জমির ক্ষতিপূরণ না পেয়ে হতাশ ২০ দরিদ্র্র পরিবার

এলও অফিসে লুটকৃত ২ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত নেয়ার দাবি

fec-image

কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় রামুর লম্বরীপাড়া গ্রামের হতদরিদ্র লোকজনের জমির ক্ষতিপূরণের ২ কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনায় সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় দৌড়ঝাপ ও মামলা-মোকদ্দমা করে হয়রানি হওয়ার পরও নিজেদের কাংখিত ক্ষতিপূরণের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও দালাল চক্র। ফলে ২০টিরও বেশি দরিদ্র পরিবার এখন হতাশ। এ কারণে লুট হওয়া এ বিশাল অর্থ উদ্ধার করে জমির প্রকৃত মালিকদের বন্টনের দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিক ও এলাকাবাসী।

লুটপাটের ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি জানিয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, ৪টি মামলায় বাদী-বিবাদী ৬০ জনের বিরোধীয় জমির ক্ষতিপূরণের এ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে ভূয়া আপোষনামা দেখিয়ে। অথচ এসব মামলার একটিও বর্তমানে আপোষ নিষ্পত্তি হয়নি। অর্ধ শতাধিক মানুষের ক্ষতিপূরণের ২ কোটি টাকা উত্তোলন হলেও প্রকৃত মালিকরা জমির ক্ষতিপূরণের কোন অর্থই পাননি।

এনিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা দূর্নীতি দমন কমিশন দুদকে অভিযোগ করেন। সম্প্রতি কক্সবাজার স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক শ্রাবন্তী রায় অভিযোগটি তদন্ত কাজ শুরু করেন। তদন্তে অংশ নেয়া বাদী এবং বিবাদীদের কয়েকজন এ প্রতিবেদকদের কাছে ২ কোটি টাকা লুটের বিষয়টি স্বীকার করে অনিয়মের নানা তথ্য দিয়েছেন।

দুদকের কাছে দেয়া অভিযোগের বাদী আবুল কালাম আরো জানান, এ জমি নিয়ে ৯০/১৮ নং মামলা ছাড়াও কক্সবাজার বিজ্ঞ সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে আরো ৩টি মামলা মামলা (নং যথাক্রমে অপর-২০৭/১৮, মিচ মামলা নং ১২/২০১৭, অপর ৩৭০/২০১৮ বিচারাধিন রয়েছেন। এরপরও বিজ্ঞ আদালতের প্রতি কোন প্রকার তোয়াক্কা না করে লোভের বশবর্তী হয়ে সার্ভেয়ার মাসুদ রানাসহ আরো কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী-দালাল চক্র যোগসাজশ করে প্রকৃত ভূমি মালিকদের প্রায় ২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

অভিযোগে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আশরাফুল আফছার, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মর্তুজা আল মুঈদ ও আবুল হাসনাত, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা দেবতোষ চক্রবর্তী, ভূমি অধিগ্রহণ শাখার নেপাল চন্দ্র ধর, সার্ভেয়ার মাসুদ রানা, মো. জহিরুল ইসলাম, মোখলেছুর রহমান, মাহবুব রহমান ও আবদুল জলিল, অপর ৯০/১৮ মামলার বাদি মো. ইসলাম, বিবাদী নুরুল হক, ইব্রাহীম খলিল, মোর্শেদ মেম্বার, নুরুল কবির, শামসুল আলম, শাহাজান, জাফর আলম, এনামুল হক, মিজানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, অপর-৯০/২০১৮ ও অপর ২০৭/২০১৮ নং মামলায় স্বত্ত্ব নাদাবী আপোষ-নামায় গন্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে স্বাক্ষর করেন, সদর উপজেলার বাংলাবাজার এলাকার শামসুল আলম, রশিদনগর ইউনিয়নের মুরাপাড়া এলাকার শাহজাহান, লম্বরীপাড়া এলাকার জাফর আলম, এনামুল হক, নুরুল কবির। এসব ব্যক্তিরা জমি মালিকও নয়। কিন্তু এসব ব্যক্তিরা নুরুল হক গং, রাশেদা গং, সিরাজুল হক গং এর নামে ওয়ান ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের একাউন্টে জমাকৃত ভূমি অধিগ্রহণের টাকা চেকের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে।

আরো জানা গেছে, নুরুল গং এর নামে জমাকৃত ২ কোটি টাকার মধ্যে সার্ভেয়ার মাসুদ রানা দালাল শাহজাহানের মাধ্যমে গ্রহণ করেন ৫৫ লাখ টাকা। যা অগ্রিম চেকের মাধ্যমে নেয়া হয়। এছাড়া অপর ২০৭/২০১৮ নং মামলার বাদিদের দেয়ার জন্য ৩০ লাখ টাকা, অপর-৯০/২০১৮ নং মামলার বাদিদের দেয়ার জন্য ২৫ লাখ টাকা নেয় দালালরা। এছাড়া অন্যান্য মামলার বাদি-বিবাদীদের ক্ষতিপূরণের আরো ৯০ লাখ টাকা কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তা ও দালাল চক্র।

ক্ষতিগ্রস্ত নুরুল হক জানিয়েছেন, তার ছোট ভাই ইব্রাহীম খলিল কথিত সার্ভেয়ার-দালালদের সাথে আতাঁত করে আপন-ভাই বোনদের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। একারণে দুদকের অভিযোগ তদন্তকালে তিনি ইব্রাহীম খলিল, সার্ভেয়ার মাসুদ রানা, দালাল শাহজাহান সহ জড়িতের বিরুদ্ধে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন।

সম্প্রতি রেলের ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের ২ কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ এবং এ নিয়ে দুদকে দেয়া অভিযোগ তদন্ত শুরু হওয়ায় দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও দালাল চক্র পুরো ঘটনা ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এজন্য দুদকে অভিযোগকারি আবুল কালামের এ জমিতে স্বত্ত্ব নেই মর্মে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এছাড়া দুদকে অভিযোগকারি ২ জনকে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য হুমকী-ধমকি দেয়া হচ্ছে।

এদিকে দালাল চক্র কর্তৃক রেলের বিপুল টাকা হাতিয়ে নেয়ার জেরে রামুর লম্বরীপাড়া গ্রামে দালাল চক্রের সাথে জমির মালিকদের মধ্যে সংঘর্ষ-ঝগড়া-বিবাদ নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি দালাল চক্রের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের ২ লাখ টাকা উদ্ধার করে মসজিদ কমিটির কাছে হস্তান্তর করে গন্যমান্য ব্যক্তিরা। ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, উদ্ধারকৃত এ ২ লাখ টাকার অনিয়মের উৎস তদন্ত হলে রেলের ক্ষতিপূরণের বিপুল টাকা আত্মসাতের রহস্য উন্মোচন হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশনে দেয়া অভিযোগ তদন্তকারি কক্সবাজার স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক শ্রাবন্তী রায় জানিয়েছেন-তিনি অভিযোগটি তদন্ত করছেন। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা তার নেই। ক্ষতিপুরণের টাকা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা করার জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের পরামর্শ দেন তিনি।

রামুর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের খোন্দকারপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ হোসনের ছেলে ওসমান গনি জানান, তাঁর স্ত্রী জাহান আরা বেগম এ জমির ওয়ারিশ এবং বিজ্ঞ আদালতে চলমান অপর ৯০/২০১৮ নং মামলায় তিনি ও তার ভাইয়েরা ৬-১৩ নং বাদি। বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক ক্ষতিপূরণ প্রদানে নিষেধাজ্ঞা প্রদানের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তাসহ বিবাদীদের শোকজ করার আদেশ ছিলো। কিন্তু এ আদেশ উপেক্ষা করে দালাল চক্রের সহায়তায় সার্ভেয়ার মাসুদ রানা-দালাল শাহজাহানসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারিরা ভুয়া আপোষ-নামা সৃজন করে জাহান আরা গং এর প্রাপ্ত ক্ষতিপূরণের টাকা কৌশলে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে।

পরে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর এ ঘটনার প্রতিবাদ জানালে স্থানীয় বাসিন্দা ভূমি অধিগ্রহণ শাখার চিহ্নিত দালাল নুরুল কবির উল্টো জমির মালিক জাহান আরার স্বামী ওসমান, জমির মালিক আবুল কালাম, নুরুল আজিম, নুরুল আমিন, রুহুল আমিন, সেলিমকে জড়িয়ে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চাঁদাবাজি ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে মামলা (সিআর-১৭৯/১৯) দায়ের করে।

এ মামলার প্রতিবাদে এলাকাবাসী গণস্বাক্ষর দিয়ে পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন জানায়। পরে রামু থানা পুলিশ তদন্ত করে এ মামলা মিথ্যা হিসেবে বিজ্ঞ আদালতে প্রতিবেদন দিলে মামলাটি খারিজ হয়। মামলা খারিজ হওয়ার পর নুরুল কবির আবারো ক্ষিপ্ত হয়ে জমির মালিক আবুল কালামের বাড়িতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা ও লুটপাট চালায়। এ ঘটনায় আবুল কালাম বাদী হয়ে নুরুল কবিরসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে মামলা (নং ২০৫/১৯) করেন। মামলায় অভিযুক্তরা জামিনে থাকলেও এখনো জমির মালিকদের হুমকী-ধামকি দিচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কক্সবাজার, দুদক, দূর্নীতি দমন কমিশন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন