বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী: “আঁর পোয়াইন্দার বাপ ইঞ্জিনিয়ার আছিল”

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

‘ছেলে মেয়ের বাবা কই’? শুধালে মাঝবয়েসী নূর আয়েশা চোখ মুছলেন। বললেন, ‘নাই’।

জানালেন, পালিয়ে আসার পথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। মাত্র বারো দিন আগের ঘটনা।তিনি যে ভাষায় কথা বলছেন, তার বেশিরভাগই আমার অজানা। কিন্তু এটুকু বুঝতে কষ্ট হল না।

সদ্য স্বামী হারানোর ক্ষত আর চারটি শিশু সন্তান নিয়ে তিনি অজানা এক দেশে এসে ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়েছেন। হাতে বা্ংলাদেশের কর্তৃপক্ষের দেয়া একটি টোকেন।

এটি দেখালে ত্রাণসামগ্রীতে পূর্ণ একটি প্যাকেট তিনি পাবেন। তার ভিতরে কি থাকবে, তাও জানা নেই। মাত্র ৫ দিন আগে বা্ংলাদেশে এসে পৌঁছেছেন। তার আগে ছদিন ধরে কখনো বাচ্চাদের নিয়ে হেঁটেছেন, কখনো জঙ্গলে, জলা কিংবা তৃণভূমিতে লুকিয়েছেন। পা দুটো ছড়ে গেছে। আহত। হাঁটতে পারছেন না। পায়ের দিকে বোরকা কিছুটা তুলে আমাকে দেখালেন।

আমার সঙ্গে থাকা স্থানীয় দোভাষী তাকে শুধালেন, তার স্বামী কি করতেন?

জবাবে তিনি বললেন, “আঁর পোয়াইন্দার বাপ ইঞ্জিনিয়ার আছিল।”

মূলত নূর আয়েশার স্বামীর ছিলেন। মোটরগাড়ি সারাইয়ের কারখানা। স্ত্রীর চোখে স্বামী একজন ইঞ্জিনিয়ার। মংডুতে কদিন আগেই নিজের কারখানা তৈরি করেন। কিন্তু সেটা আর চালু করা হয়নি তার।

এরই মধ্যে নূর আয়েশার ভাষায় ‘গণ্ডগোল’ লেগে যায় সেখানে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সেখানে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা রাখাইনের বেশীরভাগ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির তুলনায় একটু স্বচ্ছল ছিলেন।

তাদের বাড়ি মংডুর রেকোয়াং গ্রামে। সেখানে বারোদিন আগে হঠাৎ করে সেনবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা এসে বাড়িঘরে আগুন দিতে শুরু করে আর এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। সেই গুলিতেই বিদ্ধ হয় নূর আয়েশার স্বামী।

তারপর স্বামী বাচলো কি মরলো দেখার সুযোগ হয়নি তার। বাচ্চাদের নিয়ে গিয়ে পাশের লামারপাড়া গ্রামের এক বাড়িতে লুকোন। সৈন্যরা সেখানেও পৌঁছে যায়।

নূর আয়েশা বলছিলেন, ‘সৈন্যরা আমাদেরকে বলে, তোমরা হয় বাংলাদেশে চলে যাও নয়তো তোমাদের মেরে ফেলবো’।

তারপর শুরু হয় তাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার দীর্ঘ যাত্রা।

এরই কোন এক পর্যায়ে নূর আয়েশা জানতে পারেন তার স্বামী বেঁচে নেই।

বাংলাদেশে পাঁচ দিন আগে এসে পৌঁছান তিন মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে। সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। দুটি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তারা তার সঙ্গে নেই। তাদের খবরও নেই নূর আয়েশার কাছে।

একেবারে খালি হাতে এসে পৌছান টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে।

সেখানে কেউ একজন তাকে কিছু টাকা দিয়েছিল। এই দিয়েই চলেছেন এতদিন।

নূর আয়েশার আশ্রয় হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালি আশ্রয়শিবিরে।

আজ প্রথমবারের মত তিনি পেলেন সরকারি ত্রাণের টোকেন।

এই টোকেনের মাধ্যমেই এখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ পাচ্ছেন।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে এই ত্রাণ কার্যক্রম।

এখন পর্যন্ত যেটুকু বোঝা যাচ্ছে, প্রথম দিকের মতো ততটা বিশৃঙ্খল আর নেই এই ত্রাণ বিতরণ।

বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা আর বাংলাদেশের হৃদয়বান ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে যা পাওয়া যাচ্ছে তাই মোটামুটি একধরণের সমবন্টন প্রক্রিয়ায় দেয়া হচ্ছে শরণার্থীদের।

আর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে কথা বলে যা বোঝা যাচ্ছে, তাতে এই বিতরণ প্রক্রিয়ায় অসন্তোষ নেই তাদের মধ্যে। বরং তারা মনে করছেন, আগের চাইতে বরং এখন বেশী পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী তাদের ভাগে জুটছে।

আর তাতে তাদের শরণার্থীর জীবন মোটামুটি চলেও যাচ্ছে।

 

সূত্র: বিবিসি

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন