পার্বত্য চট্টগ্রামে আমি নিজেই নিরাপদ নই- সন্তু লারমা

IMG_3403

স্টাফ রিপোর্টার:

“পার্বত্য চট্টগ্রামে বহুবিধ প্রশাসন ও কর্তৃত্ব চলছে যেটাকে এককথায় অরাজকতা বলা যেতে পারে। সেখানে কোন শৃঙ্খলা নেই। সেখানকার কোন মানুষের নিরাপত্তা নেই। আমি নিজেই নিরাপদ নই। পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো কিছুটা বাস্তবায়িত হলে হয়তো আমরা কিছুটা শান্তিতে থাকতাম। কিন্তু কবে এমন পরিস্থিতি আসবে তা জানিনা”। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৮ বছর: স্থানীয় জনগণের অধিকার ও বাস্তবতা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও কাপেং ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় আজ বিকাল ৩ টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারের দি ডেইলি স্টার ভবনের এ এস মাহমুদ সেমিনার হলে আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এসময় তিনি আরো বলেন, “পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে সরকারের অনেক কর্তাব্যক্তি, নীতিনির্ধারক মহলের অনেক জন এবং অনেক সংগঠনের অনেক ব্যক্তিরা প্রায় সময়ই খুবই দৃঢ়ভাবে বক্তব্য ও অঙ্গীকার দিয়ে থাকেন। কিন্তু কেন তাহলে গত ১৮ বছর ধরে চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হয়নি। এই বিষয়ে সরকারের নীতি নির্ধারকেরা সচেতন নয় এটাও বলবোনা, কিন্তু তাদের আদর্শ কি? সেটা বিবেচ্য বিষয়। চুক্তির ব্যাপারে নীতি নির্ধারকেরা উগ্র জাতীয়তা, সম্প্রদায়িক, প্রগতি বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত ক্রিয়াশীল হওয়ার কারণে আজও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে ন “।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, “আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সেনাবাহিনী আছে তাদের বহুবার জিজ্ঞেস করেছি আপানাদের আসলে দায়িত্বটা কি? আমি যতদূর জানি লিখিতভাবে বলা আছে সিভিল প্রশাসনকে সহায়তার জন্যে অপারেশন উত্তরণ নামে সেনাবাহিনী সহায়তা করবে। কিন্তু আদতে কি তারা সহায়তা করছে নাকি তারাই সবকিছু করছে”।

সন্তু লারমা বলেন, “আজকে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ে বাঙ্গালি-আদিবাসী সংখ্যা সমান হয়ে গেছে। কিন্তু এত দ্রুত পাহাড়ের এই সংখ্যাগত পরিবর্তনের কারণ কি? রাজনৈতিক কারণেই এই পরিবর্তন করা হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন”।

পর্যটনের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে আদিবাসীদের জমি দখল হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করে বলেন, “সেনাবাহিনী পর্যটন করছে তাও নিজের জায়গার বাইরে। কেন তারা সেনাবাহিনীর তার বরাদ্দের বাইরে পর্যটন করবে। পর্যটনের কারনে পাহাড়ের মানুষের পারিবারিক, সামাজিক জীবন অত্যন্ত বিপর্যয়ের দিকে যাবে”।

তিনি আরো বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার কাছে ১লা এপ্রিল চুক্তির কোন কোন বিষয় বাস্তবায়িত হয়েছে সেই সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটির কোন পুনরুত্তর আমরা পাইনি”। চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটিকে আরো কার্যকর করার আহ্বান জানান তিনি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা এর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, চাকমা সার্কেলের চীফ ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায়, সাবেক তথ্য কমিশনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা মঙ্গল কুমার চাকমা এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা।

চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই- গওহর রিজভী

প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. গওহর রিজভী বলেন, “চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি এটা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। তবে চুক্তির ধারা বাস্তবায়নের সংখ্যা হিসেব না করে বস্তুনিষ্টভাবে চুক্তিটি বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটাই মূল বিষয়। বিদেশীদের পাহাড়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় এর কোন নির্দেশনা নেই। তবে জেলা প্রশাসনদের জানাতে হয়। কারণ তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি জরুরী”।

তিনি আরো বলেন, “চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সময়সূচী ভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষণা করে এগুনোর কোন বিকল্প নেই”। এ নিয়ে তিনি সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ আলোচনা করবেন বলে জানান। এর পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে দ্রুত যোগাযোগের জন্য ঢাকায় একটি স্থায়ী লিয়াজো অফিস করার অনুরোধ জানান।

পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি সরকার ব্যবস্থা চালু আছে- ড. মিজানুর রহমান

প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান বলেন, “চুক্তি করে চুক্তি প্রতিপালন না করা কোন সভ্যতা নয়। যদি এরকমটি করা হয় তবে সেটি হবে লজ্জার বিষয়। আমি মনে করি ভূমি মালিকানার সমস্যাটি পার্বত্য চট্টগ্রামের এক নম্বর সমস্যা। এছাড়াও পাহাড়ী-বাঙ্গালি সম্প্রীতি, পাহাড়ী নারীদের প্রতি সহিংসতা; পাহাড়ে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির হার, ব্যবসার মালিকানা বাঙ্গালিদের হাতে চলে যাওয়া বিষয়গুলো অত্যন্ত উদ্বেগজনক”।

তিনি আরো বলেন, “পাবর্ত্য চট্টগ্রামে তিনটি সরকার ব্যবস্থা চালু আছে। একটি সন্তু লারমার সরকার, দ্বিতীয়টি সামরিক সরকার এবং তৃতীয়টি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণ অবিলম্বে প্রয়োজন”। তিনি
প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। শক্তি দিয়ে বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কোথাও কোন শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। পাহাড়ে সামরিক শাসন বন্ধ করে সকলকে নিয়ে মেলবন্ধন কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে”।

ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কার্যত কোন কাজ করছে না- দেবাশীষ রায়

চাকমা সার্কেল চীফ রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষের প্রতি হিংসামূলক বা বৈষম্যমূলক আচরণ বজায় আছে। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কার্যত কোন কাজ করছেনা? চুক্তি অনুযায়ি যে টাস্কফোর্স হয়েছে তাতে ভারত প্রত্যাগতদের কিছুটা পুনর্বাসন করা হলেও অভ্যন্তরীন উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কোন উদ্যোগই হয়নি। তাদের একটু পরিমাণ জলও দেওয়া হয়নি”।

তিনি বলেন, “আদিবাসীদের প্রতি সরকারের নানা বৈষম্যমূলক আচরণই বলে দিচ্ছে শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন আদিবাসীদের দেবে কি দেবে না? সরকার ভাবছে চুক্তি বাস্তবায়িত হলে বাঙ্গালিরা কি পাবে? তাই আদিবাসীদের দমিয়ে রাখার জন্য সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি বসাচ্ছে। যেখানে পুলিশের প্রয়োজন সেখানে  সামরিক বাহিনী কেন? পার্বত্যদের প্রথাগত রীতি ও সংস্কৃতি সামরিক বাহিনী কতটুকু বোঝে”?

আদিবাসীদের রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়গুলোই অধিক জরুরী- ড. সাদেকা হালিম

প্রফেসর ড. সাদেকা হালিম বলেন, “১৯৯৭ সালে পার্বত্য অঞ্চলে যে চুক্তি হয়েছে তার মাধ্যমে সেখানকার মানুষদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠভাবে কতটুকু শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা আজ আমরা দেখছি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন দিয়ে শুধু আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে কিন্তু তাদের রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়গুলোই অধিক জরুরী”।

পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তা ক্যাম্প প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বসিয়ে পার্বত্য মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনে সরকার কতটুকু স্থান উন্মুক্ত রেখেছে। ২০১০ সালে সরকার ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠিদের জন্য সাংস্কৃতিক যে আইন করেছে তার মধ্যেও গোপনীয়তা কাজ করছে। নৃ গোষ্ঠিদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকারের দ্বৈতচরিত্র আর দেখতে পাই। “।

পাহাড়ীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠন করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, “পর্বত আর সমতলের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়ে প্রথাগত ঐতিহ্য হিসাবে পাহাড়িদের ভূমির মালিকানা দাবির সাথেও একাত্ত্বতা প্রকাশ করছি। যেহেতু সরকার চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশে বহুতত্ত্ববাদ স্বীকার করেছে সুতরাং বাস্তবায়ন তাকে করতেই হবে”।

চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে- মঙ্গল কুমার চাকমা

মূল প্রবন্ধে মঙ্গল কুমার চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে সরকার দাবি করলেও সত্যিকার অর্থে চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।

চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এজন্য আইনী ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন বিষয় ও কার্যাবলী হস্তান্তর ও কার্যকরকরণ এবং এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিতকরণ; এক্ষেত্রে নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন করা; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা; তজ্জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা; সেনা শাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা; পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চরিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ (১৯৯৮ সালে সংশোধিত) ইত্যাদি আইনগুলোকে কার্যকর আইন হিসেবে সংবিধানের প্রথম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা; সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন ইত্যাদি।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক মিসেস সাহিন আনাম বলেন, “মেজরিটিদের অধিকার নিশ্চিত হলেও আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে সরকারের নিরবতা প্রশ্নবিদ্ধ? আদিবাসীদের ধর্ষণ করলে স্থানীয় পর্যায়তো নয়ই স্বয়ং হোমমিনিষ্টার পর্যন্ত ধর্ষকদের তালিকা পাঠিয়েও কোন ফলাফল পাওয়া যায় না। আদিবাসীরা এখনো এদেশে স্বাধীন না। সরকারই স্বয়ং তাদের পরাধীন করে রেখেছে”।

শুভেচ্ছা বক্তব্যে কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা প্রশ্ন রাখেন, “শান্তিচুক্তির পর প্রধানমন্ত্রী ইউনেস্কো পুরস্কার পেয়েছে আর আদিবাসীরা পেয়েছে কি”?

এছাড়াও মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মোহাম্মদ আলী, মুক্তাশ্রী চাকমা সাথী, রোজলিন কস্তা, ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, ড. ওবায়দুল হক প্রমুখ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন