বাংলাদেশের একটি বিপন্ন ভাষার গল্প

fec-image

বিখ্যাত জার্মান নৃবিজ্ঞানী লরেন্স জি লফলার (১৯৩০-২০১৩) বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন ১৯৫৫-৫৬ সালে । তিনি মূলত বান্দরবান জেলার মুরং বা ম্রো সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব সিয়া-সাত প্লাই (গো-হত্যা উৎসব নামে পরিচিত ) নিয়ে গবেষণার কাজে বাংলাদেশে আসেন। এই উৎসব সম্পর্কে তিনি আগেই কোনো ভাবে জেনে থাকবেন। লফলার পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠী ও তাদের সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তার মৃত্যুও এক বছর (২০১৩) পূর্বে গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় এথনোগ্রাফিকস নোটস অন ম্রো এন্ড খুমি অফ চিটাগাং এন্ড আরাকান হিল-ট্রাক্টস (২০১২) শিরোনামে।

ক্লাউস ডিটার ব্রাউনস এবং লরেন্স জি লফলার যৌথভাবে ‘ম্রো: হিল পিপল অন দা বর্ডার অব বাংলাদেশ’ নামে তাদের গবেষণার বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন ষাটের দশকে। ১৯৮৬ সালে বই আকারে এটি প্রকাশিত হয়। এটি মূলত একটি চিত্রগ্রন্থ (pictorial book)। বর্তমানে এটি আমাজানের দুষ্প্রাপ্যগ্রন্থ তালিকায় স্থান পেয়েছে। নৃবিজ্ঞানী লফলারের ভাষা সম্পর্কে গভীর আগ্রহ ছিল এবং ভাষাবিজ্ঞানে তিনি প্রশিক্ষিতও ছিলেন। নৃবিজ্ঞানী হলেও ভাষাবিষয়ক গবেষণা করতে পছন্দ করতেন। তাই প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাষাবিষয়ক বেশ চমৎকার কিছু লেখা লিখেছিলেন। লফলারের গবেষণা অঞ্চলের মধ্যে ম্রো অধ্যুষিত লামা ও আলিকদম অন্তর্ভুক্ত ছিল যা বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চল। তিনি সেখানে যখন মাঠ-পর্যায়ে উপাত্ত সংগ্রহের কাজ করছিলেন তখন হঠাৎ করেই লক্ষ্য করেন ম্রোদের মধ্য কিছু মানুষ রয়েছে যাদের সাথে ম্রোদের সাংস্কৃতিক অভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও তারা আলাদা একটি ভাষায় কথা বলে। এই ভাষার নামই রেংমিটচা (Rengmitca) । ক্লাউস ডিটার ব্রাউনস ছিলেন একজন চিত্রগ্রাহক। এরপর একাধিক বার লফলার পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন এবং আশির দশকে তাদের প্রকাশিত ওই চিত্রগ্রন্থের (pictorial book) লিখিত অংশে তিনি পুনরায় রেংমিটচা ভাষার কথা উল্লেখ করেন। পঞ্চাশের দশকে এ ভাষার কতজন ভাষী ছিল তা তিনি আর উল্লেখ করতে পারেননি। তবে তার দ্বিতীয় বর্ণনায় তিনি এ ভাষার মৃত্যু হয়েছে বলে অনুমান করেন। যদিও তখন এ ভাষার মৃত্যু আসলে হয়নি।

২. রেংমিটচার সন্ধানে

রেংমিটচারা বাস করে আলিকদম উপজেলা থেকে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার ভেতরে সীমান্তবর্তী এলাকায়। দুর্গম এলাকা। হেটে এবং বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া যারাব পথ নেই। এই শতাব্দীর প্রথম দিকে রেংমিটচাদের ভাষীর সংখ্যা ছিল ৩০ জনের মতো। ক্রমে ক্রমে এই সংখ্যা কমতে থাকে। কারণ বয়ষ্ক মানুষদের মৃত্যু। ১৯৯৯ সালে আমেরিকান ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড পিটারসন পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি-চিন ভাষাগুলোর উপর প্রাথমিক গবেষণার কাজ করতে ফেলোশিপ নিয়ে প্রথম বাংলাদেশে আসেন। এরপর থেকে তিনি গবেষণার কাজে নিয়মিত বাংলাদেশে আসতে থাকেন। প্রথমে জার্মানির লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাক্সপ্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর এনথ্রোপলোজির পোস্ট ডক্টোরেট গবেষক হিসেবে এবং পরে আমেরিকার ডার্মাথ কলেজে ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেবার পর যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সাইন্স ফাউন্ডেশন তাকে অর্থায়নে সহায়তা করে। লোফলারের পর রেংমিটচা ভাষা নিয়ে আর কেউ গবেষণা করেনি এবং অন্যরা ভুলে গিয়েছিল যে এই নামের একটি ভাষা বাংলাদেশে আছে। কেউ কেউ ভেবেছিল ভাষাটি হারিয়ে গেছে। এরপর ২০০৯ সালে ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড পিটারসন বান্দরবান আসেন এবং ম্রো ভাষা নিয়ে একজন ভাষা-পরামর্শকের সাথে আলোচনা শুরু করেন। তখন তিনি জানতে পারেন যে, ম্রোদের মধ্যে কিছু মানুষ অন্য আরেকটি ভাষায় কথা বলে। সেই লোকগুলো আলিকদমে বসবাস করে এবং ভাষাটি সম্ভবত রেংমিটচা। এর এক সপ্তাহ পরে তিনি একটি দল নিয়ে আলিকদমে যান এবং সেখানে ২ জন বয়স্ক রেংমিটচা ভাষীর সন্ধান পান। ২০১০ সালে তিনি আবার যখন সেখানে যান তখন আরো তিনজন ভাষী পান। ২০১৩ সালে ভাষাবিজ্ঞানী পিটারসন এই ভাষা বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তবে তখন বিষয়টি বাংলাদেশের গবেষকদের জানা ছিল না। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে আমরা নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষার কাজ করতে গিয়ে রেংমিটচা ভাষীদের সংস্পর্শে আসি। সে সময় আমি নিজে আমার গবেষণা সহযোগীদের নিয়ে আলিকদম যাই এবং সেখানে একজন বয়স্ক রেংমিটচা ভাষীর সন্ধান পাই। তার নাম রেংপুন ম্রো। তিনি ছাড়াও আলিকদমের পায়াপাড়াতে আমরা আরো কয়েকজন ভাষীর সন্ধান পাই। রেংমিটচাগণ নিজেদের ম্রো পরিচয় দিয়ে থাকেন, তাদের দৈনন্দিন জীবন-যাপনও ম্রোদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ। সে কারণেও তাদেরকে পৃথক বা সনাক্ত করা কঠিন।

৩. কিভাবে নিশ্চিত হবো যে রেংমিটচা একটি আলাদা ভাষা?

এই ভাষার অস্তিত্ব জানার পর ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড পিটারসনসহ আমরা অনেকবারই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। অনেকে বলেছেন এটা যে ম্রো বা খুমি ভাষার উপভাষা নয় তা কিভাবে নিশ্চিত হলাম?

একটি ভাষা একেবারে আলাদা কিনা তা নির্ণয়ে ভাষাবিজ্ঞানীরা পারস্পরিক বোধগম্যতার একটি মানদণ্ড প্রয়োগ করে থাকেন। এই বোধগম্যতা মানদণ্ড দিয়েই নিশ্চিত হওয়া যায় লক্ষ্য ভাষাটি উপভাষা নাকি সম্পূর্ণ আলাদা একটি ভাষা। যখন আমরা রেংমিটচা ভাষার সঙ্গে খুমি কিংবা ম্রো ভাষার তুলনা করেছি তখন এই দুই ভাষাভাষীর পারস্পরিক বোধগম্যতা খুঁজে পাইনি। লফলার প্রাথমিক ভাবে রেংমিটচা ভাষাকে মায়ানমারের ম্রো, খুমি (আওয়া খুমি) ভাষার একটি বৈচিত্র্য বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু পিটারসন তার মায়ানমারের একজন সহকর্মীর মাধ্যমে ম্রো, খুমি ভাষার সঙ্গে রেংমিটচা ভাষার পারস্পারিক বোধগম্যতার মানদণ্ড প্রয়োগ করলে দুটি ভাষা আলাদা বলে প্রমাণিত হয়েছে। পরে আমরা নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় প্রাপ্ত এই তিন ভাষার উপাত্ত নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে যে তুলনামূলক টেবিল তৈরি করি সেখানেও সাদৃশ্যের চেয়ে অমিলই বেশি পেয়েছি। এমনকি এক্ষেত্রে রেকর্ডারের ব্যবহার করে ম্রো ও খুমিদের শোনানো হয়েছে যাতে তারা কতটুকু বোঝে তা নিশ্চিত হওয়া যায়। এভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে রেংমিচটা একটি সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা। তবে এ সিদ্ধান্তের সমাপ্তি টানতে বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

৪. রেংমিটচা ভাষা প্রসঙ্গে

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাসমূহের মধ্যে বেশ কিছু ভাষা তিব্বতি-বর্মি ভাষা-পরিবারভুক্ত। তিব্বতি-বর্মি ভাষা পরিবার একটি বৈচিত্র্যময় ভাষাপরিবার। এ ভাষা-পরিবারের ভাষাগুলো উত্তর-ভারত থেকে পূর্বের উত্তর-পশ্চিম ভিয়েতনাম পর্যন্ত বিস্তৃৃত। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটিতে একই সাথে তিব্বতি-বর্মি ভাষা পরিবারের অনেকগুলো গোত্র থাকার কারণে বিশ্বের অন্যতম ভাষিক বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি স্থান হিসেবে বিবেচ্য। রেংমিটচা ভাষাটিও তিব্বতি-বর্মি ভাষাপরিবারের কুকি-চিন উপভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটি ভাষার লিখিত রূপ যদি না থাকে আর সে ভাষাভাষী যদি কোনো লিপি গ্রহণ না করে তাহলে ভাষাটির ব্যবহারের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে যায়। আর জনসংখ্যা কম হলে তা বিপন্নতার দিকে চলে যায়। পিটারসন রেংমিটচা ভাষার বর্ণমালা ব্যবহার সম্পর্কে জানান ম্রোদের ক্রামা লিপি ব্যবহারের মাধ্যমেও সহজে রেংমিটচা ভাষা লেখা সম্ভব। কেননা ম্রো ভাষার ধ্বনিগুলোর সঙ্গে রেংমিটচা ভাষার ধ্বনিগুলোর কিছু মিল রয়েছে। তবে রেংমিটচা ভাষার জন্য ক্রামা লিপি ছাড়াও, রোমান বা বাংলা লিপি ব্যবহার করা যেতে পারে বলে আমরা মনে করি। তবে তাদের যে-কোনো একটি লিপি গ্রহণ করতে হবে। যদি লিপি নির্ধারিত হয় তবে আমরা এ ভাষার লিখিত সম্পদসৃষ্টি এবং ভাষা সংরক্ষেণের কাজ শুরু করতে পারব। এতে করে পরবর্তী প্রজন্ম চাইলে এ ভাষাটি তারা শিখতে পারবে। এক্ষেত্রে আশার কথা যে সম্প্রতি ওই ভাষার কিছু তরুণ প্রজন্মের যুবক ভাষাটি প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা শিশুদের মধ্যে ভাষাটি শেখাতে শুরু করেছে।

৫. রেংমিটচা ভাষার জন্য আমরা কী করতে পারি?

রেংমিটচা একটি বিপন্ন ভাষা। বর্তমানে বাংলাদেশে এই ভাষার ৫ থেকে ৭ জন ভাষী বা অর্ধভাষী জীবিত আছে। এই ভাষাটি এদের দুই-তিন প্রজন্ম শেখেইনি। যারা ভাষাটি জানে তাদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ। এদের বেশিরভাগ তাদের যৌবন পরবর্তী সময়ে এ ভাষার পরিবর্তে ম্রো ভাষা ব্যবহার করেছে।

রেংমিটচা ভাষার বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সহজেই বলা যায় এটি একটি মৃতপ্রায় ভাষা। এ ভাষা রক্ষার জন্য আমাদের হাতে খুবই সামান্য সময় ও সুযোগ রয়েছে। যার মধ্যে ভাষাটি রেকর্ড করা গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। পাশাপাশি কিভাবে এই ভাষার ব্যাকরণ কাজ করে তাও জানার চেষ্টা করা প্রয়োজন। পরবর্তী ধাপে এই রেকর্ডিং এর অনুবাদ করে ভাষাটিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাংলাদেশে আধুনিক সংগ্রহশালায় সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এছাড়া বয়স্ক ভাষী যারা এই ভাষাটি জানে তাদের ভাষাটিতে স্বতঃস্ফূর্ততা ফিরিয়ে আনার জন্য, এ ভাষায় কথা বলার জন্য উৎসাহ দেয়া দরকার। বর্তমান প্রজন্মের ভাষী যারা এ ভাষাটি শিখতে চায় তাদেরও রেংমিটচা ভাষা শিখতে উৎসাহ দিতে হবে। ইতোমধ্যে এই ভাষার কিছু অডিও রের্কডিং করা হয়েছে। উপাত্তও সংগ্রহ করা হয়েছে, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। এর জন্য পর্যাপ্ত সময় এবং অথের্র প্রয়োজন।

এটি আমাদের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক যে এখনো রেংমিটচা ভাষার ভাষী রয়েছে এবং এ ভাষাটি এখনো জীবিত। পাশাপাশি আমাদের হাতে এ ভাষা থেকে উপাত্ত সংগ্রহের সুযোগও রয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমাদের জন্য একটি আনন্দের সংবাদ হলো রেংমিটচা ভাষা বাংলাদেশ এবং সমগ্র পৃথিবীর জন্য এখনো ভাষিক বৈচিত্র্য ধারণ করে আছে। আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে যে রেংমিটচা আমাদের জন্য একটি সতর্ক সঙ্কেত। আর আশার কথা হল রাষ্ট্র বা সরকার নয় কমিউনিটি নিজেরাই উদ্যোগ নিয়েছে তাদের সন্তানদের মাতৃভাষা শেখানোর।

একটি বিপন্ন ভাষার ক্ষেত্রে প্রকৃত সত্য হলো ভাষাটির ভাষী যদি ভাষাটি ব্যবহার না করে তবে সে ভাষার মৃত্যু অবশ্যম্ভবী। আমরা কেউ রেংমিটচা ভাষার মৃত্যু চাই না। বাংলাদেশে হারিয়ে যাবার পথে এ বিপন্ন ভাষাটি রক্ষার দায়িত্ব সরকারসহ আমাদেরকেই নিতে হবে।

সূত্র: বিডিনিউজ২৪.কম

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বিপন্ন ভাষা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন