দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

নির্বাচনের প্রস্তুতি নেই অন্তর্দ্বন্দ্বে বিভক্ত বান্দরবান বিএনপি শিবিরে

fec-image

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী বীর বাহাদুর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেও ভোটের মাঠে বিএনপির নড়াচড়া এখনো দৃশ্যমান নয়। এই মুহূর্তে ভোটের প্রস্তুতির চেয়েও নিরপেক্ষ সকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলন কর্মসূচি পালনে ব্যস্ত বান্দরবান জেলা বিএনপির দু’গ্রুপ। তবে নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য বিএনপির হাই কমান্ডের ইশারার অপেক্ষার প্রহর গুনছে জেলার নেতা কর্মীরা। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত পেলে যেকোনো মুহূর্তে নির্বাচনের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়বে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা, এমন কথাই জানালেন জেলা বিএনপি নেতৃবৃন্দ।

জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এককক প্রার্থী হিসাবে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন ছয় বারের সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি। এমন হেভিওয়েট প্রার্থীর সামনে চলমান অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা এবং রাজপরিবারের দুই সদস্য সাচিংপ্রু জেরী ও মাম্যাচিং এর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বিএনপির রাজনীতি। বান্দরবান জেলায় শহরসহ তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির ব্যাপক জনপ্রিয়তা, গ্রহণ যোগ্যতা ও জনসর্মথন থাকার পরেও দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিংয়ের কারণে বেশ বেকায়দায় রয়েছে বিএনপির রাজনীতি। এমনকি বর্তমান জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাথে আতাত করে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করার অভিযোগও দীর্ঘ দিনের।

বান্দরবান বিএনপির রাজনীতিতে অনেক দিনের দুই পরিচিত নাম সাচিং প্রু জেরী ও ম্যামাচিং মারমা। তাদের মধ্যে সাচিং প্রু জেরী কেন্দ্রীয় বিএনপির উপজাতি বিষয়ক সম্পাদক, সাবেক সংসদ সদস্য এবং জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান। অন্য দিকে মাম্যাচিং হচ্ছেন, বান্দরবান জেলা বিএনপির সভানেত্রী ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক মহিলা সংসদ সদস্য এবং সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। সাচিংপ্রু জেরী রাজ পুত্র এবং মাম্যাচিং রাজ পুত্র বধু। তারা দুজন সম্পর্কে মামী-ভাগিনা। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী বীর বাহাদুর উশৈসিং বিজয় লাভ করে। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বীর বাহাদুরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন বিএনপির প্রার্থী সাচিং প্রু জেরী। এই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীকে হারিয়ে আবারও জয় লাভ করেন তিনি। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বিএনপির মাম্যাচিং। সেই নির্বাচনে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে বিএনপি নেতা সাচিং প্রু জেরীও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই নির্বাচনে মাত্র ৮৫৩ ভোট বেশি পেয়ে আওয়ামী লীগের বীর বাহাদুর জয় লাভ করে। পক্ষান্তরে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী সাচিং প্রু জেরী ভোট পেয়েছিল প্রায় ১৪ হাজার। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বীর বাহাদুর। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দলের বহিষ্কৃত সাবেক সভাপতি প্রসন্ন কান্তি তংচঙ্গ্যা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই নির্বাচনে প্রশন্ন কান্তি তংচঙ্গ্যাকে হারিয়ে বীর বাহাদুর জয় লাভ করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী বীর বাহাদুরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বিএনপি প্রার্থী রাজপুত্র সাচিং প্রু জেরী। এই নির্বাচনেও বিএনপি প্রার্থীকে হারিয়ে বীর বাহাদুর ষষ্ঠ বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

বান্দরবান তৃণমূল বিএনপি নেতা কর্মীদের দাবি, বান্দরবান জেলার মাটি বিএনপির ঘাঁটি। বান্দরবান জেলায় শহীদ রাষ্ট্রপ্রতি জিয়াউর রহমানে অনেক অবদান, উন্নয়ন ও স্মৃতি রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। যার ফলে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে বিজয়ী বিএনপির দলীয় প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু দীর্ঘ বছর ধরে বান্দরবান জেলা বিএনপি দুই ভাগে বিভক্ত এবং জেলা বিএনপির এক শীর্ষ নেতা আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং ক্ষমতাসীন দল থেকে অর্থনৈতিক নানান সুবিধা গ্রহণ করে মাঠে বিএনপির রাজনীতি দুর্বল করে রেখেছেন। যার কারণে বিএনপির রাজনীতির মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পাচ্ছে না। জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা জানান, ২০১৭ সালে মাম্যাচিংকে সভাপতি, মো. জাবেদ রেজাকে সাধারণ সম্পাদক ও মো. জসিম উদ্দীন তুষারকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট বান্দরবান জেলা বিএনপির আংশিক কমিটির অনুমোদন দেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শর্ত ছিল পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি গঠন করে কেন্দ্রের অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, ২১ সদস্য বিশিষ্ট জেলা বিএনপির আংশিক কমিটির মেয়াদ বর্তমানে ছয় বছর অতিবাহিত হয়েছে। এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি আলোর মুখ দেখেনি। তারা আরো জানান, ২১ সদস্য বিশিষ্ট জেলা বিএনপির আংশিক কমিটিতে সভাপতি মাম্যাচিং, সাধারণ সম্পাদক মো. জাবেদ রেজা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জসিম উদ্দীন তুষার ছাড়া তাদের সাথে অন্য কেউ নেই। এই কমিটিতে বাকী ১৮ জনের মধ্য ১৪ জন এই কমিটির প্রতি অনাস্থা জানিয়ে তাদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ২ জন আওয়ামী লীগে যোগদান করেছে এবং বাকী ২ জন দলীয় কার্যক্রম থেকে বিরত রয়েছে। জেলা বিএনপির আংশিক কমিটি বর্তমানে ৩ সদস্য বিশিষ্ট সমিতিতে পরিণত হয়েছে। তারা আরো জানান, কেন্দ্রীয় বিএনপির হস্তক্ষেপে বান্দরবান জেলা বিএনপিকে পুর্নগঠন করে শহীদ জিয়ার আর্দশের সৈনিক ও ত্যাগী কর্মীদের সমন্বয়ে জেলা কমিটি ঢেলে সাজানো হলে বান্দরবানে রাজনীতির মাঠে বিএনপির বিকল্প থাকবে না।

এ ব্যপারে বান্দরবান জেলা বিএনপির সভাপতি ম্যামাচিং বলেন, আমরা এই মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ফ্যাসিবাদী সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অীধনে নির্বাচনের দাবিতে আমরা মাঠে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার জন্য যখন কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা আসবে তখন আমরা প্রস্তুতি নিব। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে দলের হাই কমান্ড সিদ্ধান্ত নেবে বান্দরবান আসনে প্রার্থী কে হবে। স্থানীয় বিএনপি পরিবারের নেতা কর্মীদের দাবি ও পছন্দের ভিত্তিতে দলের হাই কমান্ড যে সিদ্ধান্ত নেবেন তাই হবে। জেলা বিএনপির এক শীর্ষ নেতা কর্তৃক আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত ও অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দলীয় কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ সরকারের তিনি নানান সমালোচনা করে থাকেন। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে যদি তিনি অনৈতিক সুবিধা নিতেন তাহলে তিনি প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করতে পারতেন না। তরুণ বয়সে দলের হাল ধরে দলকে শক্তিশালী করায় আমাদের বিপক্ষের লোকজন ঈর্ষান্বিত হয়ে এসব অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। ত্রিশ দিনের আংশিক জেলা কমিটি ছয় বছরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে ব্যর্থতার বিষয়ে তিনি বলেন, নিশ্চিই কেন্দ্রীয় হাই কমান্ড আংশিক জেলা কমিটির প্রতি সন্তুষ্ট তাই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে আমাদের প্রতি কোনো চাপ ছিল না।

এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় বিএনপির উপজাতি বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য রাজ পুত্র সাচিং প্রু জেরী বলেন, বান্দরবানে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে চলমান সরকার পতন আন্দোলনকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে এই ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের হাত থেকে দেশ, গণতন্ত্র ও দেশের জনগণকে উদ্ধার করতে হবে। কেন্দ্রীয় নানান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে আমরা তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ে সব সময় রাজ পথে আছি, থাকবো। একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ ফিরে না আসা পর্যন্ত একজন বিএনপির নেতাকর্মীও ঘরে ফিরবে না। সাচিং প্রু জেরী বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসলে দল যদি নির্বাচনে অংশ নেয় সেই ক্ষেত্রে একজন প্রার্থী হিসাবে বান্দরবান আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন তিনি। জনপ্রিয়তা যাচাই ও যোগ্যতা বিবেচনায় দল তাকে মনোনয়ন দেবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন, বান্দরবান, বিএনপি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন