ে তিনি উক্ত জায়গায় স্থাপনা নির্মাণেরও পায়তারা করছেন।

পার্বত্য এলাকার স্পর্শকাতর এই ভূমি বিষয়ে বাঙালি এলাকায় উড়ে এসে জুড়ে বসার এই মহড়া সাম্প্রদায়িক রূপ নেওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলেও সংশ্লিষ্টদের ধৈর্য ও বিচক্ষণতায় আপাতত বিষয়টি শান্ত রয়েছে, তবে যেকোনো সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠার আশঙ্কা করছে এলাকার জনগণ। জুলুমের শিকার নুরুল ইসলাম জানান, দুইযুগ আগে বৈধ কাগজপত্র দেখে আমি এই জমি ক্রয় করি। তার পর থেকে সেখানে আমি বসতবাড়ি নির্মাণ করে স্বপরিবারের বসবাস করে আসছি। জমিতে আমার দুই দশকের পুরনো গাছপালাসহ বিভিন্ন স্থাপনা আছে। এই দীর্ঘ সময়ে কেউ একটি অভিযোগ পর্যন্ত  করেনি যে, এই জমিতে তার কোনো অধিকার আছে। হঠাৎ করে ক্ষমতার জোরে তারা আমাদের বৈধ জমি দখলে নেওয়ার পায়তারা করছেন। তিনি বলেন, আমরা জেনেছি পাশে তাদের জমি আছে কিন্তু সেসব জমিতেও তাদের কখনও দেখা যায়নি। বিগত কিছুদিন যাবত আমরা লক্ষ করছি কিছু চিহ্নিত ভূমির দালাল এসব জমি কেনা বেচা করছে। তিনি বলেন এলাকার সবাই জানে এই ভূমির দালালেরা একই জমি কয়েকবার করে কেনা-বেচা করে ইতোমধ্যে এলাকায় সীমাহীন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

জমির অন্যতম মালিক সওজ বিভাগের কর্মচারি মোক্তার আহাম্মদ বলেন, আমার সারা জীবনের সঞ্চয় বিনিয়োগ করে আমি এই জমি খরিদ করেছিলাম। দীর্ঘদিন যাবত আমি ঘরবাড়ি নির্মাণ করে জমিতে অবস্থান করছি। কেউ কখনও কোনো অভিযোগ করেনি। আজ হঠাৎ করে আমাদের কোনো কিছু না জানিয়ে প্রশাসন কিভাবে এই জমি পরিমাপের আদেশ দেয়ায় আমার বুঝে আসছেনা। তিনি বলেন, ছোট কর্মচারি হিসেবে আমরা আইনের প্রতি আস্থাশীল। আমাদের বিশ্বাস আইন তার নিজস্ব গতিতে চললে আমাদের ভূমিহীন করার সুযোগ থাকবে না। চোখের পানি ফেলে অসহায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এলাকার আরো কয়েকজন একেবারে নি¤œ আয়ের মানুষ।
অপর একখন্ড জমির মালিক রাঙামাটি আদালতের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট দুলাল কান্তি সরকার বলেন, সরকারি সার্কুলার মুলে দীর্ঘদিন যাবত পার্বত্য এলাকার সকল প্রকার ভূমি পরিমাপ বন্ধ রয়েছে। অথচ ওই যুগ্ম সচিবের প্রভাবে প্রশাসন সে আদেশও অমান্য করেছেন। তিনি জানান, ১০২ নং রাঙ্গাপানি মৌজার মুসলিমপাড়ায় ৯৮৭ নং হোল্ডিং এর ১৮৩২ দাগে আমি তিনদশক পূর্বে ৩০ শতক জায়গা বন্দোবস্তি পাই। আর্থিক প্রয়োজনে আমি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে এ জায়গা বিক্রয় করি এবং এক পর্যায়ে আবার হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় এর অংশ বিশেষ নিজে ক্রয় করি। এই দীর্ঘ হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় কোনোকালেই কেউ এতে কোনোপ্রকার দাবি উত্থাপন করেনি। বর্তমানে ওই জমির দশ শতক জমিতে আমি এবং আমার আমার কলিগ আরেক সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট মোখতার আহমেদের কন্যা মোজাইয়্যেনা আহমেদসহ ভোগ দখলে আছি। সেখানে আমাদের ঘেরাবেড়া ও কাঁচা ঘর রয়েছে। যার রেজিষ্ট্রি কবলার বন্ড নং ২২১২/০৯-১০। এর আগে মিউট মামলা নং ১৯০(ডি)/১৯৯৪-৯৫ মুলে এই জমিটির মালিক ছিলেন জনৈক এডভাল্ট ট্রিপল্যান্ড টিপু। তার দখল থেকে ক্রয়সূত্রে আমরা দখলে যাই। যা মিউটেশন মুলে নতুন হোল্ডিং নং ৩৩৩৮/ক/৯৮৭, দাগ নং ১৮৩২ মুলে আমাদের নামে জমাবন্দি লিপিবদ্ধ হয়ে প্রচারিত আছে। সেখানে কামরুল নামে এক দিনমজুর আমাদের ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করতো। কিছুদিন আগে তার আকস্মিক মৃত্যু ঘটলে তার স্ত্রী অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু হঠাৎ করে কাউকে কিছু না জানিয়ে কয়েকজন ভূমির দালালসহ কোতয়ালী থানার একজন এসআই গত ২৯/৭/১৩ গেট ও তালা ভেঙ্গে আমাদের জমিতে প্রবেশ করে। এসময় তারা আমাদের নির্মাণ সামগ্রী বের করে ফেলে দেয় এবং সেখানে একটি পরিবার ঢুকিয়ে দিয়ে জায়গা দখলের পায়তারা করে।

সংবাদ পেয়ে আমরা অকুস্থলে উপস্থিত হলে তারা এই অবৈধ কাজ থেকে বিরত থাকে। এ সময় পুলিশ আমাদের মৌখিকভাবে সেখানে কোনো ধরণের নির্মাণ কাজ না করার অনুরোধ জানালে আমরা সম্মত হই এবং নির্মাণ কাজ থেকে বিরত থাকি। এরপরও এই ঘটনার দু’দিন পর জনৈক রীতা চাকমা স্বামী প্রিয়জ্যোতি খীসার এক আবেদনের প্রেক্ষিতে আমাদের নামে ১৪৪/১৪৫ ধারায় স্ব স্ব অবস্থানে স্থীত থাকার নোটিশ ইস্যু করা হয়, আমরা বরাবর আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে যে কোনো তৎপরতা থেকে বিরত থাকি। ইতোমধ্যে ওই সরকারি কর্মকর্তা প্রভাব খাটিয়ে এডিএম আদালতের এক আদেশমুলে তড়িঘড়ি করে একদিনের মধ্যে কোতয়ালী থানার এসআই নেপাল কৃষ্ণ মজুমদারকে দিয়ে একটি একতরফা প্রতিবেদন প্রস্তুত করান। এই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ওই এলাকার ৪০ শতক জমির উপর কোতয়ালী থানাকে রিসিভার নিয়োগ করে বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত।
এডভোকেট দুলাল সরকার জানান, কিন্তু রিসিভার নিয়োগের ছদ্মাবরণে তারা পুলিশ ও এলাকার কিছু মাস্তান সাথে নিয়ে কানুনগো দিয়ে জায়গাটি পরিমাপ করে এবং লাল পতাকা টানিয়ে দেয়। এই সময় তারা আমাদের জায়গায় গৃহ নির্মাণের জন্য রক্ষিত প্রায় ৪০ হাজার টাকার নির্মাণ সামগ্রী উঠিয়ে নিয়ে যায়। তিনি জানান এই পরিমাপের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জমির মালিকদের কাউকে অবহিত করা হয়নি। এমনকি এলাকার জন প্রতিনিধি বা জমির অবস্থান সম্পর্কে অবহিত প্রবীণ ব্যক্তিত্ব অথবা এলাকার গণ্যমান্য কাউকে না ডেকে একতরফাভাবে পরিমাপ করা হয়েছে।
জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণলায়ে ন্যাস্ত একজন যুগ্ম সচিব (ভারপ্রাপ্ত) তার পদবীর প্রভাব খাটিয়ে স্ত্রীর পক্ষে জমি দখলে প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। সম্পূর্ণ ভিন্ন দাগের একখন্ড ভূমিকে তাদের জমির অংশ দাবি করলেও এই কর্মকর্তার পরিবার কখনও নিজেদের জমিতে আসেননি। বরং যুগ যুগ ধরে বিরান পড়ে থাকা এসব জমি তারা এখন বিভিন্ন মানুষের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। কাঁচা টাকার লোভে ভুলে গেছেন নীতি নৈতিকতা।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কোতয়ালী থানার উপ পুলিশ পরিদর্শক নেপাল কৃষ্ণ পালকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বিষয়টি সম্পর্কে খোলাখোলি কিছু বলতে রাজি হননি। ২১ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার কথা থাকলেও একদিনের মধ্যে তিনি কিভাবে তদন্ত রিপোর্ট দিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা উপরের ব্যাপার। আমরা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ন্যাস্ত দায়িত্ব পালন করি মাত্র।

এদিকে, এই ঘটনায় উক্ত জমির কথিত মালিক দাবিদার সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী মিসেস রিতা চাকমার মোবাইলে গ্রামীণ ফোন সিমের নাম্বারে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে তার মোবাইল নাম্বারে এসএমএস পাঠিয়ে উদ্দেশ্য বলা হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি এবং পরবর্তী ফোন রিসিভ করেননি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন