পুতিনের ক্ষেপণাস্ত্র-বৃষ্টিতে বিধ্বস্ত ইউক্রেন

fec-image

যুদ্ধ চলায় প্রায় প্রতিদিনই ছোটখাটো হামলার মুখে ছিল ইউক্রেন। কিন্তু গত ৮ অক্টোবর শক্তিশালী বিস্ফোরণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্রিমিয়া দ্বীপের সঙ্গে রাশিয়ার স্থল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম কের্চ সেতু (ক্রিমিয়ান সেতু)। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এটিকে ‘সন্ত্রাসী কাণ্ড’ উল্লেখ করে এর জন্য ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা বাহিনীকে দায়ী করেন। যদিও ইউক্রেন এখন পর্যন্ত এই হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করেনি।

তবে হামলাটি ‘আবেগে আঘাত করেছে’ বলে মন্তব্য করেন ক্রিমিয়ার মস্কো নিয়োগকৃত গভর্নর। ‘প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে’ বলেও জানান তিনি। গত ১০ অক্টোবর শুরু হয় পুতিন বাহিনীর সেই প্রতিশোধ। রাজধানী কিয়েভসহ গোটা ইউক্রেনে দফায় দফায় আঘাত হানে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র।

স্থানীয় সময় সকাল ৮টার দিকে শুরু হয় রাশিয়ার সমন্বিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিনের পর থেকে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় হামলা এবং এই প্রথমবার আঘাতপ্রাপ্ত হয় কিয়েভের কেন্দ্রস্থল।

ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনীর মুখপাত্র বলেছেন, রাশিয়া মোট ৮৩টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে ইউক্রেনে। এর মধ্যে কাস্পিয়ান সাগর ও কৃষ্ণসাগরের জাহাজ থেকে ক্যালিব্র ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং যুদ্ধবিমান থেকে কেএআইচ-১০১ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে।

বিভিন্ন ছবি ও ভিডিওতে দেখা গেছে, কিয়েভের কেন্দ্রস্থলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বহু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গাড়ি ধ্বংস হয়েছে এবং গাছপালা ভেঙে পড়েছে। একটি ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরণে শহরের দিকে যাওয়ার প্রধান সড়কে বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে। আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র রেলস্টেশনের কাছে পড়েছে। তৃতীয়টি কিয়েভের সাম্প্রতিক পুনর্জন্মের প্রতীক কাঁচের সেতুতে (গ্লাস ব্রিজ) আঘাত হেনেছে। বাকিগুলোর লক্ষ্যবস্তু ছিল নানা অফিস ভবন।

তবে অনেক ক্ষেপণাস্ত্রই এমন জায়গায় পড়েছে যার কাছাকাছি উল্লেখযোগ্য কোনো সামরিক লক্ষ্যবস্তু ছিল না। এটি ইঙ্গিত করছে, ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর লক্ষ্য হয় ভুল ছিল অথবা এই আক্রমণটাই চালানো হয়েছে এলোপাতাড়িভাবে।

হামলা চলাকালে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তার কিয়েভ অফিসের বাইরে রেকর্ড করা এক ভিডিওবার্তায় বলেছেন, রাশিয়া মূলত দুটি লক্ষ্যে মনোনিবেশ করেছে: জ্বালানি স্থাপনা এবং জনগণ। আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, আশ্রয়স্থল ছেড়ে বেরোবেন না। নিজের ও প্রিয়জনদের যত্ন নেন।

তীব্র হামলার মুখে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক টুইটে বলেছে, আমরা কখনোই আত্মসমর্পণ করবো না। তবে সোশ্যাল মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামে রুশপন্থি চ্যানেলগুলোতে ছিল আনন্দের বন্যা। তাদের ভাষ্য, এমন একটি দিনের জন্যই দীর্ঘসময় অপেক্ষায় ছিলাম।

এদিন কেবল কিয়েভেই হামলা হয়নি। ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর লভিভের মেয়র বলেছেন, তাদের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক, বিদ্যুৎ ও পানি সম্পর্কিত স্থাপনাসহ গুরুত্বপূর্ণ নানা অবকাঠামোতে আঘাত করেছে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র। আপাতত পানি তুলতে জেনারেটর ব্যবহার করা হচ্ছে এবং হামলায় শহরের এক-তৃতীয়াংশ ট্রাফিক সিগন্যাল অকেজো হয়ে গেছে।

কৃষ্ণসাগরের নিকটবর্তী শহর মাইকোলাইভের গভর্নর বলেছেন, গোটা ইউক্রেনে কমপক্ষে তিন দফায় হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। এর মধ্যে তৃতীয় দফায় ছোঁড়া হয়েছে ৪৭টি ক্ষেপণাস্ত্র। তার দাবি, এদিন রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি ইরানের দেওয়া সুইসাইড ড্রোনও ব্যবহার করেছে রাশিয়া।

এছাড়া মধ্য ইউক্রেনের দিনিপ্রো, ক্রিভি রিহ ও জাপোরিজিয়া এবং পূর্বে খারকিভসহ আরও অনেক শহরে ঝাঁকে ঝাঁকে রকেট হামলা চালানো হয়েছে। হামলায় খারকিভ সম্পূর্ণরূপে বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছে। ওডেসার সামরিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইউক্রেনীয় বন্দর শহরটিতেও ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে রাশিয়া।

ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী বেশ কিছু রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের দাবি, ৮৩টির মধ্যে অন্তত ৪৩টি ক্ষেপণাস্ত্র গুলি করে ধ্বংস করা হয়েছে। ইউক্রেনের এই দাবি যদি সত্য হয়, তবে বাধাদানের হার যথেষ্ট প্রশংসনীয়।

কিয়েভের সামরিক প্রশাসনের প্রধান ওলেক্সি কুলেবা ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানা স্থানের ছবি বা ভিডিওধারণ না করতে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। হামলা কতটা নিখুঁত হয়েছে সেই তথ্য রাশিয়ার হাতে যাওয়া আটকাতেই সম্ভবত এমন অনুরোধ জানিয়েছে ইউক্রেনীয় প্রশাসন।

তবে তীব্র আক্রমণের মুখে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে, ‘সারফেস টু এয়ার মিসাইল’ ফুরিয়ে আসছে এবং বিদেশি সহায়তার গতি কমে যাওয়ার উদ্বেগজনক প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে।

রাশিয়ার এই আক্রমণ ইউক্রেন যুদ্ধে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ও তার নিয়োগকৃত নতুন জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিনের অভিপ্রায় অন্তত তেমনটাই মনে হচ্ছে। গত ৯ অক্টোবর কের্চ সেতুতে হামলার পরের দিন নিরাপত্তা কাউন্সিলের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছেন পুতিন। এরপর কঠোর হুমকি দিয়ে বলেছেন, যদি (রাশিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচিত এলাকায়) হামলা অব্যাহত থাকে, এর প্রতিক্রিয়া কঠোর এবং হুমকির মাত্রার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউক্রেন, ক্ষেপণাস্ত্র, রাশিয়া
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন