সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়ার আশা

fec-image

সুন্দরবনে বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব চিরাচরিত। এই দ্বন্দ্ব নিরসনে সুন্দরবন সংলগ্ন জনগণ নিয়ে গঠন করা হয়েছে ৪৯টি ‘ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম’। এতে বাঘ হত্যা কমেছে কিছুটা। এখন সুন্দরবনের পর্যটন স্পটগুলোতেও দেখা মিলছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। পর্যটকদের ক্যামেরায় ধরা পড়ছে সেই দৃশ্য। আর তা ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে ২০১৪-১৫ সালে বন অধিদপ্তর পরিচালিত জরিপে সুন্দরবনে ১০৬টি বাঘের সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর ২০১৭-১৮ সালের জরিপে ১১৪টি বাঘের সন্ধান পায় বন অধিদপ্তর। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়ে ৮ শতাংশ। চলতি বছর তৃতীয়বারের মতো ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ে মাধ্যমে বাঘ গণনার কাজ শুরু হচ্ছে। এর মাধ্যমে জানা যাবে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা কত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুন্দরবনে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা ও চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য কমায় বাঘের সংখ্যা সবশেষ জরিপে বেড়েছে। এরই মধ্যে বাঘের প্রজনন, বংশ বৃদ্ধিসহ অবাধ চলাচলের জন্য সুন্দরবনের অর্ধেকেরও বেশি এলাকাকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে টহল ফাঁড়ি। পাশাপাশি চোরা শিকারিদের তৎপরতা বন্ধে চালু হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট পেট্রোলিং। বর্তমানে সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে বাঘ দেখতে পাচ্ছেন পর্যটকরা। এছাড়া বন বিভাগের কর্মকর্তারাও আগের তুলনায় বেশি বাঘ দেখছেন। সার্বিক বিবেচনায় বলা যায় বাঘের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। তবে সঠিক জরিপ ছাড়া সেটি নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।

বন বিভাগের তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। এরপর ১৯৮২ সালের জরিপে ৪২৫টি বাঘ পাওয়া যায়। এর দুই বছর পর ১৯৮৪ সালে সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার তথ্য পাওয়া যায়। এরপর ১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ থাকার তথ্য জানায় বন বিভাগ। পরের বছর ১৯৯৩ সালে সুন্দরবনের ৩৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পাগমার্ক পদ্ধতিতে জরিপ চালিয়ে ৩৬২টি বাঘ রয়েছে বলে জানান ধন বাহাদুর তামাং। ২০০৪ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ৪৪০টি। তবে তার আগে ১৯৯৬-৯৭ সালে বাঘের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৩৫০ থেকে ৪০০টি। ওই সময়ে পায়ের ছাপ দেখে বাঘ গণনা করা হয়।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণের জন্য ‘সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’ শীর্ষক প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ গণনা, বয়স ও লিঙ্গ অনুপাতে সুন্দরবনের কম বাঘ সম্পন্ন এলাকায় বাঘ স্থানান্তর, অন্তত দুটি বাঘের শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার স্থাপন ও মনিটরিং করা, বাঘের পরজীবীর সংক্রমণ ও অন্যান্য ব্যাধি এবং এর মাত্রা নির্ণয়, উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ, সুন্দরবনের লোকালয় সংলগ্ন এলাকায় নাইলনের রশির বেষ্টনী তৈরি করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় বন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে আগামী অক্টোবর থেকে সুন্দরবনে শুরু হবে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের কাজ। পাশাপাশি বাঘের খাদ্য হিসেবে বিবেচিত সুন্দরবনে থাকা চিত্রা হরিণ ও শূকরের সংখ্যাও গণনা করা হবে।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো গণমাধ্যমকে বলেন, ২০১৮ সালে যে জরিপ হয়েছে সে আলোকে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি, এরপর আর জরিপ হয়নি। আমাদের পরিকল্পনা আছে। হয়তো আগামী এক বছরের মধ্যে বাঘের জরিপ কার্যক্রম আবার শুরু করবো। আগে অনেক সময় বাঘ লোকালয়ে এলে তাকে পিটিয়ে মারা হতো। এ পরিস্থিতি বিবেচনায় সুন্দরবনসহ ৪৯টি গ্রামের জনগণকে সম্পৃক্ত করে ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে। এখন আর বাঘ পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটে না। এখন লোকালয়ে বাঘ এলে স্থানীয় জনগণ, জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সেগুলোকে আবার ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা স্থানীয় জনগণকে যুক্ত করে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম করেছি। তারা সেখানে ফ্রন্টলাইনার হিসেবে আমাদের সঙ্গে কাজ করেন। কোনো বাঘ যদি লোকালয়ে চলে আসে- তারা যাতে আমাদের খবর দেয়, গ্রামবাসী বাঘটাকে যেন মেরে না ফেলে সেই ভূমিকাটাও তারা পালন করেন। এই জনসম্পৃক্ততার কারণে বাঘ পিটিয়ে মারার ঘটনা কমে এসেছে।

তিনি বলেন, বাঘের সংখ্যা ২০১৮ সালে ১১৪টি পেয়েছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা আছে এবছর থেকে আমরা তৃতীয়বারের মতো ক্যামেরা ট্র্যাপিং শুরু করবো। সেটা করতে পারলে হয়তো বাঘের সংখ্যা জানা যাবে। এমনিতে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব পর্যটক সুন্দরবনে গেছেন তারা অনেকে বাঘ দেখেছেন, সেটা (ছবি পোস্ট করতে) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে। কিন্তু তার ওপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি না বাঘের সংখ্যা বেড়ে গেছে । এটার একটা বৈজ্ঞানিক তথ্য লাগবে। এটা এ বছর শুরু করতে পারলে ২০২৩ সালে না হলেও ২০২৪ সালে আমরা হয়তো আরেকটি রেজাল্ট দিতে পারবো। সেখানে নির্দিষ্ট করে বলতে পারবো বাঘের সংখ্যা বেড়েছে কী কমেছে। আমরা আশা করছি হয়তো বাড়বে, কিন্তু স্ট্যাডি না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি বলতে পারছি না।

২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ সমৃদ্ধ ১৩টি দেশের সরকার প্রধানদের সম্মেলনে বাঘ সংরক্ষণকে বেগবান করার জন্য এক ঘোষণাপত্র তৈরি হয়। তার আলোকেই প্রতি বছর ২৯ জুলাই ‘বিশ্ব বাঘ দিবস’ পালন করা হয়। তবে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফের তথ্য অনুযায়ী বাঘ সমৃদ্ধ ১৩টি দেশের মধ্যে কম্বোডিয়া, লাও পিডিআর এবং ভিয়েতনামে বাঘ স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

২৯ জুলাই বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালন করা হলেও প্রাকৃতিকভাবে বাঘ টিকে আছে এমন দেশগুলোতে গুরুত্ব সহকারে দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘বাঘ আমাদের অহংকার, রক্ষার দায়িত্ব সবার’। এবছর বাঘ দিবস উপলক্ষে ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে বন অধিদপ্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় আলাদা চারটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

বাঘ হত্যা বন্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ৩৬ ধারায় বাঘ হত্যার জন্য সর্বনিম্ন ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে এই অপরাধে সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড হতে পারে। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড হতে পারে। এই আইনের ৩৬ ধারা অনুযায়ী বাঘ হত্যা জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া বাঘ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান (২০১৮-২০২৭) প্রণয়ন করা হয়েছে।

সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ, বাঘ ও শিকারি প্রাণী পাচার বন্ধ, মনিটরিং ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক এবং প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ এবং বংশ বিস্তারের লক্ষ্যে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও সুন্দরবনে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী শিকার প্রতিরোধে বন বিভাগের সঙ্গে পুলিশ, র্যাব, কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশ সমন্বিতভাবে কাজ করছে।

এদিকে, মাঠ পর্যায়ের বনকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বনদস্যুর সঙ্গে সংগ্রাম করে সুন্দরবন ও বাঘ রক্ষা করছেন। তাদের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে সরকার বনকর্মীদের ৩০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা দিচ্ছে। এছাড়াও বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে বাঘের আক্রমণে নিহত বা গুরুতর আহত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। ‘বন্যপ্রাণীর আক্রমণে জানমালের ক্ষতিপূরণ বিধিমালা-২০২১’ অনুযায়ী বর্তমানে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে তিন লাখ এবং আহত ব্যক্তির পরিবারকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। জেএন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন