পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি কর্তৃক বাঙ্গালিদের উপর নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে গেছে

fec-image

দিন যত যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালিদের উপর উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের অত্যাচার, নিপীড়ন শুধু বাড়ছেই। হত্যা, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণের মতো হেন কোনো অপরাধ নেই যা তারা বাঙ্গালিদের উপর করছে না। এসব ঘটনার কিছু কিছু প্রকাশ্যে এলেও পাহাড়ি অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের ভয়ে অধিকাংশ ঘটনাই নীরবে সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন নিরীহ বাঙ্গালিরা। তারা জীবনের ভয়ে না পারছেন কাউকে বলতে, না পারছেন আইনের আশ্রয় নিতে। ব্যতিক্রম কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে থানা বা আদালতে মামলা হলেও, সেসব মামলায় আসামিরা ধরা পড়ে না। এসব উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার সক্ষমতা নেই পুলিশের। যৌথবাহিনীর হাতে কখনো কখনো উপজাতীয় কোনো সন্ত্রাসী আটক হলেও তার বিচার হয় না। কারণ, এসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়ে কেউ নিজের জীবনের উপর হুমকি ডেকে আনতে চায় না। ফলে প্রকাশ্যে কাউকে খুন করার পরেও তাদের বিরুদ্ধে আদালাতে অপরাধ প্রমাণ করা যায় না।

সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে রাঙ্গামাটির জুড়াছড়িতে। জুরাছড়ি ধামাইপাড়ার দয়া ধন চাকমার ছেলে সুনীল কুমার চাকমা(৪৬) জুরাছড়ির হাসপাতাল এলাকার ১৭ বছর বয়সী এক বাঙ্গালি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কিশোরীকে ঘরে একলা পেয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে। স্থানীয়রা বলছেন, সুনীল কুমার চাকমা বাঙ্গালি ওই কিশোরীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেছে এবং এতে মেয়েটির অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু লাজ-লজ্জার ভয়ে মেয়েটির পরিবারের পক্ষ থেকে সেটা না বলে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ দিয়ে জুরাছড়ি থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছে।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো বাঙ্গালি ছেলে দ্বারা কোনো পাহাড়ি মেয়ের ক্ষেত্রে এমন কোনো ঘটনার খবর পাওয়া গেলে পাহাড় এবং সমতলের কিছু চিহ্নিত তথাকথি সুশীল শ্রেণির মানুষ মিছিল-মিটিং করে পুরো দেশ উত্তপ্ত করে ফেলে। অথচ, জুরাছড়ির একটি একটি বাঙ্গালি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ে চাকমা সম্প্রদায়ের একজনের দ্বারা যখন যৌন নির্যাতনের শিকার হলো, তখন এই ঘটনার প্রতিবাদ কিংবা নিন্দা জানানোরও প্রয়োজন মনে করল না কেউ। এমনকি এই ঘটনায় টু-শব্দটিও তাদের মুখ থেকে বের হলো না। বাঙ্গালিরা পাহাড়ে নির্যাতিত হলে, সেটা যেন কোনো অপরাধ নয়, বাঙ্গালিদের যেন কোনো মানবাধিকার নেই। তাদের বিরুদ্ধে যা খুশি করা যায়, এটাই হলো বাস্তবতা।

কয়েকদিন আগে রাউজানের শিবলী সাদিক হৃদয় নামের এক কলেজছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। গত ২৮ আগস্ট রাতে রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের পঞ্চপাড়া গ্রাম থেকে অপহরণের শিকার হয় হৃদয়। উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে চারজন তার হাত-পা চেপে ধরে। একজন গলায় ছুরি চালায়। শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে মৃত্যু নিশ্চিত করার পর শরীর থেকে গোশত আলাদা করা হয়। এরপর গোশত এবং হাড়গোড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয় পাহাড়-জঙ্গলে।

কতটা নিষ্ঠুর আর হিংস্র হলে একজন মানুষকে জবাই করে তার হাড়-গোশত আলাদা করে পাহাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে পারে সন্ত্রাসীরা তা কি ভাবা যায়? গরিব বাবা-মায়ের কলিজার টুকরা হৃদয়কে নির্মমভাবে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি এই সন্ত্রাসীরা, হত্যার করার পর ছেলেকে মুক্তি দেয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে হৃদয়ের বাবার কাছ থেকে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণও নিয়েছে এই নিষ্ঠুর সন্ত্রাসীদের দল। হৃদয়ের বাবার ২ লাখ টাকা দেয়ার সামর্থ্য ছিল না, কিন্তু নিজের সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশায় মানুষের কাছ থেকে ধারকর্য করে কোনো রকমে যোগাড় করেছিল টাকাগুলো। ঋণ করে টাকা দিয়েও ছেলের মুখ আর দেখা হলো না বাবা-মায়ের।

শুধু এই হৃদয় না রাউজান-রাঙ্গুনিয়া-কাউখালী বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায়ই খবর আসে, ইটের ভাটা বা অন্য কোনো কাজের শ্রমিকদের অপহরণ করেছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। কখনো বাঙ্গালি মালিক বা ম্যানেজারদের অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা নির্যাতন-অত্যাচার করে আদায় করে মোটা অংকের মুক্তিপণ। যারা মুক্তিপণ দিতে পারে তারা হয়তো কোনো রকমে জীবন নিয়ে ফিরে আসে, আর যারা পারে না তাদের হত্যা করা নিষ্ঠুরভাবে। হৃদয়ের মতো কারো কারো ক্ষেত্রে তো মুক্তিপণ দেয়ার পরও জীবন দিতে হয় এই সন্ত্রাসীদের হাতে।

গত ২০ সেপ্টেম্বর বুধবার দীঘিনালায় জামসেদ মিয়া (৩৫) নামে এক বাঙ্গালি যুবককে কুপিয়েছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। রাত সোয়া দশটার সময় উপজেলার কবাখালী ইউনিয়নের হাজাছড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এঘটনায় জামসেদের ঘাড়সহ বেশ কয়েক জায়গায় এলোপাতাড়ি দায়ের কোপের চিহ্ন রয়েছে। জামসেদ পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। বুধবার রাতে সাজেক থেকে ফেরার পথে হাজাছড়া এলাকায় তার উপর হামলা করে পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা। ঘটনার পর তাকে উদ্ধার করে দীঘিনালা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালে প্রেরণ করেন।

এই দীঘিনালায় গত ৫ মে (শনিবার) মোহাম্মদ মোস্তফা (৫১) নামের এক বাঙ্গালি পাহাড়ে বন মোরগ শিকার করতে গেলে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা তাকে অপহরণ করে। এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে তখন উপজাতীয় বিভিন্ন আইডি থেকে মোস্তফাকে অপহরণের জন্য এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে দায়ী করে লেখালেখি করতেও দেখা যায়। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, পাহাড়ের উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের যে গ্রুপই তাকে অপহরণ করে থাকুক না কেন, শেষ পর্যন্ত তার ভ্যাগে কী ঘটেছে তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। তার স্ত্রী-সন্তানরা আর কোনো তাদের প্রিয় মানুষকে ফিরে পাবেন সেই নিশ্চয়তাও নেই। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে পরিবারটি। চোখের পানি ছাড়া তাদের আর কোনো সম্বল নেই।

উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যও করতে পারছে না পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালি ব্যবসায়ীরা। আগে এক জেএসএসকে চাঁদা দিলেই চলত, কিন্তু এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে ইউপিডিএফ প্রসীত, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, জেএসএস এম এন লারমাসহ আরো ছোট বড় নানা সন্ত্রাসী গ্রুপ। যখন যে যেভাবে পারছে চাঁদার জন্য হামলে পড়ছে, চাঁদা দিতে না চাইলে বা পরিমাণে কম দিলেই অত্যাচার নির্যাতন শুরু হয়ে যায়। কখনো কখনো গাড়িসহ মালামাল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ধংস করে দেয় এই উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। কৃষকদের ফলানো যেকোন ধরনের ফসল থেকেই চাঁদা দিতে হয়, এমনকি হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল কোনো কিছুই বাদ যায় তাদের চাঁদাবাজি থেকে।

কয়েকদিন আগের খবর, রাঙ্গামাটির কাউখালীতে ১২ বছর ধরে ১৫০ বাঙ্গালি পরিবারের ৩ শত একর জমির খাজনা নিচ্ছে না রাঙ্গামাটির কাউখালীর ১০১নং ঘিলাছড়ি মৌজার উপজাতীয় হেডম্যান পুষ্পল কুসুম তালুকদার। আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম হেডম্যান এসোসিয়েশনের নির্দেশে উল্লেখিত এলাকার খাজনা নিচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন এ মৌজা হেডম্যান। ফলে দেশের একজন বৈধ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রের সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে ঘিলাছড়ির দেড় শতাধিক পরিবার। উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ঘাগড়া ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডজুড়ে ঘিলাছড়ি মিয়াপাড়া এলাকার অবস্থান। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সরকার দেশের বিভিন্ন অবস্থান থেকে এসব ভুমিহীনদের ঘিলাছড়ি মিয়াপাড়া নামক স্থানে পূনর্বাসন করে।

১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত শান্তিবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান অনেকে। এসব বাঙ্গালি পরিবারকে বিতাড়িত করতে এহেন কোন নির্যাতন বাকী রাখেনি তৎকালীন শান্তিবাহিনী। জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে যে জমি তারা আগলে রেখেছেন, খাজনা দিতে না পারায় তারা এখন সেই জমির মালিকানা হারানোর আশঙ্কায় দিন গুনছেন।

অন্যদিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলায় পাহাড়ি-বাঙালি ভূমিবিরোধ তীব্র হয়ে উঠেছে। বাঙালিদের নামে সরকারি বরাদ্দকৃত বহু প্লট পাহাড়িরা দখল করে নিয়ে পাহাড়িরা। বাঙালিদের নিরাপত্তা ও জীবনধারণ রীতিমতো হুমকির মুখে পড়েছে। উপজাতীয়দের থেকে ভূমি উদ্ধার এবং ভূমির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের আবেদন জানিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন বাঙালিরা। স্মারকলিপিতে বলা হয়- রামগড় উপজেলার তৈচালাপাড়া গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা বাটনা শিবির, তৈসাগাড়া, থানা চন্দ্রপাড়া এলাকায় ১৯৮০-৮১ সালে খাসজমিতে সরকার প্রদত্ত ৫.০০ একর করে টিলাভূমি বন্দোবস্ত পান। ওইসব এলাকার বসতবাড়ি এবং বাগ-বাগিচা সৃজনের মাধ্যমে এবং নিয়মিত সরকারকে ভূমির খাজনা পরিশোধ করে বসবাস করে আসছিলেন।

কিন্তু ১৯৮৯ সালে শান্তিবাহিনী ব্যাপক হারে বাঙালি গণহত্যা চালালে পুরো পাহাড়ি অঞ্চলে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তৎকালীন বিডিআর ক্যাম্পসংলগ্ন তৈচালা এলাকার গুচ্ছগ্রাম তৈরি করে। একই সাথে বিক্ষিপ্ত পাহাড়ি এলাকায় সব বাঙালি বসতি সরিয়ে গুচ্ছগ্রামে নিয়ে আসে। মাসে পরিবার প্রতি ৮৫ কেজি মিশ্র গম ও চাল দেয়া হয়। আশ্বাস দেয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি পরিস্থিতি বিরাজমান হলে আবার তাদের বসতবাটিতে পুনর্বাসন করা হবে। ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতির সাথে সম্পাদিত সরকারের শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পরও বাঙালিদের পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

২০১৮ সালের পরবর্তী সময় থেকে পাহাড়ি সশস্ত্র সদস্যরা বাঙ্গালিদের ওইসব এলাকায় যেতে নিষেধ করে। বিভিন্ন সময় হামলা, মারধর ও অপহরণের মাধ্যমে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। ২০১৮ সালের পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসীরা বান্দরবানের কয়েকটি উপজেলা থেকে উপজাতীয় পরিবার এনে জোরপূর্বক বাঙালিদের ভিটায় বসতি স্থাপন করে। ধীরে ধীরে ওইসব এলাকায় ব্যাপক আকারে বাঙ্গালিদের ভূমি দখল করে নিচ্ছে। খাগড়াছড়ির মহালছড়ি, দীঘিনালার সোনা মিয়া টিলা, রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার আদারকছড়াসহ আরও বহু জায়গায় বাঙ্গালিদের কবুলিয়তভুক্ত জায়গা উপজাতীয়রা নানাভাবে দখল করে নিয়েছে।

হত্যা, গুম, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ এমন কোনো পন্থা বা সন্ত্রাসী কায়দা নেই যা উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে না। দিন যত যাচ্ছে, তাদের অত্যাচার, নিপীড়ন শুধু বাড়ছেই। প্রশাসন, রাষ্ট্র যেন এক্ষেত্রে নির্বিকার। পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। এখানে তারা বাঙ্গালিদের হত্যা করলেও যেন রাষ্টের কিছু করার নেই, বাঙ্গালি নারীরা উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের দ্বারা ধর্ষিত হলেও তাদের যেন বিচার পাওয়ার অধিকার নেই। নেই তাদের কোনো নাগরিক অধিকার, নেই কোনো মানবাধিকার। কিন্তু এমন জাতিগত নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা আর কত সহ্য করতে হবে পার্বত্য বাঙ্গালিদের? প্রশাসন, রাষ্ট্র এবং সকল মানবিক মানুষের বিবেকের কাছে এটাই আমাদের জিজ্ঞাসা।

♦ লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন