কুকি-চিন কি শুধুই বম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদ?

fec-image

পাহাড়ে কুকি-চিন জাতীয়তাবাদের ধারণাকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে বান্দরবানের রুমা ও থানচির গত কয়েকদিনের ঘটনাবলি। সরকারি দুই ব্যাংকের তিন শাখায় ডাকাতি ও থানায় গুলি চালানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে।

রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের নয় উপজেলায় বসবাসকারী ছয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের দাবি তোলা সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন নাথান বম নামে এক ব্যক্তি। এছাড়া সংগঠনটি মূলত বমদের মধ্য থেকেই সদস্য রিক্রুট করছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে।

বমরা মিয়ানমারের চিনভিত্তিক লাই জনগোষ্ঠীর (মিয়ানমারে চিন ও ভারতে পাওয়ি নামে পরিচিত) অন্তর্ভুক্ত। উৎপত্তি মিয়ানমারে হলেও সেখানেই এখন সবচেয়ে কমসংখ্যক বমদের দেখা পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এদেশে। বাংলাদেশে বমদের মোট জনসংখ্যা ১৩ হাজার ১৯৩ বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্যে উঠে এসেছে। এছাড়া অন্যান্য সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ১০ হাজার ও মিয়ানমারে আড়াই হাজার বম জনগোষ্ঠীর সদস্য বসবাস করছে। তিন দেশ মিলিয়ে বম জনগোষ্ঠীর মোট সদস্য সংখ্যা কম-বেশি ২৬-২৭ হাজার। লাই জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এমন আরো কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে নতুন একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের দাবি তুলেছে কেএনএফ। এর ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে কুকি-চিন জাতীয়তাবাদের ধারণাকে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেএনএফের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের ছয়টি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। এগুলো হলো বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি। রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম—এ নয় উপজেলা নিয়ে আলাদা স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের দাবি তুলেছে তারা।

সংগঠনটির কুকি-চিন জাতীয়তাবাদী ধারণাকে সামনে নিয়ে আসার সম্ভাব্য কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নৃবিজ্ঞানীরা বলছেন, বম জনগোষ্ঠী সংখ্যার দিক থেকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। আরো বৃহৎ পরিসরে কার্যক্রম চালানো এবং সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্য থেকেই কেএনএফের মতো সংগঠনগুলো এখন কুকি-চিন গোত্রভুক্ত নৃগোষ্ঠীগুলোর সম্মিলিত জাতীয়তাবাদী ধারণাকে সামনে নিয়ে আসছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসান আল শাফী বলেন, ‘‌এখানে শুধু বম না, এখানে আরো কিছু কমিউনিটিও আছে। কিছুদিন আগে ভারতের মণিপুরে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দিল। সেখানেও কিন্তু কুকি-চিন একটা আলাদা গ্রুপ ছিল, যাদের সঙ্গে মণিপুরিদের সংঘর্ষ হয়েছে। তারা সেখানেও কুকি-চিন জাতীয়তাবাদের ধারণাকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। উভয় জায়গায়ই তাদের বক্তব্য হলো তারা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমাদের এখানে যেটা হয়েছে, পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর যে আঞ্চলিক পরিষদটা হয়, সেখানে বিভিন্ন কমিউনিটি থেকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকে। এতে বম, খুমি, পাংখোয়াসহ স্থানীয় ছয় কমিউনিটি থেকে একজন প্রতিনিধি রাখা হয়। এটা নিয়ে তাদের বিশেষ করে বমদের বক্তব্য হলো জনসংখ্যা কম হওয়ায় ছয়টা কমিউনিটি থেকে মাত্র একজন প্রতিনিধি নেয়া ঠিক হয়নি। তারা জনসংখ্যা অনুযায়ী কম হলেও প্রত্যেকেই আলাদা জাতিসত্তা। সংস্কৃতি, ধর্ম ও জীবনচর্চাও আলাদা। তাদের বক্তব্য ছিল যে প্রতিটি কমিউনিটি থেকে একজন করে রাখা উচিত।’

তিনি আরো বলেন, ‘‌তারা বিভিন্নভাবে ইস্যুটাকে সাংস্কৃতিকভাবে লালন করে এসেছে। কুকি-চিন নাম দেয়ার কারণ হতে পারে, এর মধ্য দিয়ে তারা হয়তো একটি বৃহত্তম প্লাটফর্ম তৈরি করতে পারবে। কুকি-চিন বার্মাতেও আছে, ভারতের মিজোরাম, মণিপুর, ত্রিপুরা—এসব জায়গায়ও কুকি-চিন ভাষাভাষী আছে। সেজন্য বমরা সংখ্যায় মাত্র কয়েক হাজার হলেও এটা যখন কুকি-চিন নাম দেয়া হবে, তখন তা সংখ্যায় বেড়ে যাবে। অন্যান্য কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেও তারা হয়তো বড় একটা সমর্থন পাবে। সেক্ষেত্রে তাদের পক্ষে হয়তো প্রতিবেশী দেশের এ ভাষাগোষ্ঠীর আওতাভুক্তদের মোবিলাইজ করা যাবে। সেজন্যই হয়তো তারা কুকি-চিন নাম দিয়ে রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি করেছে।’

এ মুহূর্তে পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে কেএনএফকে নিয়েই আলোচনা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় গত মঙ্গল ও বুধবার ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে সরকারি দুই ব্যাংকের তিন শাখায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। দুটি শাখা সোনালী ব্যাংকের, আরেকটি কৃষি ব্যাংকের। রুমায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি হয় মঙ্গলবার রাতে। আর থানচিতে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি হয় বুধবার দুপুরে। এর পর বৃহস্পতিবার রাতে থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলির ঘটনা ঘটে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, এসব ঘটনায় পাহাড়ের সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

বমদের আদি নিবাস মিয়ানমারের চিন প্রদেশে। কথিত আছে, অনেক বছর আগে এ রুং ত্লাং পর্বতের এক গুহায় বসবাস করত তিন ব্যক্তি—বমজো, খেংলত ও তুয়ানপুং। এক সময় তারা তিনজন গড়ে তুলেছিল তিনটি ভিন্ন গ্রাম। এ তিনজনকে দেখা হয় তিনটি ভিন্ন গোত্রের আদিপুরুষ হিসেবে।

তাদের মধ্যে বমজোর গড়ে তোলা গ্রামটির নাম ছিল তিফুল। এ স্থানটিকেই এখন চিহ্নিত করা হচ্ছে বম বা বমজোদের (বাংলাদেশে বম জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত) আদি নিবাস হিসেবে। গ্রামটির প্রতিষ্ঠাতা বমজোর উত্তরসূরিদের বড় একটি অংশ পরে চিনের পার্বত্য এলাকা থেকে মিজোরামের লুসাই পাহাড়ি এলাকা হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে বসবাস শুরু করেছিল।

বমরা কবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে বসবাস শুরু করে, সে বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য তেমন একটা পাওয়া যায় না। এমনকি মিয়ানমারের চিন প্রদেশে বমজো প্রতিষ্ঠিত তিফুল গ্রামেও এখন কোনো বম জনগোষ্ঠীর সদস্যের বসবাস নেই। যদিও সেখানকার বর্তমান স্থানীয়রাও স্বীকার করেন, গ্রামটি বমদের আদিপুরুষ বমজোই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বহু বছর আগে বম জনগোষ্ঠীর লোকেরা গ্রামটি ছেড়ে চলে যায়। কোনো কোনো সূত্রের দাবি, গোটা চিন প্রদেশেই এখন বমদের তেমন একটা দেখা পাওয়া যায় না।

এমনকি চিন প্রদেশ থেকে কী কারণে তারা চট্টগ্রামে এসেছিল সে বিষয়েও স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। মিজোরাম-মণিপুরের লুসাই পার্বত্য অঞ্চলে প্রথম অভিবাসন গ্রহণকারী জনগোষ্ঠীগুলোর একটি হলো বমজো। ধারণা করা হয়, তারা লুসাইয়ে প্রবেশ করেছিল মধ্য মিজোরামের শহর লুংলেইয়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে। এরপর সেখান থেকে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী শহর ত্লাবুং হয়ে তাদের বড় একটি অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে বসবাস শুরু করে।

সূত্র: বণিক বার্তা
Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কেএনএফ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, পার্বত্য চট্টগ্রাম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন