ইরান যুক্তরাষ্ট্রগামী তেলের ট্যাংক কেন জব্দ করেছে?

fec-image

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র আবার মুখোমুখি অবস্থানে। তেলবাহী ট্যাংকার জব্দ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ওমান উপসাগর থেকে যুক্তরাষ্ট্রগামী একটি তেলবাহী ট্যাংকার জব্দ করেন ইরানের নৌবাহিনীর সদস্যরা। এর পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে গেছে।

ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনে গত শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) সম্প্রচারিত ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, দেশটির নৌবাহিনীর কমান্ডোরা হেলিকপ্টার নিয়ে অভিযান চালাচ্ছেন। তাঁরা ‘অ্যাডভানটেজ সুইট’ নামে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের পতাকাবাহী একটি ট্যাংকার জব্দ করেন।

ইরানের জব্দ করা ট্যাংকারটি পরিচালনা করা হয় তুরস্ক থেকে। এটি চীনের মালিকানাধীন। হরমুজ প্রণালি হয়ে ট্যাংকার ওমান উপসাগরে প্রবেশ করে। এটি কুয়েত থেকে মার্কিন জ্বালানি কোম্পানি শেভরনের জন্য তেল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিল।

ইরান বলেছে, জব্দ করার আগে অপরিশোধিত তেল বহনকারী ট্যাংকারটি ইরানের একটি নৌযানকে ধাক্কা দেয়। এতে নৌযানের বেশ কয়েকজন ক্রু পড়ে গিয়ে নিখোঁজ হন। আহত হন অন্য ক্রুরা। এ ঘটনার পর ট্যাংকারটি দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। রেডিওতে বার্তা দেওয়া হলেও শোনেনি। এর আট ঘণ্টা পরে ট্যাংকারটি জব্দ করা হয়।

এ অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ইরানের নৌবাহিনীর কর্মকর্তা মোস্তাফা তাজোদিনি রাষ্ট্রীয় টিভিকে বলেন, ‘তদন্ত করার জন্য বারবার ট্যাংকারটিকে থামার জন্য বার্তা দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা কোনো সহযোগিতা পাইনি।’

ট্যাংকারটি অ্যাডভানটেজ ট্যাংকার নামের তুরস্কের একটি প্রতিষ্ঠানের। ট্যাংকারটির ব্যবস্থাপক বলেন, জব্দ ট্যাংকারে ২৪ জন ক্রু সদস্য রয়েছেন। তাঁরা ভারতীয় নাগরিক।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মার্কিন সামরিক বাহিনীর পঞ্চম নৌবহর তেলবাহী ট্যাংকার জব্দের সমালোচনা করে বলেছে, ইরানের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। ট্যাংকারটি অবিলম্বে ছেড়ে দিতে তেহরানের প্রতি আহ্বানও জানানো হয়েছে।

মার্কিন নৌবহরের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইরান একের পরে এক জাহাজ জব্দ এবং আঞ্চলিক সমুদ্রসীমায় জাহাজ চলাচলের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। তাদের এ ধরনের পদক্ষেপ সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য হুমকি।’
একই সঙ্গে মার্কিন নৌবহরের পক্ষে দাবি করা হয়, গত দুই বছরে অন্তত পাঁচটি বাণিজ্যিক জাহাজ জব্দ করেছে ইরান।

গত শুক্রবার রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে ইরানের ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তার আওতায় সম্প্রতি একটি তেলবাহী ট্যাংকার জব্দ করে যুক্তরাষ্ট্র। এরই প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রগামী ট্যাংকার জব্দ করল ইরান।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের জব্দ করা ওই ট্যাংকারের সঙ্গে ইরানের সংশ্লিষ্টতা আছে। সুয়েজ রাজান নামের ওই ট্যাংকারও মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের পতাকাবাহী। সেটির ব্যবস্থাপক ছিলেন গ্রিসের একজন। ট্যাংকারটির সর্বশেষ অবস্থান ছিল আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূলে। ইরান অ্যাডভানটেজ সুইট জব্দ করার কয়েক দিন আগে ট্যাংকারটি জব্দ করে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের একে অপরের ট্যাংক জব্দের ঘটনার এমন নজির আরও আছে। এর আগে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র গ্রিসের উপকূলের কাছাকাছি থেকে ইরানের একটি কার্গো জাহাজ জব্দ করার চেষ্টা করেছিল। এ ঘটনার জেরেই তেহরান গ্রিসের পতাকাবাহী দুটি তেলবাহী ট্যাংকার জব্দ করে। কয়েক মাস ধরে ট্যাংকার দুটি আটকে রেখেছিল ইরান। এ ঘটনায় গ্রিসের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কার্গো জাহাজটি ইরানে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর ইরানও ট্যাংকার দুটি ছেড়ে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর এযাবৎকালের সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ইরানের অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের রপ্তানি।

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত কয়েকটি দেশ ইরানের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে করা এই চুক্তির অধীনেই ইরানের ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হতে শুরু করে। তবে ক্ষমতায় আসার পর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে একতরফাভাবে চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

এই চুক্তি আবার সচল করার জন্য চেষ্টা চালানো হয়েছে। তবে কোনোভাবেই অচলাবস্থা কাটেনি। চুক্তিটির উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির লাগাম টানা এবং এর বদলে ইরানের ওপর আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে প্রত্যাহার। যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে পাল্টা নতুন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর থেকে ইরান এসব নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে তাদের তেল রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এতেই আপত্তি যুক্তরাষ্ট্রের।

গত বৃহস্পতিবার ১২ জন মার্কিন সিনেটর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তিনি যেন দেশটির ট্রেজারি বিভাগের নীতিগত কিছু বিষয় পরিবর্তন করেন, যাতে করে ইরানে তেল সরবরাহকারী ট্যাংকারগুলো জব্দ করার ক্ষেত্রে ঝামেলা কম হয়। বিশ্লেষকদের ধারণা, সিনেটরদের এ আহ্বানে মার্কিন-ইরান উত্তেজনা আরও বাড়বে।

লেখা:আল-জাজিরা

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইরান, জব্দ, ট্যাংকার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন