বাংলাদেশ-ভারতের অংশগ্রহণে শেষ হলো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বারুণী স্নানোৎসব

18

এম. সাইফুর রহমান, খাগড়াছড়ি:

উৎসবের আমেজ গুটিয়ে দিতে পারে দু’দেশের সীমানা, ত্রিপুরা রাজ্যের সাভ্রুমের বারনি মেলায় গেলে দেখা যাবে এমনই চিত্র। ভারত-বাংলাদেশের অগণিত মানুষের অংশগ্রহণে উৎসবমুখর হয়ে উঠে গোটা সাব্রুম। ঐতিহ্যবাহি বারুণী স্নানোৎসবকে ঘিরে রামগড়-সাবরুম সীমান্তে ফেনী নদী পরিনত হয় দু’দেশের নাগরিকদের মিলন মেলায়। পুণ্যার্থী ও দর্শণার্থীর সমাগমে মুখরিত থাকে ফেনী নদী। প্রতিবছর বারুণী মেলাকে ঘিরে (১দিন) সবার জন্য সীমান্ত উম্মুক্ত করে দেওয়া হয় উভয় দেশের সীমান্ত।

বৃটিশ আমল থেকেই চৈত্রের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশি তিথিতে প্রতিবছর ফেনী নদীতে বারুণী মেলায় মিলিত হন দুই দেশের হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ। প্রাপ্ত তথ্য মতে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য তর্পণ করে এখানে। রামগড় ও সাবরুম অংশে নদীর দুই তীরে দুই দেশের পৌরহিতরা সকালেই বসেন পূজা অর্চণার জন্য। পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা ছাড়াও নিজের পূণ্যলাভ ও সকল প্রকার পাপ, পংকিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ফেনী নদীর বারুণী স্নানে ছুটে আসেন সনাতন ধর্মাবলম্বী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা।

বাংলাদেশ পার্বত্যাঞ্চল খাগড়াছড়ি আর ত্রিপুরার মধ্যখানে বয়ে যাওয়া ফেনী নদীটি দুই দেশকে ভাগ করে রেখেছে। এপারে বাংলাদেশের রামগড় উপজেলা আর ওপারে ত্রিপুরার সাব্রুম অঞ্চল। নদী পার হয়ে মাত্র কয়েক’শ গজ হাটলে সাব্রুম বাজার। বাজারের পার্শ্বেই প্রতিবছর বসে বারুণি মেলা। সকাল ৭টা থেকেই শুরু হয় বারুণী স্নানোৎসব। স্নান কিংবা পূঁজা আর্চণা ছাড়াও দুই দেশে অবস্থানকারি আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্য অনেকে দূর দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসেন।

বহুকাল থেকেই এদিনে দুদেশের সীমান্ত অঘোষিতভাবে কিছু সময়ের জন্য উন্মুক্ত থাকার সুবাদে এপার বাংলার মানুষ ছুটে যায় ওপারের সাবরুম মহকুমা শহরে, আবার ওপারের লোক এসে ঘুরে যান রামগড়। এ মেলাকে ঘিরে দুদেশের মানুষের মধ্যে তৈরী হয় ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন। বারুণী মেলায় শুধু বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নয়, ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা, মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সমাগম ঘটে এখানে। বারুণী স্নান একটি ধর্মীয় উৎসব হলেও দুদেশের বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও ধর্মের মানুষের সমাগমে এটি সার্বজনীন আনন্দ মেলায় পরিনত হয়েছে।

সরেজমিনে দেখাযায়, রামগড় বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ফেনী নদী পার হয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশী এ মেলায় অংশগ্রহণ করছে। নদীর মাঝখানে শতাধিক সাধকের মন্ত্র নিয়ে স্নান করছে হিন্দু ধর্মালম্বীরা। দুই পার্শ্বে শত শত নিরাপত্তা কর্মী বিজিবি-বিএসএফ কঠোর ভাবে দায়িত্ব পালন করছে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার সীমান্ত অতিক্রম করা অনেকটাই সহজ ছিল। কারণ এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় নদীর পানি কম ছিল।

নদী পার হয়ে মাত্র কয়েকশ গজ হাটলেই দেখা মিলবে সাব্রুম বাজার। প্রথমেই ঘুরে দেখলাম পুরো বাজারটি। বাজারের প্রতিটি দোকানেই ছিল ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। মূল মার্কেটে যেতে হয় সাব্রুম থানা সামনে দিয়ে। এখানে বসানো হয়েছে পুলিশ চেক পোস্ট। এর পার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন ভারতীয় পুলিশ। আমাদের সাথে ছিল সাব্রুম প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক, মান্ন চৌধুরী, বন্ধন দাস, প্রতাপ বনিক সহ দু’দেশের বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী।

তারা জানান, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আজকে কাউকে আটক করবে না পুলিশ। কাউকে আটক করা হলেও বিকেল ৫টায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। অন্যথায় বাংলাদেশে ভারতের যারা বেড়াতে গেছে তাদের আটক করে রাখবে বিজিবি। সবাই মিলে বিভিন্ন জায়গা ঘুরলাম, অনেক কেনা-কাটা করলাম। বিল দিতে গিয়ে দেখি অবাক কাণ্ড, বাংলাদেশের ১০০টাকা সমান ভারতের ৭০টাকা।

মেলায় ঘুরতে আসা ভারতীয় দর্শনার্থী সাব্রুম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী (৪ বান্ধবী) তুন্না সরকার, সুইটি মগ, সৌনিয়া দাস ও রিতা পাল জানান, প্রতিবছর বারুণীর এ মেলায় বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ আসে, আমরাও তাদের দেশে যাই। এ মেলাকে ঘিরে উভয় দেশের মানুষের মাঝে গড়ে উঠে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আর এই দিনটিকে আমরা পার্শ্ববর্তী দেশের অতিথিদের নিয়ে দারুণ ভাবে উপভোগ করি।

সারাদিন কেনাকাটা, আত্মীয় স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ আর আনন্দ-উল্লাস শেষে বিকেলে নিজ দেশে ফেরার পালা। ফেরার সময় তেমন একটা বাধাঁর সম্মুখীন হতে হয় নি। তবে জেনে রাখা ভাল, ভারতীয় পণ্য ক্রয় করে মূল ফটক দিয়ে না আসাই উত্তম। কারন মূল ফটকে (চেক করা হয়) সবসময় বিএসএফ অবস্থান করে। সুতরাং সামান্য অসাবধানতাই তীরে এসে তরি ডুবার কারণ হতে পারে।

এদিকে রামগড় বাজার মুখরিত হয়ে উঠে ভারতীয়দের কেনাকাটা ও পদচারণায়। বারুণী মেলা উপলক্ষে দু’দেশের সীমান্ত অঘোষিতভাবে উন্মুক্ত থাকায় ওপারের সাবরুম থেকে হাজার হাজার ভারতীয় বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত ধেয়ে আসে রামগড়ে। একইভাবে রামগড় থেকেও ওপারে যান অগণিত মানুষ। ভারতীয়রা রামগড় বাজার থেকে সেমাই, নারিকেল, সাবান, শুটকি মাছ ইত্যাদি কিনে নিয়ে যায়। আবার ওপারের সাবরুম থেকেও এপারের লোকজন বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে আনে। আর কেনা কাটার সুবিধার্থে রামগড় বাজারের অলিগলিতে কতিপয় লোক দুদেশের টাকা বদলের ব্যবসা করেছে।

ঐতিহ্যবাহি এ বারুণী মেলা সম্পর্কে রামগড়ের অধিবাসি ও অসরপ্রাপ্ত সহকারি জেলা শিক্ষা অফিসার রামেশ্ব শীল বলেন,  ভারত বিভক্তির পূর্বে এখানে বারুণী মেলায় বাংলাদেশ ভারত দু’দেশের দূর-দূরান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল পুণ্যার্থীর সমাগম হত। পাকিস্তান আমলেও ফেনী নদীতে বারুণী মেলা বসতো। অবশ্য তখন দুদেশের সীমান্ত পারাপারের সুযোগ ছিল না। দেশ স্বাধীনের পর থেকেই এ মেলাকে ঘিরে সীমান্ত আইনের অঘোষিত শিথিলতার কারণে দুদেশের মানুষ একে অপরের সান্যিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, এ মেলাটি এখন দুদেশের সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়েছে। ধর্মীয় রীতি পালনের পাশাপাশি দুদেশে অবস্থানরত আত্মীয় স্বজনদের দেখা সাক্ষাতেরও একটি চমৎকার ক্ষেত্র হয়েছে এ বারুণী মেলা।’ দুই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার  মানুষ এ বারুণী মেলায় আসেন আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে। বাঙালী হিন্দু ছাড়াও সনাতন ধর্মাবলম্বী  ত্রিপুরা সমপ্রদায়ের অসংখ্য পুণ্যার্থীর সমাগম হয় এখানে। চট্টগ্রাম, ফেনী, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, মানিকছড়ি প্রভৃতি এলাকা থেকে অসংখ্য নারী পুরুষ পুণ্যস্নানে অংশ নিতে ছুটে আসেন ফেনী নদীতে। বাংলাদেশ ভারত দু’ দেশের পাহাড়ি বাঙালী, বিভিন্ন ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায়ের আবালবৃদ্ধবণিতার বিপুল সমাগমে ফেনী নদী পরিণত হয় এক মিলন মেলায়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন