পাহাড় থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা-সংস্কৃতি
পার্বত্য জেলা বান্দরবানে সকল জনগোষ্ঠীর মাঝে মেলবন্ধন থাকায় এই জেলাকে সম্প্রীতির জেলাও বলা হয়। এই জেলায় ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী তারা নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলেন। তাদের রয়েছে নিজ নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
চাকমা, মারমা, মুরং, ত্রিপুরা, লুসাই, খুমি, বম, খেয়াং, চাক, পাংখোয়া ও তঞ্চঙ্গ্যা এদের সকলেই বান্দরবান জেলায় বসবাস করেন। এ জেলায় বসবাসরত নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর রয়েছে আলাদা আলাদা নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পোশাক পরিচ্ছদ ও বর্ণমালা। নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ভাব আদান প্রদানের জন্য তারা ব্যবহার করে থাকেন নিজস্ব মাতৃভাষা ও শব্দ। অনেক রীতিনীতি, কৃষ্টি, সামাজিক জীবনাচার ও গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে মহামান্বিত ও বৈচিত্র্যময় করেছে। কিন্তু সংরক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় এসব নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক শব্দ দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। যার কারণে লিখতে কিংবা পড়তে পারছে না অনেকেই। মাতৃভাষা পাঠ্যপুস্তক না থাকাতে কেবল বাংলা ছাড়া নিজের মাতৃভাষা লেখাটাও পড়তে পারছে না তারা। এ বিষয়ে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নেতারা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রক্ষার্থের যার যার মাতৃভাষার সংরক্ষণের পাশপাশি বই প্রকাশের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান।
বান্দরবানের থানচি, রুমা, আলীকদমসহ সাত উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বেশীর ভাগই মারমা, মুরুং ,বম ও তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের একমাত্র প্রধান উৎস জুম চাষ। সারাবছর জুম চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন ফলমূল চাষ করে তাদের সংসার চলে। দুর্গম এলাকার বসবাসরত অভিভাবকরা সন্তানদের শিক্ষিত করা জন্য পাহাড় ছেড়ে পাঠিয়ে দেয় শহরে। পাহাড়ের সন্তানদের মাঝে শিক্ষার অগ্রগতি বাড়লেও পিছিয়ে পড়ে নিজের মাতৃভাষা শিক্ষা থেকে। নিজস্ব মাতৃভাষা পাঠ্যপুস্তক না থাকায় শিখতে পারছেন না নিজ মাতৃভাষার বর্ণমালা। যার কারণে নিজেদের মাতৃভাষা বর্ণমালা জানা কিংবা শিখানো থেকে পিছিয়ে পড়ে যায় পাহাড়ের বসবাসরত নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, বাংলার ভাষা পাশপাশি ২০১৭ সালে পার্বত্য এলাকায় চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এই তিন জাতিগোষ্ঠীর জন্য পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে সরকার। বর্তমানে সে ধারাবাহিকতা এখনো চলমান। চলতি বছরে বান্দরবান জেলায় তিন জাতিগোষ্ঠীর ৯ হাজার শিক্ষার্থীর মাঝে ২০ হাজার ৪২০টি মাতৃভাষা বই বিতরণ করা হয়। কিন্তু শিক্ষকের অভাবে মাতৃভাষা বইটি পড়তে পারছেন না শিক্ষার্থীরা।
অন্যদিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট অর্থায়নের ১১টি জাতির মাতৃভাষা তুলে ধরতে বিভিন্ন সময়ে নিয়েছেন নানা উদ্যেগ। এই পর্যন্ত ১০টি জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তুলে ধরা হচ্ছে দশটি জাতির মাতৃভাষা বর্ণমালা। শুধু তাই নয়, ওই প্রতিষ্ঠানে মাতৃভাষা বর্ণমালা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ। তাছাড়া অধিকাংশ পাহাড়ের জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পোশাক, পরিচ্ছেদ সংরক্ষণ করতে পরামর্শ ও বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্যোগ নিয়ে থাকেন কেএসআই।
বান্দরবানের পাহাড়ের আরো একটি ভাষা রেংমিটচ্যা। এ ভাষা জানেন মাত্র ছয়জন। দুজন নারী, চারজন পুরুষ। সবার বয়স ষাটের ঊর্ধ্বে। থাকেন বান্দরবানের আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে। তাঁরা যে ভাষায় কথা বলেন এর নাম ‘রেংমিটচ্য’। গোটা পৃথিবীতে এই ভাষা জানা জীবিত মানুষ এখন তাঁরা এই ছয়জনই। এই মানুষগুলো মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে রেংমিটচ্য ভাষাটি। কিন্তু এই ছয়জনের জানা থাকা মাতৃভাষা ও বর্ণমালাকে ভাষা বাঁচাতে এক তরুণ লড়াই করছে। তিনি রেংমিটচ্যভাষী মাংপুন ম্রোর ছেলে ‘সিংরা ম্রো’। এরই মধ্যে ম্রো ভাষা লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো সহযোগিতায় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শ্রুতির আড়ালে থাকা মাতৃভাষা ও বর্ণমালাকে বাঁচাতে শুরু হয়েছে রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম। ম্রো জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের নিয়ে গত বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে চলছে এই কার্যক্রম। তাই রেংমিটচ্যা ভাষা জানা বয়স্করা মারা গেলেও যাতে ভাষাটি না হারায় এমন উদ্যোগ নিয়েছে সিংরা ম্রো নামে এক তরুণ।
পাহাড়ের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জনগণ জানিয়েছেন, দুর্গম পাহাড়ি জনপদে অধিকাংশ মারমা, ম্রো ও বম সম্প্রদায়ের বসবাস। সবাই জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে নিজেদের বাগানে ফল-ফলাদি বিক্রি করতে আসেন বাজারের। কিন্তু নিজের মাতৃভাষা ছাড়া বলতে পারেন না অন্যভাষা। তাছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে মুরুং ও বম সম্প্রদায় শিক্ষার দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে। অনেকেই এখনো ভাল করে বাংলা বলতে পারে না। তার উপর নিজেদের ভাষার কোন বই না থাকায় ভুলতে বসেছে নিজেদের মাতৃভাষা লেখা। তারা বলছেন ছোটবেলা থেকে নিজের মাতৃভাষা বর্ণমালা না শেখালে হারিয়ে যাবে নিজের গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। পাহাড়ের সকল জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন অনেকেই। অন্যথায় সকল জনগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়বে বলে এমনটাই ভাবছেন বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নেতারা।
আলীকদমের দুর্গম এলাকার ক্রাসিং পাড়া বাসিন্দা সিংরা ম্রো বলেন, ‘রেংমিটচ্য আমাদের পূর্বপুরুষদের ভাষা। কিন্তু এখন বাবা ছাড়া মাত্র পাঁচজন ভাষাটি বলতে পারেন। তাই তাঁরা জীবিত থাকতেই এমন উদ্যোগ নিয়েছি, যাতে বয়স্করা মারা গেলেও ভাষাটি না হারায়।
পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য সিয়ং ম্রো বলেন, পাহাড়ের সব থেকে পিছিয়ে রয়েছে আমাদের ম্রো সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী। শিক্ষাদীক্ষা ও ভাষাগত দিক থেকেও। তাছাড়া ম্রো ভাষা বর্তমানে যে বর্ণমালা আবিষ্কার হয়েছে সেটা এখনো সরকারিভাবে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়নি। তাই পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করার দাবি জানান তিনি।
ভাষা প্রযুক্তিবিদ সমর এম সরেন জানান, পাহাড়ের যে কয়টি মাতৃভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে সেগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য গ্রামের সচেতন ব্যক্তি কিংবা সকলকে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। তবেই ভাষা কিংবা বর্ণমালা যুগের পর যুগ টিকে থাকবে।
বান্দরবান জেলা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান জানান, পার্বত্য এলাকায় এই পর্যন্ত তিন জাতিগোষ্ঠী চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা মাতৃভাষার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে। আশা করছি যে, সরকারি উদ্যোগে আরো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ের পাশাপাশি শিশুদের মাঝে মাতৃভাষা পাঠদান দিতে সক্ষম হব।