গরু মোটাতাজাকরণের নামে সক্রিয় অসাধু চক্র, মিয়ানমার থেকে আসছে গবাদিপশু
কক্সবাজার প্রতিনিধি:
সামনে কোরবানির ঈদ। আর কোরবানির ঈদ মানেই কক্সবাজার জেলাজুড়ে পশু বেচাকেনার হিড়িক। এ ঈদ উপলক্ষে দু-এক সপ্তাহ আগে থেকেই চলে গরু, মহিষ, ছাগলসহ বিভিন্ন ধরনের পশু বেচাকেনা। বিশেষ করে কক্সবাজারে কোরবানির জন্য গরুকেই গুরুত্ব দেয়া হয় বেশি। পছন্দের তালিকায় গরু শীর্ষে বলেই এসুযোগের সদ্ব্যবহার করেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।
অধিক মুনাফা লাভের আশায় স্বল্প সময়ে জেলার বিভিন্ন এলাকায় বেশি মোটাতাজা করতে তারা গরুকে খাওয়ান নানা ধরনের ট্যাবলেট এবং মাংসপেশিতে প্রয়োগ করেন নিষিদ্ধ ইনজেকশন, যা গরু ও মানুষ উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন-কৃত্রিমভাবে গরুর মাংসপেশিতে ডেক্সামেথাসন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয় এবং খাওয়ানো হয় স্টেরয়েড গ্রুপের বিভিন্ন ট্যাবলেট। গরুর প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় এ ট্যাবলেট খাওয়ালে। এর ফলে শরীরে পানি জমতে শুরু করে। ফলে গরু মোটাতাজা দেখায়। এ গরু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জবাই না করলে মারা যেতে পারে অথবা এর গোশত কমতে পারে। এমন গরুর গোশত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এসব ওষুধ তীব্র তাপেও নষ্ট হয় না। ফলে মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
এ ধরনের গরুর গোশত খেলে মানুষের কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। অপরদিকে গরু বাজারে বরাবরের মত এবারও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দখলে থাকবে বলে জানা গেছে। তাদের অবৈধ টাকার কাছে গরিব ও মধ্যবিত্তরা অধিক মূল্যে চাহিদামত পবিত্র কোরবানির ঈদের জন্য গরু না পাওয়ারও শঙ্কা রয়েছে। উপজেলা প্রতিনিধিদের পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ঈদুল আযহা তথা কোরবানি বাজারকে সামনে রেখে গরু মোটাতাজাকরণের হিড়িক পড়েছে কক্সবাজারে। এক্ষেত্রে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের নজরদারীর অভাবে এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা সহজে গরু মোতাতাজাকরণ আশঙ্কজনকভাবে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমার ও ভারত থেকে এবারে গরু রপ্তানি কম হওয়ায় এবং মায়ানমার থেকে সীমান্ত বানিজ্যের আওতায় চাহিদা মতো গরু-মহিষ না আসার কারণে স্থানীয়ভাবে গরুর সংকট আকার ধারন করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। যার প্রভাব পড়বে স্থানীয় হাট-বাজার গুলোতে। গরু সংকট দেখিয়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলা মাংস বিক্রি হচ্ছে ৪শ থেকে ৬শ টাকা পর্যন্ত। মাংস বিক্রেতাদের অভিমত কোরবানির বাজারে এবার গরু সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গরু সংকটের এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গরু মোটাতাজাকরণের সাথে জড়িত বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী গৃহপালিত গরু কম দামে ক্রয় করে বিভিন্ন মোটাতাজাকরণ ঔষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে গরু মোটাতাজাকরণ করছে।
বিশেষ করে রামু, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে এ প্রবনতা প্রকট আকার ধারন করেছে বলে জানা গেছে। কক্সবাজার প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে প্রতিটি উপজেলায় মনিটরিং করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কোরবানির বাজারে বিক্রি করে বেশি টাকা মুনাফা লাভের জন্য কক্সবাজারের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী গরু মোটাতাজাকরণ করে থাকে।
বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে গরু মোটাতাজাকরণ প্রসঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্মকর্তা জানান, কোরবানির গরু দ্রুত মোটাতাজা করতে কিছু অসৎ খামারি বিষাক্ত হরমোন ব্যবহার করছে। খামারিদের বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার না করতে সচেতন করা হচ্ছে। কাউকে এসবের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ করিডোর দিয়ে মিয়ানমার থেকে ট্রলারযোগে ঝাঁকে ঝাঁকে গবাধীপশু আমদানি হচ্ছে, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই। ২০০৩ সালে শাহপরীরদ্বীপে করিডোরটি স্থাপিত হয়। পশুর খাত থেকে প্রতি অর্থ বছরে কোটি কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হলেও করিডোরে এ পর্যন্ত উন্নয়নের কোন ধরনের ছোয়া লাগেনী। মিয়ানমার থেকে আমদানি হয়ে আসা। গবাধীপশু শাহপরীরদ্বীপের করিডোরে রোধ বৃষ্টিতে ভিজছে। নেই কোন পশুর আস্থানা। পশুর উপর চলছে, অমানবিক আচরণ। সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় করিডোর দিয়ে পশু আমদানি হলেও, পরীক্ষা নীরিক্ষা ছাড়াই। টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে জাতীয় পণ্য কোয়ারেন্টাইনের মাধ্যমে গুনগতমান পরীক্ষার মাধ্যমে আমদানি হলেও গবাধীপশু আমদানি হচ্ছে, পরীক্ষা ছাড়াই।
জানা যায়, টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে আমদানি হয়ে আসা ৩২ পণ্যের মধ্যে ২টি পণ্যের গুনগতমান নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে ২টি প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা নীরিক্ষার মাধ্যমে ছাড় দিচ্ছে। উদ্ভিদ জাতীয় পণ্য পরীক্ষার জন্য কৃষি কোয়ারেন্টাইন এবং মৎস্যের ক্ষেত্রে মৎস্য প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে শাহপরীরদ্বীপ করিডোর দিয়ে আসা গবাধীপশু ও ছাগলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা নীরিক্ষা করার জন্য কোন ধরণের ব্যবস্থা নেই।
ফলে এ ফাঁকে মিয়ানমার থেকে রোগাক্রান্ত গবাদি পশু ও ছাগল অনায়সে আমদানি হচ্ছে। এসব আমদানিকৃত গবাদিপশু ও ছাগলের মাংস খেয়ে অনেকেই রোগাক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও জেলা, উপজেলা শহরে পৌর শহরে এবং বিভিন্ন হাটবাজারে লাইসেন্স প্রাপ্ত কশাইরাও পশু এবং ছাগলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করেই জবাই করে বিক্রি করছে। পশু লাইসেন্সে যে সব শর্তারুপ করা হয় কশাইরা তাহা কোন মতেই মান্য করছেনা। নিয়মানুযায়ী লাইসেন্সধারী কসাইরা স্ব-স্ব এলাকার পশু সম্পদ দপ্তরের মাধ্যমে পশু ও ছাগল জবেহ করার বিধান থাকলেও এ নিয়ম তারা মানছেননা।
পশুর বাজারে ও কোন মনিটরিংএর নেই। সুতারাং এ সুযোগকে কসাইরা কাজে লাগাচ্ছে। জানা যায়, স্থল বন্দর নিয়ন্ত্রনাধীন করিডোর দিয়ে আসা গবাদীপশু ও ছাগল হন্ডি ও ইয়াবার টাকা দিয়ে আমদানি হচ্ছে। করিডোরের যে ক’জন গবাদিপশু আমদানি কারক রয়েছেন, তার মধ্যে বেশ কয়েকজন ইয়াবা, হুন্ডি ও কালো ব্যবসার সাথে জড়িত। ওদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগে উঠেছে, গবাধী পশুর আড়ালে ইয়াবা ব্যবসা চলছে নীরবে।