সাম্প্রতিক তাইন্দং সহিংসতা ১৯৮৬ সালের রোপিত ফসল

taiendang

গত ৩ আগস্ট ২০১৩ খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দঙে পাহাড়ী- বাঙালী সংঘর্ষের এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৩৫টি উপজাতীয় বাড়ি, ৩টি বাঙালী বাড়ি ও ২টি মন্দিরে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়। ঘটনা তদন্তে খাগড়াছড়ির জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ করিম অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হকের( উপসচিব) নেতৃত্বে এক সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।  কমিটি গত ৩ সেপ্টেম্বর তার তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দেয়। গোপনীয় মার্কিং করা এই তদন্ত প্রতিবেদনটি পার্বত্যনিউজের হাতে এসেছে। প্রতিবেদনে শুধু তাইন্দঙের ঘটনার অন্তর্নিহিত কারণই শুধু নয় পার্বত্য রাজনীতির নানা দিকে উঠে এসেছে। ফলে তা জানার আগ্রহ পার্বত্যবাসী তথা দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিকের।  এ তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে পার্বত্যনিউজের ধারাবাহিক স্পেশাল রিপোর্ট- ‘তাইন্দং সহিংসতা: কি আছে জেলা প্রশাসনের তদন্ত রিপোর্টে।’

(আজ প্রকাশিত হলো চতুর্থ পর্ব)

পার্বত্য নিউজ রিপোর্ট:

৩ আগস্টের তাইন্দং সহিংসতাকে বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে পাহাড়ীদের পক্ষ থেকে দাবী করা হলেও তাইন্দং সহিংসতার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন ও দোষীদের চিহ্নিত করার লক্ষ্যে খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মো: মোজাম্মেল হক এর নেতৃত্বে গঠিত এক সদস্যের নির্বাহী তদন্তকালে বেরিয়ে এসেছে ভিন্ন চিত্র। তদন্তকালে অনেকেই ৩ আগস্টের ঘটনার জন্য পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির পাশাপাশি সন্ত্রাসী কার্যক্রম, হত্যা, গুম, অপহরণকে দায়ী করে বলেছেন, ৩ আগস্টের সহিংসতা ১৯৮৬ সালে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের বর্বরোচিত তাইন্দং ধ্বংসযজ্ঞের রোপিত ফসল।

তদন্তকালে দেয়া লিখিত বক্তব্যে তাইন্দং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক মো: তাজুল ইসলাম বলেন, ১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিল তৎকালীন সময়ের শান্তিবাহিনী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বর্বরোচিত তান্ডব ঘটিয়েছিল তাইন্দংয়ে। এখনো পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের নাম শুনলে ভয়ে আঁতকে ওঠে সাধারণ মানুষ। ৩ আগস্টের ঘটনার পুর্ববর্তী সময়গুলো ছিল আতঙ্কে ভরা।

তাইন্দং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো: হানিফ মিয়া বলেন, ১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিল পাহাড়ী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাইন্দং বাজার ও বহু ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। সেসময় সন্ত্রাসীদের তান্ডবে একদিনে ৪৯ নিরীহ বাঙ্গালী নারী, শিশু গুলিবিদ্ধ ও অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। সেদিনের সেই ক্ষত চিহ্ন এখনো শুকায়নি।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সেই ব্রিটিশ শাসনামল থেকে তাইন্দংয়ে বসবাসকারী বাঙ্গালীদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র নতুন নয়। এর শুরু হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। সে সময় শান্তিবাহিনীর সদস্যরা তাইন্দং, আছালং ও তবলছড়িতে এক যোগে হামলা করে। সেসময় তারা বাঙ্গালীদের ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায় বলে জানান স্থানীয়রা।

এর দুই বছরের মাথায় ১৯৮১ সালে গভীর রাতে তাইন্দংয়ের পাহাড়ী গ্রাম বগাপাড়া দিয়ে তানাক্কাপাড়া বিডিআর ক্যাম্পে হামলা করে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। সেসময় শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তানাক্কাপাড়া ক্যাম্পকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। শান্তিবাহিনীর সে হামলায় ঘটনাস্থলেই ১১জন বিডিআর সদস্য নিহত হয়। সে হামলায় ক্যাম্পের অন্যান্য বিডিআর সদস্যরা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়।

জানা গেছে, ১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিলের আগেও দুই দফা হামলা করে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। ১৯৮৬ সালের ৬ মে দ্বিতীয় দফায় রাত দুইটার দিকে আছালং আলী আজ্জম সর্দার পাড়ায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে শান্তিবাহিনী। সে সময় একই পরিবারের তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এসময় তারা টহলরত বিডিআর সদস্যদের কাছ থেকে তাদের ব্যবহৃত ওয়ারল্যাস সেট ছিনিয়ে নেয়। ১৯৮৬ সালের ২০ মে তৃতীয় দফায় তারা হামলা করে তাইন্দংয়ের সিংহপাড়ায়। তারা সেখানে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে একই পরিবারের সাত জনকে। হত্যার পর তাদেরকে ঘরে রেখে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। তাদের সেই নারকীয় তান্ডব এখনো ভুলতে পারেনি তাইন্দংয়ের স্বজন হারা মানুষেরা। এখনো সেই ক্ষত চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে সেই সব মানুষেরা। এসকল ঘটনার ফলে তাইন্দঙেযর বাঙালীদের মাঝে পাহাড়ী সন্ত্রাসী ভীতি, আতঙ্ক, বিদ্বেষ কাজ করে। ফলে সন্ত্রাসী হামলার সামান্য গুজবে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। আত্মরক্ষার্থে পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নেয়। ফলে তাইন্দং সহিংসতা ১৯৮৬ সালের নারকীয় তান্ডবেরই রোপিত ফসল বলে মনে করছেন অনেকে।

ঘটনার তদন্তকালে বটতলী বাজার এলাকার মৃত-ক্বারী আবদুল জব্বারের ছেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মো: আবদুস সামাদ বলেন, ১৯৯৪ সালে তাইন্দং থেকে তিন বাঙ্গালীকে অপহরণ করে পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা। এখনও তাদের পাওয়া যায়নি। অপহৃতরা বেঁচে আছে না তাদের হত্যা করা হয়েছে তাও জানে না তার স্বজনসহ তাইন্দংয়ের মানুষ।

খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মো: মোজাম্মেল হক তার প্রতিবেদনে বলেন, অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৮৬ সালে মাটিরাঙ্গা এলাকায় শান্তিবাহিনী কর্তৃক ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করা হয়। তখন থেকে পাহাড়ীদের প্রতি বাঙ্গালীদের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং বাঙ্গালীদের মধ্যে সবসময় পাহাড়ীদের প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহা কাজ করে। বাঙ্গালীদের এ প্রতিশোধ স্পৃহাকে কাজে লাগিয়ে ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারীরা সাধারণ বাঙ্গালীদের উত্তেজিত করে ৩ আগস্টের ঘটনা ঘটায়।

অন্যদিকে মাটিরাঙ্গা উপজেলায় বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৪/৫টি বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়। এসব ঘটনায় অনেক পাহাড়ী অধ্যুষিত গ্রাম হতে তারা বিতাড়িত হয় এবং কালক্রমে মাটিরাঙ্গায় পাহাড়ীরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। তাই পাহাড়ীদের ধারণা তাদের বাড়ীঘর থেকে উচ্ছেদ করে তা দখল করতেই বাঙালীরা পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটায়। পাহাড়ীদের এ ধারণা একেবারে অমূলক নয় বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন তিনি।

এছাড়াও সম্প্রতি তাইন্দং গ্রামের কলেজ ছাত্র মো: আবদুল মজিদ অপহরণ এবং ১৮ দিন পর মুক্ত হওয়া, গুইমারার জাহাঙ্গীর আলম অপহরণ এবং পরে মুক্তি পাওয়ার ঘটনা সাধারণ বাংগালীদের ক্ষুব্ধ করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা কাজী মো: মোজাম্মেল হক।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন