পালিয়ে বেড়াচ্ছে মুকুল চাকমার পরিবার

মুকুল চাকমা

ফারুক হোসাইন, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে :

সাত মাস আগে অপহৃত হয়েছেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট মুকুল কান্তি চাকমা। এখনো পর্যন্ত তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। বেঁচে আছেন নাকি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে কিছুই জানে না পরিবার। ঘটনার পর মামলা করতে গিয়ে বারবার ফিরে এসেছে তার পরিবার। অবশেষে এক মাস চার দিন পর মামলা নিয়েছে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি থানা পুলিশ। সে মামলার আসামিরা গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে ছাড়াও পেয়েছে।

তবে মামলা তুলে নিতে অব্যাহতভাবে হুমকী পাচ্ছে মুকুল চাকমার পরিবার। মামলা না তুললে পরিবারের সকলকেই মেরে ফেলার হুমকীও দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। বেঁচে থাকার আশায় দুই মেয়ে নমিসা চাকমা ও মনিসা চাকমাকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মুকুল চাকমার স্ত্রী সাধনা চাকমা। বন্ধ হয়ে গেছে তাদের পড়াশুনাও। খেয়ে না খেয়ে আজকে এক জায়গায় তো কাল অন্য জায়গায় এভাবেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, স্বামী ও বাবার বিচার চেয়ে পুলিশ, প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের দ্বারে দ্বারে ধরণা দিচ্ছেন তারা।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মুকুল কান্তি চাকমাকে গত ৩০ মে উগলছড়ির লাইল্যাঘোনে বাঘাইছড়ি উপজেলা জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি প্রভাত কুমার চাকমা (কাকলী বাবু) ও সাধারণ সম্পাদক বড়ঋষি চাকমা ডেকে নেয়ার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন।

ঘটনার পরদিন থেকেই মেয়ে নমিসা চাকমা থানায় প্রতিদিনই চেষ্টার পর অবশেষে একমাস চারদিন পর ৪ জুলাই নিখোঁজের বিষয়ে মামলা নেয় বাঘাইছড়ি থানা পুলিশ। ওই মামলায় আসামি করা হয় বড়ঋষি চাকমা, প্রভাত কুমার চাকমা, জেএসএস-এর স্থানীয় নেতা ত্রিদিব চাকমা (৫০), বিস্তার চাকমা, মানিক চাকমা (আবিষ্কার), খোকন চাকমা, প্রীতি বিকাশ চাকমা, অজয় চাকমা এবং জুপিটার চাকমাসহ অজ্ঞাত আরও ৮ থেকে ১০ জনকে। মামলায় চার আসামি বড়ঋষি চাকমা, প্রভাত কুমার চাকমা, ত্রিদিব চাকমা ও অজয় চাকমাকে গ্রেফতার করে পুলিশ তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চায়।

২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাদের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরপর আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে যান তারা। অন্য আসামিরা পলাতক রয়েছেন।

মামলার বিবরণে জানা যায়, চলতি বছরের ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি বাঘাইছড়ির রাবার বাগান এলাকায় অস্ত্রধারী জেএসএস সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুকুল চাকমার যোগসাজশে এ ঘটনা ঘটেছে বলে আসামিরা অভিযোগ করেন।

স্থানীয় জেএসএসের অভিযোগ ছিল, সাবেক সেনা সার্জেন্ট হওয়ার কারণে মুকুল চাকমা সেনাবাহিনীর পক্ষে কাজ করেন এবং তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সেনাবাহিনীকে দিচ্ছেন। এমন সন্দেহে গত ৬ মে মুকুল চাকমাকে বাড়ি থেকে স্থানীয় বাঘাইছড়ি স্কুল মাঠে ডেকে নিয়ে মারধর করেন স্থানীয় জেএসএস নেতা বিস্তার চাকমাসহ অন্য সন্ত্রাসীরা।

এ ঘটনার পর বাড়ি ছেড়ে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে গিয়ে থাকতেন মুকুল। ঘটনার মীমাংসার কথা বলে ৩০ মে বিকেলে মোবাইলে ফোন করে উপজেলার উগছড়ির লাইল্যেঘোনার বক্কা চাকমার দোকানে মুকুলকে ডেকে নেন প্রভাত কুমার চাকমা। সেখান থেকে মুকুল একবার তার স্ত্রী সাধনা চাকমাকে ফোন করে বলেন, সেখানে প্রভাত চাকমা, আবিষ্কার চাকমা, ত্রিদিব চাকমা এবং বিস্তার চাকমা আছে এবং তিনি তাদের সঙ্গেই কথা বলছেন।

ওই দিন রাত ৮টায় মুকুল চাকমা আরও ফোন করে স্ত্রীকে বলেন এখনো তাদের সাথেই আছেন ফিরতে দেরি হবে। এরপর থেকেই মুকুল চাকমার ফোন বন্ধ হয়ে যায়। নিখোঁজ হয়ে যান মুকুল চাকমা। ঘটনার পরদিনই জিডি করার জন্য স্ত্রী সাধনা চাকমা ও মেয়ে নমিসা চাকমা থানায় গেলে ফিরিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে মামলা নেয় পুলিশ।

তবে মামলা করার পর থেকেই নিজেদের বাড়িতে থাকতে পারছে না মুকুল চাকমার পরিবার। মামলা তুলে নিতে প্রতিনিয়তই মোবাইলে ফোন করে হুমকী দিচ্ছে জেএসএসের সন্ত্রাসীরা। মামলা তুলে না নিলে বাবার মতো পুরো পরিবারের পরিণতি হবে বলে মেয়েকে জানায় তারা। অব্যাহত হুমকীর মুখে ঘর-বাড়ি ছেড়ে দুই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সাধনা চাকমা।

সম্প্রতি পার্বত্য এলাকায় গিয়ে কথা হয় সাধনা চাকমা ও তার দুই মেয়ের সাথে। চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী নমিসা চাকমা বলেন, আমাদের প্রতিটি দিনই কাটছে আতঙ্কে আর ভয়ে। কখন জানি আমাদের তুলে নিয়ে যায় জেএসএস সন্ত্রাসীরা। প্রতিদিন ফোন করে মামলা তুলে নেয়ার জন্য হুমকী দেয়া হচ্ছে। তারা বলছে, মামলা তুলে না নিলে বাবার মতো অবস্থা হবে, বংশ নির্বংশ করে দেবে।

নমিসা বলেন, ভয়ে আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এখন এক জায়গায় তো একটু পরে অন্য জায়গায়। আমার কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে পড়াশুনাও। ছোট বোনকে দেখিয়ে বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে কিন্তু স্কুলে যেতে পারছে না। বাবাকে ফিরে পেতে চান জানিয়ে বলেন, আমি আমার বাবাকে ফিরে পেতে চাই।

কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন কারো সহযোগিতা পাচ্ছি না। তিনি জানান, মুকুল চাকমাকে মারধরের পর পুলিশের অনেক গড়িমসির পরও বাঘাইছড়ি থানায় গত ২০ মে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর বারবার বাবার অপহরণের বিষয়ে মামলা করতে গেলে পুলিশ তাদের নানা কথা বলে বিদায় করে দেয়।

এদিকে সাধারণ ডায়েরি করার পরে পরিবারের অন্যান্য সদস্যকেও হুমকি দেওয়া হয়। চার-পাঁচজন মুখোশধারী লোক বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিয়ে আসে। এরপর পরিবারের সদস্যরা অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নেন। গত ৪ জুলাই আমাদের এজাহার গ্রহণ করে পুলিশ। আসামিরা আদালতে আত্মসমর্পণের পর জামিনে বেরিয়ে এসেছে। এখন মামলা তুলে নিতে ভয়-ভীতি দেখাচ্ছেন।

মুকুল চাকমার স্ত্রী সাধনা চাকমা বলেন, দুই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিজের বাড়িতে যেতে পারছেন না। মেয়ে দু’জনই কলেজ-স্কুলে যেতে পারছে না। তাদের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। মুকুল চাকমাকে জীবিত ফেরত চায় তার স্ত্রী ও মেয়েরা।

এ বিষয়ে রাঙামাটির পুলিশ সুপার (এসপি) সাঈদ তারিকুল হাসান বলেন, ‘মুকুল চাকমা অপহরণ মামলায় ৪ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারা এখন জামিনে আছে। ওই মামলায় (মুকুল চাকমা অপহরণ) সিটিং (বর্তমান) উপজেলা চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অনেক বিষয় চিন্তা করে কিন্তু এটা করতে হয়েছে।

নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে। তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এক মাস ৪ দিন পরে কেন মামলা নেয়া হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টা যত সহজে চিন্তা করছেন আসলেই তত সহজ না। যাদেরকে আসামি করা হয়েছে তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাদের গ্রেফতার করতে হলে অনেক বিষয় চিন্তা করতে হয়। কোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে আমি যেন অভিযোগগুলোর একটা প্রমাণ করতে পারি। অভিযোগের পেছনে মজবুত ভিত্তি থাকতে হবে যাতে প্রমাণ করা যায়। না হলে বিতর্ক তৈরি হবে।

তিনি বলেন, প্রস্তুতি নিয়ে মামলা না নিলে তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হতো না। তদন্ত শেষে যথাসম্ভব চার্জশিট দেওয়া হবে বলেও তিনি জানান। মুকুল চাকমার পরিবারকে হুমকী দেয়া হচ্ছে এ বিষয়ে জানেন কিনা জানতে চাইলে রাঙামাটির এসপি বলেন, তাদের হুমকি দিচ্ছে এ ধরনের খবর আমরা পাইনি। তাদের বাঘাইছড়ির বাসায় গেলে কাউকে পাওয়া যায় না বলে তিনি জানান।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন