‘ঢাকাকে বুঝতে হবে, দিল্লির পক্ষে এর বেশি কিছু করা সম্ভব নয়’

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নয়, ভারতের উচিত মিয়ানমারের স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া– প্রকাশ্যে এই প্রস্তাব দিয়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিবাল। প্রভাবশালী সাবেক এই কূটনীতিক সরাসরি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ যদি ভারতের কাছ থেকে এ ব্যাপারে বেশি কিছু আশা করে, তাহলে ভুল করবে। ঢাকাকে বুঝতে হবে, দিল্লির পক্ষে এর বেশি কিছু করা সম্ভব নয়।’

কানওয়াল সিবাল ভারতের কূটনৈতিক মহলে ‘কট্টরপন্থী’ বলে পরিচিত। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বর্তমান বিজেপি সরকার কানওয়াল সিবালের মতামতকে বেশ গুরুত্ব দেয়। বিজেপির বিগত বাজপেয়ী সরকারের আমলে তিনি ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। এছাড়া, রাশিয়া, ফ্রান্স, মিসর ও তুরস্কসহ অনেক দেশে তিনি দীর্ঘদিন ভারতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার ছোট ভাই কপিল সিবাল কংগ্রেসের একজন সিনিয়র নেতা ও দেশের শীর্ষ আইনজীবীদের একজন।।

অবসরে যাওয়ার পর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য হিসেবেও কানওয়াল দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কানওয়াল সিবাল ভারত সরকারকে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা বাংলাদেশের কাছে শ্রুতিমধুর শোনাবে না। নিজের ব্লগে তিনি লিখেছেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য যেসব মুসলমান দেশ ‘মায়াকান্না’ কাঁদছে সেই ‘ভণ্ডামির কোরাসে’ যোগ দেওয়ার আদৌ কোনও মানে হয় না। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে যাই বলুক না কেন, ভারতের উচিত হবে মিয়ানমারকে সমর্থন করে যাওয়া।’

নিজের বক্তব্যের সমর্থনে তিনি যেসব যুক্তি তুলে ধরেছেন, তার কিছু এরকম:

(ক) যেসব মুসলিম দেশ আজ মিয়ানমারের নিন্দায় সরব, কই, তারা তো ইয়েমেনিদের বিরুদ্ধে সৌদির অভিযান কিংবা কুর্দিদের ওপর তুরস্কের নির্যাতন নিয়ে একটা কথাও বলে না? কিংবা চীন যেভাবে তিব্বতি বা উইঘোর মুসলিমদের সঙ্গে আচরণ করে তার প্রতিবাদেও তো কোনও সাড়াশব্দ শোনা যায় না!

(খ) বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা যেভাবে সারা দুনিয়ার নানা প্রান্তের মুসলিমকে এককাট্টা আর ‘হিংসায় উন্মত্ত’ করে তোলে, সে কারণেই কিন্তু অমুসলিম দেশগুলোতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের সেই সমাজের মূল স্রোতে ঢোকা কঠিন হয়ে ওঠে। (ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট, এই যুক্তি ভারত ও মিয়ানমারের মুসলিমদের জন্যও প্রযোজ্য।)

(গ) যারা বলছেন, বাংলাদেশ যেভাবে ভারতকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জঙ্গি তৎপরতা দমনে সাহায্য করেছে আমরা এর উপযুক্ত প্রতিদান দিতে পারিনি, তারাও ভুল বলছেন। বাংলাদেশকে বরং বুঝতে হবে, ভারত এই পরিস্থিতিতে (রোহিঙ্গা সংকট) সর্বোচ্চ যা করতে পারে সেটাই করছে– যদি তারা আশা করে থাকে ভারত মিয়ানমারের সমালোচনা করবে তাহলে কিন্তু তারা অন্যায় আশা করছে।

(ঘ) বাংলাদেশ এখনও সবচেয়ে বেশি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র কেনে চীনের কাছ থেকে। ভারত যেটার তীব্র বিরোধিতা করছে, চীনের সেই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের’ও সমর্থক বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে তারা যুক্তি দেয়, চীন ও ভারতের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক আলাদা– একটার সঙ্গে আরেকটার কোনও সম্পর্ক নেই। তা-ই যদি হবে, তাহলে ভারতেরও তো মিয়ানমার নীতি আর বাংলাদেশ নীতি সম্পূর্ণ আলাদা হওয়া উচিত!

(ঙ) বাংলাদেশ যেন মনে রাখে, সে দেশ থেকে ভারতে আসা দুই কোটিরও বেশি অবৈধ অভিবাসীকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি আপাতত আমরা ধামাচাপা দিয়ে রেখেছি (ডরম্যান্ট)। আর এ দেশে যে চল্লিশ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশ দিয়েই আমাদের দেশে ঢুকতে পেরেছে– সেটা মাথায় রেখে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত জরুরিভিত্তিতে সিল করার দিকেই এখন আগে নজর দেওয়া উচিত।

(চ) যারা বলছেন, ভারত চিরকাল সারা পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষকে আশ্রয় দিয়ে এসেছে, এই কনটেক্সটে এরচেয়ে বাজে কথা আর কিছু হতে পারে না। বরং ভাবার বিষয় হলো, যে মুসলিমরা জম্মু ও কাশ্মিরে হিন্দু শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার বিরোধিতা করে এসেছে– সেই রাজ্যে গিয়ে কিভাবে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম বসতি করতে পারলো? এর কারণ হলো, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে জম্মুর ডেমোগ্রাফি বদল করার চেষ্টা হয়েছে।

অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে এগুলো ভারত সরকারেরও মনের কথা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার মুখে যে কথাগুলো বলতে পারছে না– কানওয়াল সিবাল সেগুলোই প্রকাশ্যে লিখেছেন। ভারতের একটি নামী অর্থনৈতিক পত্রিকা তার ব্লগটি ছেপেছেও।

কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের জেরে যে বাংলাদেশকে বিনা অপরাধে বিরাট এক মানবিক বিপর্যয় সামলাতে হচ্ছে, তিনি তাদের ওপর এত খড়্গহস্ত কেন? বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল কানওয়াল সিবালের কাছে।

মেজাজি এই কূটনীতিক কেটে কেটে বললেন, ‘আমারও বাংলাদেশের জন্য সহানুভূতি আছে। কিন্তু তারা যদি মনে করে রোহিঙ্গাদের জন্য ভারত সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সব স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে মিয়ানমারের একতরফা নিন্দা করে যাবে, সেটা তো ঠিক হবে না, তাই না?’

টেলিফোন নামিয়ে রাখার আগে তিনি আরও যোগ করেন, ‘গত ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমার সেনা ও পুলিশের ওপর চালানো জঙ্গি হামলার পর থেকেই যে এই শরণার্থীদের আসা শুরু, সেটাও তো ভুললে চলবে না!’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন