আমি কেন এনআইডি নিইনি, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হইনি শাসক গোষ্ঠীর কেউ তো জানতে চায়নি- সন্তু লারমা

fec-image

একাত্তরে পার্বত্য জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলো এমন ভূমিকার ব্যপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ সশস্ত্রভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু তৎকালীন পার্বত্য অঞ্চলের প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের ব্যাক্তি স্থানীয়দের ষড়যন্ত্রে পার্বত্যবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। দু’য়েকজন মুক্তিযুদ্ধে ছিলো না বলে ঢালাওভাবে বলতে পারেন না। বাঙালিদের মধ্যেও তো রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী ছিলো। শুধু পাহাড়িদের কথা বলছেন কেন। মুক্তিযুদ্ধে যেমন বিরোধিতাকারী ছিল, পাহাড়েও এমন বিরোধিতাকারী রয়েছে।’

পার্বত্য জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমা বলেছেন, একটি বিশেষ মহলের স্বার্থ পূরণের জন্য জেএসএস সংস্কার ও ইউপিডিএফ গঠন করা হয়েছে। জনগণের সমর্থনে এই সংগঠনগুলো গঠন করা হয়নি। সরকারের একটি বিশেষ মহলের স্বার্থে এগুলো গঠন করা হয়েছে। যারা যে উদ্দেশ্যে এ সব গঠন করেছে তারাই এদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চলে জেএসএস (সংষ্কার), ইউপিডিএফ- এসব সংগঠন জন্ম নিচ্ছে। এসব সংগঠনে আপনাদের জনগোষ্ঠীর লোকেরাই আছে। তারা নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে খুন হচ্ছে। এ সব গুলি কোথেকে আসছে।–সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এ সব কথা বলেন।

রোববার (১ ডিসেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২২ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজধানীর সুন্দরবন হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছিলেন তিনি।

একাত্তরে পার্বত্য জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলো এমন ভূমিকার ব্যপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ সশস্ত্রভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু তৎকালীন পার্বত্য অঞ্চলের প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের ব্যাক্তি স্থানীয়দের ষড়যন্ত্রে পার্বত্যবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। দু’য়েকজন মুক্তিযুদ্ধে ছিলো না বলে ঢালাওভাবে বলতে পারেন না। বাঙালিদের মধ্যেও তো রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী ছিলো। শুধু পাহাড়িদের কথা বলছেন কেন। মুক্তিযুদ্ধে যেমন বিরোধিতাকারী ছিল, পাহাড়েও এমন বিরোধিতাকারী রয়েছে।’

সন্তু লারমা জাতীয় পরিচয়পত্র কেন নেননি বা কেন নিচ্ছেন না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, কাউকে জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে হবে বা তাকে ভোটার হতে হবে বাংলাদেশের আইনে এমন বাধ্যবাধকতা আছে কিনা? নাই। একইভাবে বাংলাদেশের সকলকে ভোটার হতে হবে এমন কোনো আইনী বাধ্যবাধকতা আছে কিনা? নাই।

এখানে আইডি কার্ড নেয়া না নেয়া যেমন সেই ব্যাক্তির ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, তেমনি ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হওয়া না হওয়াও সেটা তার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। আমার যেহেতু আইডি কার্ড এ পর্যন্ত প্রয়োজন হয় নাই সে জন্য আমি আইডি কার্ড করি নাই। আমি এই দেশের নাগরিক আমি কেন এ পর্যন্ত ভোটার হই নাই এ প্রশ্নটা তো এখন পর্যন্ত কেউ চায় নাই শাসক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে।

এ সময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত জনসংহতি সমিতির কিছু কর্মী সাংবাদিকদের অশিক্ষিত ও মূর্খ বলে গালাগাল দিলে এক সাংবাদিক এর প্রতিবাদ করেন। সন্তু লারমা তখন তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি তো কিছু শুনিনি। আমরা সাংবাদিকদের প্রতি খুবই বিনয়ের সঙ্গে কথা বলছি।

রাঙামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালই চলছে। এ বিষয়ে কোন এক সময়ে কথা হবে।

চুক্তির ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় পরবর্তী অবস্থান কি হবে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই যে সংবাদ সম্মেলন করছি, এটাও আন্দোলনের একটি অংশ। তবে আন্দোলন কিভাবে হবে এটা জনগণের ব্যপার। এর আগে আমরা এ ব্যাপারে দশ দফা দাবি দিয়েছি।

প্রশ্নোত্তর পর্বে সাংবাদিকদের অনেক প্রশ্নেরই উত্তর দিতে অনীহা প্রকাশ করেন জনসংহতি সমিতির শীর্ষ নেতা। সন্তু লারমা বলেন, ‘অন্য সময়ে ব্যক্তিগতভাবে আসেন, তখন বলবো।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘এক নাগাড়ে ১১ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি’।

তিনি বলেন, ‘জনসংহতি সমিতির তথা জুম্ম জনগণের পিঠ সম্পূর্ণভাবে দেওয়ালে ঠেকে গেছে। তাদের আর পেছনে যাওয়ার পথ নেই। পাহাড়িরা ২২ বছর ধরে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করেছে। তারা সরকার তথা শাসকগোষ্ঠীকে অনেক সময় দিয়েছে।

তিনি বলেন, সরকার ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে অব্যাহতভাবে অসত্য, বানোয়াট, ভিত্তিহীন প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এখনো চুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দিয়েছে’।

সন্তু লারমা আরও বলেন, ‘সরকার জুম্ম জাতিগুলোকে চিরতরে নির্মূলকরণের হীন উদ্দেশ্যে যুগপৎ বাঙালিকরণ ও ইসলামিকরণের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলেছে। এই উদ্দেশ্যে একইসঙ্গে শাসকদল এবং সরকার ও সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, প্রতিরক্ষা বিভাগের একটি বিশেষ মহল চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করা, জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করা ও চুক্তি বাস্তবায়নের সব কার্যক্রম প্রতিরোধ করার সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পদে পদে বাধা সৃষ্টি করছে’।

জেএসএসের নেতা-কর্মীদের ওপর একের পর মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘বলা হচ্ছে জেএসএস’র দু গ্রুপে সংঘর্ষে নিহত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে’।

এ সময় পার্বত্য অঞ্চলে ঔপনিবেশিক শাসন চলছে অভিযোগ করে সন্তু লারমা বলেন, ‘সরকার সবকিছু বাইরে থেকে আড়াল করে রাখতে চায়। এ সব জুলুম সম্পর্কে গণতান্ত্রিক সমাজকে কোনো তথ্য দেওয়া হচ্ছে না। এগুলো আড়ালেই থেকে যাচ্ছে’।

ঐক্যন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দিয়ে এই রাষ্ট্র উদার রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না। যে চুক্তি ২২ বছর আগে করা হয়েছিলো সে চুক্তি এত বছর পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা ছাড়া কিছু নয়’। তিনি অতি দ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও আরও অনেক ভাষার মানুষ বাস করে। তারা চাইছে সমঅধিকার। কিন্তু এই স্বীকৃতি তারা পাচ্ছেন না। সংবিধানে বলা হচ্ছে এই দেশের মানুষ জাতিতে বাঙালি। সংবিধান সবাইকে সমান অধিকার দিচ্ছেনা। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষরা শুধু একটু সংবিধানে জায়গা চান’।

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে পার্বত্য সমস্যার সমাধান করতে হবে। এর সঠিক বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতার পরিচয় দেওয়া উচিত’।

জেএসএসের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক উ উইন মং এর সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস উপস্থিত ছিলেন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: শান্তিচুক্তি, সন্তু লারমা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন