পাহাড়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নববর্ষ উদযাপন

fec-image

বৈসাবি (বৈসুক, সাংগ্রাইং ও বিজু) উৎসব পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতিদের অতি তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এই উৎসবকে ত্রিপুরা ভাষায় বৈসুক, মারমা ও চাকরা ‘সাংগ্রাইং’ এবং চাকমারা ‘বিজু’ হিসেবে বাংলা বৎসরের শেষ দু’দিন এবং নববর্ষের প্রথম দিনসহ মোট তিনদিন যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিবৎসর পালন করে থাকে। যদিও তিনদিন কিন্তু এর রেশ বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত চলতে থাকে।

বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম মাস। নতুন বছর বরণে পহেলা বৈশাখ বাঙালির ঘরে ঘরে চলে বর্ণিল উৎসব। বাংলা নববর্ষ এবং চাকমাদের বিজু, মারমা জনগোষ্ঠীর সাংগ্রাইং, ত্রিপুরাদের বৈসু, তঞ্চঙ্গাদের বিষু এবং ম্রো, চাক, খেয়াং ও খুমি জনজাতির চাংক্রান উৎসবকে ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাগুলো উৎসবের আমেজে মেতে উঠে।

সারাদেশের মতো ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ উৎসবের পাশাপাশি পাহাড়ে বসবাসকারী ১১টি জনগোষ্ঠীর বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ কেন্দ্রিক বর্ণিল ও ঐতিহ্যবাহী আয়োজন করে থাকে।

পাহাড়ে বসবাসকারী ১১টি জাতিসত্তার মধ্যে খিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণে বম, পাংখো ও লুসাই খ্রিস্টাব্দ অনুসারে নববর্ষ উদযাপনের বাইরে নিজস্ব কোনো কর্মসূচি রাখে না।

তবে অন্যদের বাংলা বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ আয়োজনে তারাও অংশ নেয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে। অন্য আটটি জাতিসত্তার মধ্যে বর্ষবরণ উৎসব আয়োজনে কিছুটা ভিন্নতা পাওয়া যায়। বিশেষ করে চাকমা, ত্রিপুরা, ম্রো ও তঞ্চঙ্গ্যা জাতিগোষ্ঠী বঙ্গাব্দ পঞ্জিকা অনুসরণে তাদের কর্মসূচি সাজায়। মারমা জাতিগোষ্ঠী মিয়ানমারে ব্যবহৃত সাক্রয় পঞ্জিকা অনুসরণ করে। একই পঞ্জিকা অনুসরণের কারণে মারমাদের সাংগ্রাই উৎসবের সঙ্গে ম্রোদের চাংক্রান, খেয়াংদের সাংলান, খুমিদের সাংক্রাইন, চাকদের সাংক্রান অনুষ্ঠানে খুব একটা পার্থক্য নেই।

চাকমাদের নববর্ষ উৎসব

চাকমা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান আনন্দ-উৎসব বিজু। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়। ১২ এপ্রিল পালন করা হয় ফুলবিজু। এই দিন ভোরের আলো ফোটার আগেই ছেলে-মেয়েরা বেরিয়ে পড়ে ফুল সংগ্রহের জন্য। বিজু উৎসবকে আবার ৩ ভাগে উদযাপন করে থাকে। যথা- ফুল বিজু, মূল বিজু, এবং গয্যাপয্যা দিন।

চাকমারা নববর্ষ উৎসবে গয্যাপয্যা দিন পালন করে থাকে। ‘গয্যাপয্যা’ চাকমা শব্দ। যার বাংলা হচ্ছে ‘শুয়ে থাকা’। নববর্ষে চাকমারা সাধারণত বিভিন্ন আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যান এবং আনন্দ করে থাকেন। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে তারা গয্যাপয্যা দিনকে অতিবাহিত করে থাকেন।

গয্যাপয্যা দিন নামকরণ হওয়ার পিছনে ২টি কারণ উল্লেখ করা যায়। (১) চাকমারা বিশ্বাস করেন যে, নববর্ষে কাজ করলে সারা বৎসরই কাজ করে করে থাকতে হয়। সুতরাং এ দিনে শ্রমসাধ্য কাজ না করে বাড়িতে কাটালে সারা বৎসরই এভাবে খেতে পাওয়া যাবে। তাতে সুখ উপলদ্ধি হবে। এ বিশ্বাস থেকে এ দিনের নামকরণ গয্যাপয্যা দিন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। (২) সাধারণত মূল বিজুর দিনে প্রচুর পরিমাণে খানাপিনা হয়ে থাকে। এ খাবার হজম হতে সময়ের প্রয়োজন। নববর্ষে ভরাপেটে বাড়িতে বসে গড়াগড়ি দিয়ে থাকলে হজমে সহায়ক হবে। তাতে শারীরিকভাবে ভালো থাকা যাবে। গড়াগড়ি দিয়ে থাকা থেকে গয্যাপয্যা দিনের নামকরণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নামকরণ যেভাবে হোক না কেন বাস্তবে চাকমারা এ গয্যাপয্যা দিনে চাকমারা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেড়ে নেয় । গৃহিণীরা ঘর-দোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। বয়স্ক ব্যক্তিরা বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পিণ্ডদান, পঞ্চশীল গ্রহণ, ধর্মকথা শ্রবণ, বিকালে প্রদীপ পূজা দিয়ে সারা বছর যাতে সুখে শান্তিতে বসবাস করা যায় সে প্রার্থনাই করে থাকেন। গ্রামাঞ্চলে এ দিনে চাকমা গৃহিণীরা মালোঙ্খীমাকে ভাত দিয়ে থাকেন। সারা বছর যাতে অভাব অনটন না হয় সেজন্য মালোকখীমার উদ্দেশ্যে ভাত দেওয়া হয়। গয্যাপয্যা বা নববর্ষে চাকমারা সাধ্যানুযায়ী অবশ্যই মাংস দিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে থাকে।

মারমা নববর্ষ উৎসব

মারমারা নানা উৎসব পার্বণে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এর মধ্যে লোকজ উৎসব তথা সামাজিক উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা হিসাবে সাংগ্রাই-চৈত্র সংক্রান্তি বা নববর্ষ উৎসব মারমাদের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও সর্বজনীন বার্ষিক লোকজ উৎসব। তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই উৎসবের মধ্য দিয়ে মারমা সমাজের প্রচলিত সামাজিক আচার-আচরণ, রীতিনীতি, কৃষ্টি, প্রথা, বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণারও প্রকাশ ঘটে। অনুশাসনের আঙ্গিক রূপের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সমবেত বিভিন্ন সামাজিক পূজাপার্বণ ও আনুষ্ঠানিক কর্মসূচির প্রতিপালন। এই উৎসবকে ঘিরে মারমা সমাজ তাদের হারিয়ে যাওয়া পুরানো ইতিহাস ঐতিহ্য ও কীর্তিকর্মকে খুঁজে ফেরে।

এই উৎসব অনুষ্ঠান নতুন চিন্তা চেতনা নিয়ে এই সুমহান সাংস্কৃতিক গৌরবকে আবারো নতুন করে তুলে ধরে সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ করে এবং প্রতিপালন করার প্রবল আকাক্সক্ষা, উৎসাহ ও উদ্দীপনা যোগান দিয়ে যায়। অধিকন্তু ঐতিহ্যগত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব হিসাবে ‘ছোয়াই দগ্রী লং পোয়ে’ (শত সংঘের পিন্ডদান), ‘ঞংরেলং পোয়ে’ (বোধি বৃক্ষে পানি ঢালা উৎসব), ‘রাথা ঙাং পোয়ে’ (রথ টানা উৎসব), ‘মোওমাং পোয়ে’ (ফানুস উড়ানো উৎসব), ‘মেশীলা রাহাইং খাই পোয়ে’ (ভিক্ষু ভিক্ষুনীত্ব শীল গ্রহণ উৎসব), ‘সাক্রী পূজো পোয়ে’ (বয়স্ক পূজা), ‘রোওয়া সাংমা পূজো’ (বৃক্ষদেবী পূজা), ‘খ্যংসামা পূজো’ (খান দেবী পূজা), ‘ফরা রিখ্যো পোয়ে’ (বুদ্ধমূর্তির স্নানে গমন), ‘রোওয়া খাং পোয়ে’ (পাড়া প্রতিবেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান), ‘রিলং পোয়ে’ (মৈত্রী পানি ঢালা উৎসব) ইত্যাদি উৎসব মারমা সমাজে কোথাও কোথাও প্রতিপালন করতে দেখা যায়।

সাংগ্রাই এর প্রধান আকর্ষণ হল পানি খেলা যেটিকে মারমারা বলে ‘রিলং পোয়েঃ’। সাংগ্রাই উৎসবের শেষদিনে এই পানি খেলা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সাংগ্রাই আসলেই পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়াকেই বোঝায়। সেই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে নতুন জুম চাষের মৌসুমের শুরুও সাংগ্রাই-এর পরেই হয়ে থাকে। শুধু জুম চাষই নয় মারমারা মাঘী পূর্ণিমার পর থেকে সাংগ্রাই এর আগ পর্যন্ত নতুন বিয়েই করে না অর্থাৎ সাংগ্রাইকে মারমারা নতুন বছরের শুরুসহ পুরনো সব জিনিসকে ঝেরে ফেলে নতুন করে শুরু করাকেই বোঝায়। আর তাই মারমারা এক আনন্দঘন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আর্শীবাদ আর শুভাকাক্সক্ষার আশায় নতুন বছর উদ্যাপন করে থাকে।
মারমা সমাজে প্রচলিত ও প্রতিপালিত নানা ধর্মীয়, লোকজ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, লৌকিক ও পারিবারিক উৎসবের উৎস হলো বংশ পরম্পরায় কালক্রমে পূর্ব পুরুষদের আচার-আচরণ সমূহ যেগুলি দেখে, মুখে মুখে শিখে হাতে নাতে করে, বংশ পরস্পরায় উত্তরাধিকার সূত্রে চলে এসেছে। মারমারা খোলা আকাশের নিচে, নদীর তীরে, স্নানের ঘাটে, পাহাড়ের পাদদেশে বৃক্ষের নিচে, কখনো পাড়া গাঁয়ে, গ্রাম হতে গ্রামান্তরে, পথে প্রান্তরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রদক্ষিণ করে কখনো বা নাচে গানে, নিষ্ঠার সাথে প্রার্থনায় এসব উৎসব পালন করে চলেছে। কালের বিবর্তনে এসবের কিছু কিছুর বিকৃতি হয়তো ঘটেছে, ঘটেছে কিছু কিছু বিলুপ্তিও। তবুও যা আছে তা বিপুল। এই উৎসবের প্রায় সবকটি পর্ব কেবল তাদের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক পরিচয় বহন করে না, এতে তাদের পূর্ব পুরুষদের নৃ-তাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক পরিচয়সহ এই উপমহাদেশের সুপ্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসও।

ত্রিপুরাদের নববর্ষ উৎসব

ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর নববর্ষ উৎসব চৈত্র মাসের শেষ দুইদিন এবং বৈশাখ মাসের প্রথম দিন এই তিনদিনব্যাপী এ পালন করে থাকে। প্রথম দিনকে বলা হয় হারি বৈসু, দ্বিতীয় দিনকে বৈসুমা এবং তৃতীয় বা শেষ দিনটিকে বলা হয় বিসিকতাল।

হারি বৈসু: হারি বৈসুর দিনে ভোরবেলায় ফুলগাছ থেকে ফুল সংগ্রহ করার প্রতিযোগিতা শুরু হয় এবং এই ফুলে একাংশ দিয়ে পুরো বাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হয় এবং ফুলের আরেক অংশ দিয়ে নদীর তীরে, মন্দিরে এবং পবিত্র স্থানে ফুল, ধুপ এবং দীপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকে।

বৈসুমা: বৈসুমা হচ্ছে দ্বিতীয় দিন এবং এইদিনে মূলত খাদ্য উৎসব করা হয়। এই দিনে মানুষ একজন আর একজনের বাসায় ঘুরে দেখা সাক্ষাৎকার করে। বৈসুমা দিনের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে মিক্স সবজি যেটাকে ‘লাবড়া’ বলে ককবরক ভাষায়। এই লাবড়া তৈরির জন্য প্রায় ৩০-৪০ ধরনের সবজি দেয়া হয়। পাশাপাশি ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার গুলোর পাশাপাশি সেমাই, পায়েস, নুডলসসহ অনেক খাবার আইটেম থাকে।

বিসিকাতাল: তৃতীয় দিন হচ্ছে বিসিকাতাল এই দিনে নতুন বছরকে বরণ করা হয়। পরিবারের ছোটরা বড়দের পানি দিয়ে পা ধুয়ে প্রণাম করে। নতুন বছরে সবার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করা হয়।

বৈসুর সময় ত্রিপুরারা/ত্রিপুরিরা নিজেদের ঐতিহবাহী খেলা সুকুই (গিলা), ওয়াকরাই, চপ্রিং, কাংটি/কাং ইত্যাদি খেলা খেলে থাকে এবং পাশাপাশি ঐতিহবাহী গরয়া নৃত্য পরিবেশন করে। নতুন বছরের মঙ্গলের জন্য পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ‘কমা বতই’ (এক ধরনের পবিত্র পানি) ছিটানো হয়।

তঞ্চঙ্গ্যা নববর্ষ উৎসব

বিজু তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান আনন্দ-উৎসব। তঞ্চঙ্গ্যাগণ এ উৎসবটি তিন দিন ধরে পালন করেন। এ তিন দিন হল চৈত্রের শেষ ২ দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন। এর মাঝে চৈত্রের শেষ দিনটি এই উৎসবের মূল আকর্ষণ। এ দিন ঘরে ঘরে পাঁচ প্রকারের সবজি সহকারে বিশেষ খাদ্য পাজন রাঁধা হয়। তারা বিশ্বাস করেন এই পাঁচনের দৈব গুণাবলী আগত বছরের অসুস্থতা ও দুর্ভাগ্য দূর করবে। এদিন বিকেলে খেলা হয় ঐতিহ্যবাহী খেলা ঘিলা, বৌচি ইত্যাদি। তরুণীরা পানিতে ফুল ভাসিয়ে দেন। বিজু উৎসবের এই তিন দিন কেউ কোনো জীবিত প্রাণী বধ করেন না।

ম্রোদের নববর্ষ উৎসব

ম্রোরা নববর্ষকে তাদের ভাষায় চাংক্রান বলে। বাঁশির সুরের মূর্ছনায় ঢাকঢোল ও খাসার তালে তালে দল বেঁধে লোকনৃত্যে মাতিয়ে তোলে ম্রো তরুণ-তরুণীসহ নারী-পুরুষেরা।

লোকনৃত্য, কোমর তাঁত বুনন, পুঁতির মালা গাঁথা ও পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতার আয়োজন চলে এ দিনে। ম্রোদের ঐতিয্যবাহী লাঠি খেলা প্রতিযোগীতায় অংশ নেয় জেলার বিভিন্ন পাড়া থেকে দল বেধে শত শত যুবক-যুবতী নারী-পুরুষ। শক্তি ও কৌশল খাটিয়ে বাঁশ নিয়ে এক পাড়ার সাথে অন্য পাড়ার যুবক ও বিবহিতদের চলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। এ উৎসব পরিণত হয় ম্রো সম্প্রদায়ের মিলন মেলা হিসেবে।

ম্রো যুবকরা তাদের ঐতিয্যবাহী সাজ-পোশাকে পরিহিত করে মুখে ঠোঁঠে টকটকে লাল রং লাগায় আর খোপায় ও কানে পাহাড়ী ফুল গুজিয়ে উৎসবে আসে। আর যুবতীরা হাতে রুপার কাঁকন, পায়ে বালা ও গলায় রংবেরং এর পুঁতির মালা ও রুপার তৈরি গলা থেকে কোমর পর্যন্ত চেইন পরিধান করে চুলের খোপায় রংবেরং এর ফুল গুজিয়ে মুখে বিভিন্ন ধরনের প্রসাদনি লাগিয়ে রংবেরং পোশাকে উৎসব পালনে জড়ো হয়। অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী টাকেট খেলা অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবের প্রধান আকর্শন গো-হত্যা নৃত্য।

চাক নববর্ষ উৎসব

বৈসুক, সাংগ্রাইং ও বিজু ( বৈ-সা-বি) মূলত একই সময়ের উৎসব হলেও অঞ্চল ও নৃগোষ্ঠী ভেদে প্রত্যেকে নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে এ উৎসব পালন করে। চাকদের মাঝেও আবহমান কাল থেকে প্রতি বছর নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী এ সময় উৎসব পালিত হয়ে আসছে। সাংগ্রাইং উৎসব চাকদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে এমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এ উৎসবের মাধ্যমে চাক সমাজের প্রচলিত সামাজিক আচার- আচরণ, রীতি-নীতি, প্রথা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই শুভ ‘সাংগ্রাইং’ উৎসব প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে চাকরা সকল হিংসা, বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে একে অন্যকে সম্ভাষণ জানায় এবং মনের সমস্ত সংকীর্ণতা পরিহার করে অহিংসায় দীক্ষিত হয়ে এ উৎসবের সময় তাদের মাঝে বেড়ে যায় বৌদ্ধ মন্দিরে আসা-যাওয়া পূজা পার্বণের ব্যস্ততা, বয়স্ক-বৃদ্ধ-অক্ষম ব্যক্তিদের সেবা শুশ্রূষা ও পরিচর্যা, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, পুরনো বৎসরকে বিদায় এবং নববর্ষকে সাদর সম্ভাষণ জানায়। চাকদের সাংগ্রাইং উৎসব বর্মী সনের দিন ও তারিখ অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে বর্মী সংস্কৃতির কিছুটা প্রভাব দেখা যায়। সাংগ্রাইং চলাকালীন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ‘ছোঁয়াইং’ (ভাত ও নানা প্রকার তরকারি) রান্না করে দান করা হয়ে থাকে। যে খাদ্য সামগ্রী ভিক্ষু, শ্রমণ ও উপাসক-উপাসিকাদেরকে দান করা হয় তাকে চাক ভাষায় ‘ছোঁয়াইং’ বলে। মাছ, মাংস, শাক-সবজি ও ভাত ছোঁয়াইং-এর প্রধান উপকরণ।

লুসাই নববর্ষ উৎসব

লুসাই নববর্ষ উৎসব আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসবের সময়কাল তিন দিন যা ১৩ এপ্রিল শুরু ১৫ এপ্রিল শেষ হয়। এটি এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলতে পারে। উৎসব শুরুর প্রথম দিনটি হচ্ছে সদ্য গত হওয়া বছরের শেষ দিন। উৎসব উপলক্ষে বাসাবাড়ি ও গ্রাম প্রথম দিনই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ফেলা হয়। নববর্ষ উপলক্ষে সুগন্ধী, পানি ও ফুলও আয়োজন করে রাখা হয়। উৎসব শুরু হওয়ার পরের দিনটি হচ্ছে ‘না দিবস’, এটি এমন একটি দিন যা পুরোনো বা নতুন কোনো বছরেরই অন্তর্ভুক্ত নয়। আর উৎসবের শেষ দিনটি হচ্ছে নতুন বছরের শুরুর দিন।

খুমী নববর্ষ উৎসব

নববর্ষ উদযাপনে ‘চারানাহ’ নামক বিজয়ের নৃত্যে যুবকরা বাদ্যের তালে নাচে। নাচের সময় তারা বাদ্যযন্ত্র আলং ও আতং বাজিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন। তাদের সমাজে রয়েছে মুখে মুখে প্রচলিত লোককথা ও লোককাহিনী। খুমীরা নববর্ষ উদযাপন করে থাকে পহেলা বৈশাখে। এদিনে এরা নিজেদের সাজায় পাহাড়ি ফুল দিয়ে।

খিয়াং নববর্ষ উৎসব

খিয়াং জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেক ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হেনেই। খিয়াং জনগোষ্ঠী নববর্ষ উৎসবে হেনেই অনুষ্ঠানটিতে একাধিক পরিবারের লোকজন একজোট হয়ে উদযাপন করে থাকে। সাধারণত জুমের ধান রোপণের সময় বা জুমের ধান কাটার পরেও হেনেই অনুষ্ঠান করে। অনুষ্ঠানটি বছরে অন্তত তিন বার অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এটাকে নবান্ন উৎসবও বলা হয়। গ্রামের লোকজন তাদের সুবিধামতো একত্রিত হয়ে কোনো ছড়া বা ঝরনাধারার কাছে গরু বা মহিষ বধ করে অনুষ্ঠানটি পালন করে থাকে। উক্ত গরু বা মহিষের মাংস রান্না করে রীতিমতো পূজা-অর্চনা দিয়ে পাড়ার সকলে মিলেমিশে ভোজে অংশগ্রহণ করে। এ সময় কেউ কেউ মদ পান করে আনন্দে মেতে ওঠে।

গুর্খাদের নববর্ষ উৎসব

গুর্খাদের প্রধান এবং সবচেয়ে বড় উৎসব হল লোসার, ডিসেম্বরের শেষে এই উৎসবকে নববর্ষ হিসেবে পালন করা হয়। পশ্চিম তিব্বতের প্রাচীন বর্ষপঞ্জি অনুসারেই তাদের উৎসবগুলি পালিত হয়। তাদের প্রধান পেশা পশুপালন, এর মধ্যে ভেড়া পালন এবং শিকারও আছে। শেষের দিকে, তারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতেও যোগদান করেছিল এবং তাদের বলা হতো গোর্খা সৈনিক।

লোসার তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের একটি উৎসব। অঞ্চলভেদে নিজস্ব ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন তরিখে এটি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়।দিনটি নববর্ষ তথা নতুন বছরের সাথে সম্পর্কিত একটি উৎসব যা তিব্বতীয় বর্ষপঞ্জীর প্রথম দিনে (গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জীর ফেব্রুয়ারি বা মার্চ) পালিত হয়।
পাংখো নববর্ষ উৎসব

খোজিং-এর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য বৈশাখের শুরুতে নৃত্যানুষ্ঠানের রীতি প্রচলিত রয়েছে। পাংখোয়াদের বিশ্বাস, গভীর অরণ্যে খোজিং দেবতার অবস্থান। মূল খোজিং পূজা শ্রাবণ মাসে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই পূজা পাংখোয়া সমাজে সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে বিবেচিত হয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন