চকরিয়ায় সিমেন্ট ছাড়াই বালির বস্তা দিয়ে নির্মিত দেড় কোটি টাকার বাঁধ ভেসে গেল বন্যার প্রথম ধাক্কায়

মাতামুহুরী নদীর কাকারার তীর সংরক্ষণ প্রকল্প : পাউবো কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এলাকাবাসীর

Chakaria Pic. 11.07.16

চকরিয়া প্রতিনিধি:

শর্ত ছিল আট বস্তা বালির মধ্যে এক বস্তা সিমেন্ট মিশ্রণ করে তা বস্তাভর্তি করে কক্সবাজারের চকরিয়ার প্রপার কাকারার মাতামুহুরী নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজস করে শুধুমাত্র বালির বস্তা ফেলে প্রকল্পের কাজ শেষ করায় কয়েক মাস না যেতেই নগন্য বানের পানিতে তলিয়ে গেছে দেড় কোটি টাকার এই কাজ। এতে বরাবরের মতোই সরকারী টাকার জলাঞ্জলি হলো।

এবারের বর্ষা শুরুর আগেই যেনতেনভাবে এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার সময় এলাকাবাসী এতে বাঁধা দিলেও প্রভাবশালী ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের নানা হুমকি-ধমকিতে চুপসে যায়। এ সময় তারা আশঙ্কা করেছিল, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির প্রথম ধাক্কাতেই এই প্রকল্প অকার্যকর হতে পারে। শেষ পর্যন্ত এলাকাবাসীর সেই আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হলো।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই অবস্থায় ঠিকাদার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন প্রকল্পের বিপরীতে সমুদয় বিল উত্তোলন করে নিতে। আর এতে সহায়তা দেওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের অধস্তন কর্মকর্তাদেরও যেন তোড়জোড়ের শেষ নেই।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার-১ আসনের এমপি মোহাম্মদ ইলিয়াছ, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসারও আহবান জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

সিমেন্ট ছাড়াই শুধুমাত্র বালির বস্তা ফেলে নির্মিত বাঁধ বন্যার প্রথম ধাক্কায় নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। এই কাজের বিপরীতে সম্পূর্ণ বিল যেহেতু এখনো ঠিকাদার পায়নি, সেহেতু ওই ঠিকাদারকে দিয়ে দরপত্রের শর্তানুযায়ী কাজ বুঝে নিতে সরকারের ঊর্ধতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সামান্য বর্ষণের পরই ভাঙন ঠেকানোর জন্য বিছানো বস্তা ফেটে গেলে বিষয়টি টের পাই। সেখানে দেখা যায় কোন সিমেন্ট ছাড়াই শুধু বালি দিয়েই বস্তা বিছিয়ে সরকারের টাকা আত্মসাত করেছেন ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।’

তিনি বলেন, ‘এর আগে মানসম্পন্ন কাজ নিশ্চিতের তাগাদা দিলেও ঠিকাদার শুনেনি। ঠিকাদার ফরিদুল আলম এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও মাঠ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম মিলে সরকারের এতগুলো টাকা জলে ভাসিয়ে দিয়েছেন। এতে কোন অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কি-না খতিয়ে দেখতে হবে।’

জানা গেছে, মাতামুহুরী নদীর প্রপার কাকারা অংশের তীর সংরক্ষণ বাঁধ (সিসি ব্লক) ধ্বসে পড়ে বিগত ২০১৫ সালের জুন মাসে। এর ফলে কাকারার সাথে চকরিয়া উপজেলার চলাচলের একমাত্র সড়কটি ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে বরাদ্দ দিয়ে সিমেন্ট কংক্রিট (সিসি) ব্লকের বদলে সিমেন্ট মিশ্রিত বালি দিয়ে কাজ শুরুর করার ঘোষণা দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু সেই জরুরি মেরামতের কাজ শুরু হয় দশমাস পর। তীর সংরক্ষণ বাঁধে ২০ হাজারের মতো বস্তা ফেলার কাজ বর্ষার আগে দ্রুত শেষ করার জন্য এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অনুরোধ এবং গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে টনক নড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদারের।

এরইমধ্যে কয়েকদফা বৃষ্টি শুরু হলে বস্তাগুলো ফেটে বালি বের হতে থাকলে নজর কাড়ে এলাকাবাসীর। বিষয়টি ঠিকাদারকে জানানো হলেও তিনি এসবের ধার ধারেননি। পরে ছবিসহ প্রতিবেদন দেখে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান নড়েচড়ে বসেন। মাঠ কর্মকর্তা নজরুল ইসলামকে (এস.ও) দ্রুত বিষয়টি যাচাইয়ের নির্দেশনা দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই বস্তাগুলো বিছানো হয়েছে প্রায় দেড়মাস আগে। সামান্য সিমেন্টের মিশ্রন থাকলেও সেগুলো নিশ্চিতভাবেই জমাট বাঁধতো। আর এই কদিনেই সেগুলো ছিঁড়ে যেতো না।

সিমেন্ট ছাড়াই শুধুমাত্র বালি দিয়ে এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চকরিয়া ডেভলপমেন্ট সোসাইটির সত্ত্বাধিকারী লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের বাসিন্দা ফরিদুল আলমের বক্তব্য নেওয়ার জন্য অসংখ্যবার যোগাযোগ করা হয় মুঠোফোনে। কিন্তু তিনি কোন সাড়া না দেওয়ায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের বালির বাঁধ বন্যার প্রথম ধাক্কায় বিলিন হওয়ার খবর পেয়ে তা পরিদর্শন করেছেন স্থানীয় এমপি মোহাম্মদ ইলিয়াছ, চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাহেদুল ইসলাম, কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত ওসমান।

চেয়ারম্যান শওকত ওসমান জানান, এলাকাবাসী প্রপার কাকারার মাতামুহুরী নদীর তীর সংরক্ষণের জন্য শেষপর্যন্ত সরকার সাড়া দিলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে যেনতেনভাবে সম্পন্ন করা এই প্রকল্প অকার্যকর হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘এখনো যেহেতু ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়নি, সেহেতু দরপত্রের শর্তানুযায়ী কাজ বুঝে নিতে হবে ঠিকাদারের কাছ থেকে। না হয় বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচী দিয়ে মাঠে নামবেন এলাকাবাসী।’

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি জেনেছি, বন্যার প্রথম ধাক্কায় সেই বাঁধ বিলিন হয়ে গেছে। বাঁধ নির্মাণের শর্ত যথাযথভাবে অনুসরণ করা না হলে ঠিকাদারকে এর দায়ভার নিতে হবে।’

বিল পরিশোধ করা নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘দেড় কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজের বিপরীতে মাত্র দশ শতাংশ বিল ছাড় করা হয়েছে। বিলের বাকী টাকা এখনো পরিশোধ করা হয়নি। কাজ পুরোপুরি বুঝে নেওয়ার পর সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করা হবে, তার আগে নয়।’

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন