হঠাৎ দাম বৃদ্ধিতে খুশি লবণ চাষিরা

Chakaria Pic. (Solt)

চকরিয়া প্রতিনিধি :
দেশে লবণের কোন ঘাটতি না থাকলেও গত কয়েকদিন ধরে অপরিশোধিত লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাঠপর্যায়ের চাষিরা বেশ উল্লসিত। ইতিপূর্বে সরকার লবণ নীতি ঘোষণা করলেও কয়েকবছর ধরে উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে এই পেশা ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে অনেকে ইতিমধ্যে লবণ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও তাদের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে হঠাৎ লবণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায়। মাসখানেক আগেও দেশে উৎপাদিত প্রতিকেজি লবণ ৫ থেকে ৬ টাকায় বিক্রি হয়নি, সেই লবণ এখন বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৫ টাকাতে। যা দেশের লবণ শিল্প তথা চাষিদের জন্য সুখবর। তবে চলতি সময়টা লবণ উৎপাদনের মৌসুম না হলেও লবণের দাম বৃদ্ধি স্থিতিশীল থাকলে আগামী মৌসুমে দেদারছে লবণ উৎপাদনে মাঠে নামতে পারেন চাষিরা। লবণের দাম বৃদ্ধির খবর চাষিদের মাঝে পৌঁছলে তারা এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) কক্সবাজার অফিসের তথ্যমতে, গেল মৌসুমে দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদনকারী অঞ্চল কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়াসহ সাত উপজেলার উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৬০ হাজার একর এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ৭ হাজার ২৫৬ একর জমিতে লবণ উৎপাদনে নামে চাষিরা। সরকারীভাবে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৮ লক্ষ মেট্টিক টন। কিন্তু প্রাকৃতিক বৈরি আচরণের কারণে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। এ বছর লবণ উৎপাদন হয় ১৫ দশমিক ৫৫ লক্ষ মেট্টিক টন। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে লবণ উৎপাদনের ঘাটতি থাকায় বিদেশ থেকে দেড় লক্ষ মেট্টিক টন লবণ আমদানির সুযোগ অনুমতি দেয় মিল মালিকদের।

চকরিয়া খুটাখালীর লবণ চাষি মনজুর আলম বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে প্রতিমণ কালো লবণ বিক্রি হয়ে আসছিল ৮৫ টাকা, মাঠওয়াশ ৯৬ টাকা এবং পলিথিন পদ্ধতিতে ১১৮ টাকা। তাছাড়া শ্রমিক নিয়োগ এবং পলিথিনের মূল্য মিলে প্রতিমণ লবণ উৎপাদনে খরচ পড়ে ১৩০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এই মূল্য নায্য নয়। এতে মাঠপর্যায়ের চাষিরা হতাশায় ভুগছিল।’

তিনি আরো বলেন, লবণ উৎপাদনের এখন মৌসুম না হলেও মাঠে মজুদ রাখা লবণ বিক্রি করতে ধুম পড়েছে চাষিদের মাঝে। প্রতি কেজি যে লবণ ৫-৬ টাকাও বিক্রি করতে পারিনি, সেই লবণ এখন ১৫ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছেন চাষিরা। যা চাষিদের জন্য খুবই খুশির খবর। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী মৌসুমে চাহিদার অতিরিক্ত লবণ উৎপাদনের জন্য আঁটঘাট বেধে নামবেন চাষিরা।’

জানা গেছে, চলতি বছরের লবণ উৎপাদন মৌসুম চলাকালীন সময় এপ্রিল মাসে চকরিয়া ও পেকুয়ায় কালবৈশাখী ঝড়ের কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় লবণ উৎপাদন। এতে হাজারো চাষি ক্ষতির শিকারও হন। পুরোদমে লবণ উৎপাদনের শেষমুহূর্তে প্রকৃতির এই বৈরী আচরণে মাথায় হাত উঠেছিল চাষিদের। তবে শেষমুহূর্তে  স্বাভাবিক আবহাওয়ার পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত রোদে লবণ উৎপাদনের জন্য ধুম পড়ে যায় মাঠে মাঠে। প্রখর রোদের মধ্যেও চাষি ও শ্রমিকেরা লবণ মাঠে ব্যস্ত সময় কাটায়।

বাংলাদেশ লবণ চাষি সমিতির যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক ও চকরিয়ার অন্যতম লবণ ব্যবসায়ী হারুণুর রশিদ  বলেন, ‘গেল লবণ উৎপাদন মৌসুমের শেষদিকে প্রাকৃতিক বৈরি আচরণ দেখা দিলেও সরকারের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি লবণ উৎপাদন হয়। তবে বড় বড় লবণ চাষিরা তাদের উৎপাদিত লবণ তখন মিল মালিকদের কাছে বিক্রি না করে মাঠে এবং গোডাউনে মজুদ করে রেখেছিলেন দাম একেবারে কম হওয়ায়। গত কয়েকদিন ধরে লবণের দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে চাষিরা তাদের মজুদকৃত সেই লবণ এখন বেশি দাম পেয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে মিল মালিকদের কাছে। এতে চাষিরা আর্থিকভাবে বেশি স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি আগামী মৌসুমে ব্যাপকভাবে লবণ উৎপাদনের জন্য মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।’

পেকুয়ার মগনামা ইউনিয়নের লবণ চাষি শহীদুল ইসলাম, চকরিয়ার পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের ছমি উদ্দিন, বদরখালীর আকতার আহমদ বলেন, ‘এখন প্রতিমণ লবণ বিক্রি করছি আমরা সর্বোচ্চ ৬শ টাকায়। যা আগেকার সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সরকার লবণ উৎপাদন মৌসুমে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ রাখতে উদ্যোগ নেওয়ায় এর সুফল পাচ্ছেন চাষিরা। যা চাষিদের জন্য অনেকটা আনন্দের খবর।’

এসব চাষি বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে উৎপাদিত লবনের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরে এসেছে। অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে উপকূলের লবণ চাষিরা এখন বেশ উৎফুল্ল। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে গ্রামীণ অর্থনীতিতে।’

তারা আরো বলেন, ‘দেশে ইতিপূর্বে লবণের বাম্পার উৎপাদন হলেও মৌসুম চলাকালীন সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিল মালিক সিন্ডিকেটদের আঁতাতে প্রতিবছর বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করায় এই শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করেন চাষিরা। লবণকে লোকসান পণ্য হিসেবে ধরে নিয়ে অনেকে লবণ চাষ থেকে বিরতও রেখেছেন। তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকারের লবণ নীতি অনুযায়ী দাম যেহেতু বাড়তির পথে সেহেতু এই শিল্প আবারো আলোর মুখ দেখবে।

এ ব্যাপারে কক্সবাজারস্থ বিসিকের জুনিয়র কর্মকর্তা মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘সামনের কোরবানির ঈদের চামড়াজাত পণ্যে ব্যবহারের জন্য লবণের বিপুল চাহিদা রয়েছে। তাই দেশে উৎপাদিত লবণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষিরাও খুশি। বর্ষার সময় লবণ উৎপাদন না হলেও আগে মজুদকৃত লবণ দ্বিগুন দামে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে মাঠপর্যায়ের চাষিরা।’

তিনি আরো বলেন, ‘গেল মৌসুমে প্রকৃতির বৈরি আচরণের কারণে বিসিকের লক্ষ্যমাত্রা অনুযাযী লবণ উৎপাদন ব্যাহত হয়। এ কারণে বিদেশ থেকে মাত্র দেড় লক্ষ মেট্টিক টন লবণ আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন