চালু হতে যাচ্ছে মারমা সম্প্রদায়ের বিবাহের সনদ প্রচলন

fec-image

মারমা সমাজে বিবাহ একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। মারমা সমাজে স্বীকৃত বিবাহের পূর্বশর্ত হচ্ছে ‘চুং-মাং-লে’ বা ‘গংউ নাইট’ অনুষ্ঠান। এই সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহিত মারমা দম্পতি একত্রে বসবাস ও জৈবিক মিলনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের অধিকার লাভ করে থাকেন। মারমা সমাজে বিয়ে নিবন্ধনের কোনো রীতি নেই। মারমা সমাজে বিবাহ একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। এমনকি বিয়ের প্রমাণ স্বরূপ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো লিখিত দলিলও তৈরি করা হয় না। কিন্তু এখন কয়েক দশক পর চালু হতে যাচ্ছে মারমা সম্প্রদায়ের বিবাহের সনদ প্রচলন। এই প্রচলনের মাধ্যমে একাধিক বিয়ে কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদ অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করছেন সুশীল সমাজের নেতারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সামাজিক জীব হিসেবে জন্ম, মৃত্যু এবং বিবাহ এই তিনটি মানুষের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দীর্ঘকাল ধরে পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃতাত্তিক জনগোষ্ঠী নিজ নিজ প্রথাগত রীতিনীতি অনুসরণ করে এই তিনটি পালন করে আসছিল। কিন্তু এই প্রথম মারমা সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষের বিয়ে নথিভুক্ত ও সনদ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে বান্দরবানে। আর এই সনদের মাধ্যমে বহু বিবাহ রোধ, বিয়ের পর স্বীকৃতি না পাওয়াসহ নারী-পুরুষের যথাযথ অধিকার আদায় সহজ হবে। এই সনদ নিয়ে মারমা সম্প্রদায়ে চলছে উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা। সামাজিক আইন, সুপ্রাচীন রীতি-নীতি লালন ও ধারনে বৈধ কাঠামোর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মারমা সম্প্রদায়। শত শত বছর ধরে মারমা নর-নারী পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে অলিখিত স্বীকৃতির মাধ্যমে বিবাহে আবদ্ধ হয়ে আসছে। শুধু মারমা নয়, পাহাড়ে বসবাসরত প্রতিটা জাতিগোষ্ঠীর আলাদা নিয়মে বিবাহ হয়।

এদিকে বিবাহ সনদ প্রচলন করতে গেল ১৩ মে বান্দরবান শহরে হোটেল হিলভিউ কনভেনশন হলে মারমা বিবাহে নতুন দম্পতি মাঝে সনদ প্রদানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকতাভাবে যাত্রা শুরু করেন হেডম্যান- কারবারি কল্যাণ পরিষদ। এরপর থেকে মারমা জনগোষ্ঠিদের মাঝে সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে উঠে সমালোচনার ঝড়। সমালোচনাকে কঠোরভাবে পদক্ষেপ নিতে গেল শনিবার (১৭ জুন) বান্দরবানে টাউন হলে প্রায় আড়াই’শ হেডম্যান, কারবারি, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক ও সাংষ্কৃতি নেতৃবৃন্দদের উপস্থিতিতে মতবিনিময় সভা করেন হেডম্যান-কারবারি কল্যাণ পরিষদ।

মারমা সম্প্রদায়ের লোকজনরা বলছেন, হঠাৎ করে এমন সনদ প্রচলন বিবেচিত হবে নাহ। তাছাড়া মারমাদের পূর্বে থেকে যেসব প্রথা ছিলনা সেটি চালু করা অযৌক্তিক। তবে এসব প্রচলন শুরু হলে বাড়বে হয়রানি কিংবা ব্যাঘাত ঘটবে সমাজে। অনান্যরা বলছেন, সামাজিক রীতিনীতি মাধ্যমে বিবাহ সদন প্রচলন হলে সমাজে কমে আসবে নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদ, আর কোন অপ্রীতিকর প্রভাব পড়বে না সন্তাদের মাঝে। তাছাড়া শুধু মারমা সম্প্রদায় নয় আরও অনান্য জাতিগোষ্ঠিদের মতামত থাকলে তাদের জন্যও একই নিয়ম চালু হবে বলেছেন সম্প্রদায়ের নেতাকর্মীরা।

বিশিষ্ট লেখক মংক্যচিং নেভী বলেন, মারমাদের বিবাহ আগেও স্বীকৃতি ছিল, এখন শুধুমাত্র ডকুমেন্টারি করার জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে করে নিজ নিজ অধিকার আদায় করা সহজ হবে।

ম্রো নেতা ও থানচি উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খামলাই ম্রো বলেন, মারমা সম্প্রদায়ে বিবাহ নথিভুক্ত ও সনদ গ্রহণ কার্যক্রম প্রশংসনীয়। পাহাড়ে বসবাসরত অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী নর-নারীরাও স্ব স্ব প্রথাগত রীতিনীতি মেনে বিবাহ নথিভুক্ত ও সনদ গ্রহণ করতে পারে।

বিশিষ্ট আইনজীবী মাধবী মারমা এই প্রসঙ্গে বলেন, দীর্ঘকাল পাহাড়ে বিয়ের এই রীতি চলে আসলেও যুগের প্রয়োজনে মারমা সম্প্রদায়ে চালু হয়েছে বিয়ে নথিভুক্ত ও সনদ গ্রহণ। এর মাধ্যমে বিদেশ ভ্রমণ, বিবাহ বিচ্ছেদ, অধিকার আদায়, নমিনী, উত্তরাধিকার, সামাজিক স্কীকৃতিসহ নানা বিষয়ে বিয়ের দালিলিক প্রমাণ করা সহজ হবে।

হেডম্যান মংনু মারমা বলেন, বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে মারমাদের বিবাহ সনদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথা রীতিনীতি ঠিক রেখে তিন পার্বত্য জেলার মারমা সম্প্রদায়সহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠিরও এই সনদ গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করবে বলে মনে করেন।

বান্দরবান হেডম্যান কারবারি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি হ্লা থোয়াই হ্রী মারমা বলেন, বিবাহ নথিভুক্ত ও সনদের বিষয়ে কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে আসছে। বিশেষ করে যারা নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন তাদের দাবি ছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাজে বিবাহ নিবন্ধন প্রচলন করার। এমন প্রেক্ষাপটে সমাজের প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে এগিয়ে এসেছেন। এখন থেকে প্রয়োজন হলে পাড়ার কারবারির সুপারিশ নিয়ে হেডম্যান থেকে যেকেউ বিবাহ নথিভুক্ত ও সনদ গ্রহণ করতে পারবে। তবে এই ক্ষেত্রে কাউকে বাধ্য করা হবে না।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন