টেকনাফে সরকারী নির্দেশ উপেক্ষা করে লবণ পরিবহণে সড়কের বারোটা

teknaf pic-16.02

মুহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান, টেকনাফ :

টেকনাফে পুরোদমে মৌসুমী লবণ উৎপাদনের পাশাপাশি পরিবহণও শুরু হয়েছে। তবে ভয়ারহ ব্যাপার হচ্ছে, টেকনাফ থেকে লবণ পরিবহণে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সরকারী নির্দেশনা এক্ষেত্রে চরমভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে টেকনাফ উপজেলা প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছেনা।

লবণ বোঝাই ট্রাকে আবশ্যিকভাবে পলিথিন বা ত্রিপল ব্যবহার, যত্রযত্র ডাম্পিং এবং প্রধান সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে লবণ লোড না করার কঠোর নির্দেশনা থাকলেও টেকনাফে তা মোটেও মানা হচ্ছেনা। প্রধান সড়কে ট্রাক দাঁড় করিয়ে লবণ বোঝাই করা হচ্ছে। এতে লবণের পানি পড়ে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়ক।

তাছাড়া যত্রযত্র ডাম্পিং এবং প্রধান সড়কে দাঁড়িয়ে যানবাহণ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ট্রাকে লবণ লোড করায় জনভোগান্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রাকে লবণ বোঝাই করার জন্য লোডিং পয়েন্ট নির্ধারণ করাসহ বিষয়গুলো নিয়ে উপজেলা আইন শৃংখলা বিষয়ক একাধিক সভায় গুরুত্ব সহকারে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও রহস্যজনক কারণে তা বাস্তবায়িত হচ্ছেনা। ফলে একদিকে সরকারী নির্দেশনার চরম লঙ্ঘন হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষতির মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জানা যায়, কক্সবাজার জেলা  প্রশাসকের কার্যালয় জেনারেল সেকশন থেকে স্মারক নং- ০৫,২০,২২০০,১১০,০৬,০১৪,১২-৩৯ মূলে এতদসংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, লবণ পরিবহণের সময় গাড়িতে পলিথিন/ত্রিপল ব্যবহার এবং ডাম্পিং না করা বাধ্যতামূলক হলেও তা পালিত হচ্ছেনা। পলিথিন ও ত্রিপলবিহীন লবণবাহী এসব ট্রাক থেকে নির্গত পানি পড়ে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে এবং রাস্তার কার্পেটিংসহ রাস্তাসমূহের ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসকের এই চিঠির আলোকে টেকনাফের তৎকালীন ইউএনও আ,ন,ম, নাজিম উদ্দীন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি সভাও ডেকেছিলেন। চিঠির মর্ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ব্যাপক আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তাছাড়া আইন শৃংখলা বিষয়ক একাধিক সভায় এনিয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা।

উল্লেখ্য, টেকনাফ উপজেলার পৌরসভা, হোয়াইক্যং, হ্নীলা, টেকনাফ সদর ও সাবরাং ইউনিয়নে ব্যাপকভাবে লবণ চাষাবাদ হয়। কক্সবাজার জেলায় সনাতন পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদনে খ্যাত টেকনাফ উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে প্রায় ৪ হাজার একর জমিতে দেরীতে হলেও পুরো দমে লবণ চাষাবাদ ও উৎপাদন চলছে। তবে শাহপরীরদ্বীপের বেড়ীবাঁধের ভাঙ্গণে বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের পানিতে প্লাবিত অব্যাহত থাকায় সাবরাং ও শাহপরীরদ্বীপে ৬৯৮ একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছেনা। একই কারণে বর্ষা মৌসূমে আমন চাষাবাদ এবং শীত মৌসূমে তরমুজ, মরিচ, খিরা, বাঙ্গি, শশা, পেলং, পানের বরজসহ মৌসূমী তরি-তরকারী ও শাক-সবজির চাষাবাদ হয়নি । এতে কৃষকদের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে বলে জানা গেছে। এদিকে বিসিকের মাঠ পর্যায়ে জরীপ কাজও চলছে।

বিসিক টেকনাফ লবণ কেন্দ্রের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১১-২০১২ সনে  টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নে ২৯৫ জন লবণ চাষী ৮১২ একর, হ্নীলায় ৬১৫ জন লবণ চাষী ১হাজার ৪৩০ একর, শাহপরীরদ্বীপে ১৬৫ জন লবণ চাষী ৪২৪ একর, টেকনাফ সদর ইউনিয়নে ৪৪০ জন লবণ চাষী  ৯২০ একর, সাবরাংয়ে ৬৫০ জন লবণ চাষী ১ হাজার ৪৩০ একর মোট ২ হাজার ১৬৫ জন লবণ চাষী ৫ হাজার ১৬ একর জমিতে সনাতন পলিথিন পদ্ধতিতে লবণের চাষাবাদ করেছিল। মোট লবণ উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ মেট্রিক টন।

২০১২-২০১৩ সনেও লবণ চাষীরা যথাসময়ে লবণ উৎপাদনের কাজে নেমেছিল । কিন্ত শাহপরীরদ্বীপে বেড়িবাঁধের ভয়াবহ ভাঙ্গণে লবণসহ মৌসুমী চাষাবাদেও জমির পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ১ হাজার ১১৮ একর কমে যায়।

বিসিক সূত্র জানায়, গেল বছর লবণ মৌসূমে টেকনাফ সদর ইউনিয়নে ১২৫ জন লবণ চাষী ১৫০ একর, সাবরাংয়ে ৪৫০ জন লবণ চাষী ৯৩২ একর, শাহপরীরদ্বীপে ১৫৫ জন লবণ চাষী ২২৪ একর, নীলায় ৭৬৫ জন লবণ চাষী ১ হাজার ৬৩০ একর এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নে ৪৪৫ জন লবণ চাষী ৯২৬ একরসহ মোট ১ হাজার ৯৪০ জন লবণ চাষী ৩ হাজার ৮৯৮ একর জমিতে লবণ চাষাবাদ করেছিল । যা আগের বছরের তুলনায় ১ হাজার ১১৮ একর কম।

লবণ চাষীরা জানান, এবছর লবণ উৎপাদনের চাষাবাদ মৌসূমের শুরু থেকে এপর্যন্ত আবহাওয়া সম্পূর্ণ অনুকূলে রয়েছে । ফলে লবন উৎপাদন ভালই হচ্ছে। মৌসুম শেষ হওয়া পর্যন্ত আবহাওয়া বর্তমানের মতো অনূকূলে থাকলে আশাতীত উৎপাদন হবে বলে তাদের ধারনা। কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি করেছে শাহপরীরদ্বীপ পশ্চিম অংশের বিধ্বস্থ বেড়ী বাঁধ। ২০১২ সনে বর্ষায় বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের আঘাতে শাহপরীরদ্বীপ পশ্চিমপাড়া ৬৮ নং ফোল্ডার বেড়ী বাঁধের বেশ কিছু অংশ  লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। সেই সাথে বিশাল জনবসতির লোকালয় সাগরের করাল গ্রাসে চলে গিয়েছে।  সাগরের জোয়ারের পানি ঢুকে বিস্তীর্ন এলাকা প্লাবিত থাকে।

সাগরের জোয়ারের পানি ও ঢেউয়ের আঘাতে টেকনাফ-শাহপরীরদ্বীপ কার্পেটিং সড়ক বিধ্বস্থ হয়ে এখনও যানবাহন চলাচল বন্ধ এবং সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এখনও পূর্ণিমা ও অমাবশ্যার সময় শাহপরীরদ্বীপ  ও সাবরাংয়ের বিশাল এলাকা প্লাবিত থাকে। সাগরের লবনাক্ত পানিতে প্লাবিত থাকায় গত দুই বছর আমন মৌসুমে প্রায় দেড় হাজার একর জমিতে আমন চাষাবাদ করার সম্ভব হয়নি। আর  শীতকালীন বিভিন্ন ফসলসহ লবন উৎপাদন বা চাষাবাদ করা যাচ্ছেনা।

বেড়ীবাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকে শাহপরীরদ্বীপের সচেতন বাসিন্দাগণ বিধ্বস্থ বেড়ী বাঁধ পূনঃ নির্মাণের দাবীতে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, স্বারকলিপি পেশ, আবেদন, সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের উচ্চ মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। শাহপরীরদ্বীপের বিধ্বস্থ বেড়ীবাঁধের পূনঃ নির্মাণ হয়নি। দীর্ঘ দেড় বছরেও জোড়া লাগেনি টেকনাফ-শাহপরীরদ্বীপ সড়কের। এই ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টির জন্য যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আর কয়েক মাস পরেই আবারও বর্ষা শুরু হবে।

গত দুই বর্ষায় সাগরের ভয়াবহ ভাঙ্গনে শতাধিক বসতবাড়ী, বাস্তুভিটা, মসজিদ-মক্তব সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিল।  বর্ষা শুরু হওয়ার আগে সে বিধ্বস্থ বেড়ী বাঁধ পূণঃ নির্মান করা না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে আশংকা রয়েছে। বেড়ী বাঁধ পূনঃ নির্মাণের যে উপযুক্ত সময় তা দ্রুতই শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখনও কাজ শুরু করার লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। বর্ষা শুরু হলে বেড়ী বাঁধ পূনঃ নির্মাণের কাজ করা মোটেও সম্ভব হবেনা।

একদিকে সর্বপ্রকার উৎপাদন বন্ধ উপরন্তু সাগরের ভয়াবহ ভাঙ্গনে শাহপরীরদ্বীপের ৩০ হাজার বাসিন্দার অস্তিত্ব  রক্ষাসহ জীবন-মরন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিসিক শাহপরীরদ্বীপ ও সাবরাংয়ের একাধিক স্থানে লবন চাষাবাদের জন্য নির্ধারিত স্থান সম্বলিত বড় বড় সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেখানে লবন চাষ নেই। বেড়ী বাঁধ বিধ্বস্থ হয়ে সাগরের জোয়ারের পানি আসা যাওয়া অব্যাহত থাকায় শাহপরীরদ্বীপের ২০০ একর এবং সাবরাংয়ের ৪৯৮ একর জমিতে লবন চাষাবাদ হয়নি। এবছরও হওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রসঙ্গতঃ, ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে ৬ মাস লবণ উৎপাদনের মৌসূম হিসাবে ধরা হয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন