পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ১৭ বছর: শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে

পার্বত্য শান্তিচুক্তি

ফাতেমা জান্নাত মুমু:

আধিপত্যের লড়াই, সংঘাত-সহিংসতা আর আতঙ্কের মধ্যদিয়ে পার হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ১৭ বছর। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা সন্তু লারমা ।

 

এ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র গ্রুপ শান্তিবাহিনীর দীর্ঘ প্রায় দু’দশকের সশস্ত্র সংগ্রামের। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র আন্দোলনকারীদের একাংশ।

১৯৯৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারী চুক্তি অনুযায়ী খাগড়াছড়ি ষ্টেডিয়ামে শান্তিবাহিনীর ৭৩৯ সদস্যের প্রথম দলটি সন্তু লারমার নেতৃত্বে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট অস্ত্রসমর্পন করেছিল। পরবর্তীতে ১৬ ও ২২ ফেব্রুয়ারী রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে ৪ দফায় শান্তিবাহিনী মোট ১৯৪৭ জন অস্ত্র সমর্পন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।

অভিযোগ রয়েছে, পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হলেও পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসেনি। চুক্তি মানা না মানা নিয়ে বেড়ে গেছে পাহাড়ী দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের সংঘাত। নতুন করে সৃষ্টি হয় পাহাড়িদের আরো দুটি সশস্ত্র গ্রুপ। অভ্যন্তরীণ সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় চুক্তির সকল অর্জনকে ম্লান হয়ে গেছে। পাহাড়ে প্রতিনিয়ত হত্যা, অপহরণ চাঁদাবাজীর ঘটনা বাড়ছে। সেই সাথে বেড়ে চলে আধিপত্যের লড়াই। গত ১৭ বছরে তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। যার সঠিক কোন হিসাব জানা নেয়। রেহাই পায়নি সাধারণ বাঙালীরাও। চাঁদাবাজীতে জিম্মী পাহাড়ি এলাকার মানুষগুলোর জীবন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা বলেন, চুক্তির বেশিরভাগ বিষয়ই বাস্তবায়ন হয়েছে। চুক্তিতে ৭২টি শর্ত আছে, তার মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। আর ১৫টি আংশিকভাবে হয়েছে এবং ৯টি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আশাকরা হচ্ছে বাকী ধারাগুলোও শিগির বাস্তবায়ন হবে।

এদিকে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ১৭ বছর পর চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করলেন জনসংহতি সমিতির নেতারা। এই চুক্তির অধিকাংশ শর্ত সরকার বাস্তবায়ন করেনি বলে অভিযোগ তাদের।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএসের সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজিব চাকমা বলেন,পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সরকারে পক্ষ থেকে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তার সাথে বাস্তবে কোন মিল নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সর্বমোট ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। আর অবাস্তবায়িত রয়েছে ৩৪টি ধারা এবং আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে ১৩টি ধারা। তার অর্থ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এক কথায় চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, পার্বত্যাঞ্চলে যুগ যুগ ধরে বসবাসরত বাঙালীদের অভিযোগ সরকার সন্তু লারমার সাথে পার্বত্য চুক্তি করে পাহাড়ে বাঙালীদের অধিকার বঞ্চিত করেছে।

রাঙামাটি নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটি সদস্য সচিব, মো.জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বলেন, পার্বত্য এলাকায় শান্তির জন্য শান্তিচুক্তি করা হলেও এখনো পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসেনি। আর যাদের জন্য চুক্তি করা হয়েছিল তারাই এখন অভ্যন্তরীণ সংঘাতে লিপ্ত।

রাঙামাটি মহিলা সংসদ সদস্য, ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতির সঙ্গে যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়ে ছিল তার সিংহ ভাগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী গত ১৭ বছরে প্রত্যাগত শান্তিবাহিনীর সদস্যদের পূর্নবাসন, সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারসহ স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন সংশোধন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় গঠন করে চুক্তির অনেক ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে। আর চার কি পাঁচটা উপধারা বাস্তবায়ন হয়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি যদি সরকারকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করে তাহলে বাকী ধারাগুলোও অচিরেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন