বাঙালিরা দরখাস্ত কম করে, তাই উন্নয়ন বোর্ডের শিক্ষা বৃত্তি কম পায়

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শিক্ষা বৃত্তির জন্য বাঙালি শিক্ষার্থীরা দরখাস্ত কম করে, তাই তারা বৃত্তি কম পায়। একই কারণে পূর্বের মতো ২০২২-২৩ অর্থ বছরেও তারা কম বৃত্তি পেয়েছে, এমনটাই জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

গত ১৭ অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (পরিকল্পনা) মো. জসীম উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের শিক্ষা বৃত্তি প্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করে উন্নয়ন বোর্ড। এবার উন্নয়ন বোর্ড ২ হাজার ১শ’ ৯৯ শিক্ষার্থীকে বৃত্তির জন্য নির্বাচিত করেছে। তাদের মধ্যে কলেজ পর্যায়ের ৯শ’ ৪৫ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ১ হাজার ২শ’ ৫৪ শিক্ষার্থীকে বৃত্তির জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। এবার রাঙামাটির ৭শ’ ৫৪ জন, বান্দরবানের ৬শ’ ৯৫ জন এবং খাগড়াছড়ির ৭শ’ ৫০ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। কলেজ পর্যায়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ৭ হাজার এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ১০ হাজার টাকা করে এককালীন বৃত্তি দেবে উন্নয়ন বোর্ড।

পার্বত্যনিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বৃত্তি প্রাপ্ত ২ হাজার ১শ’ ৯৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে এবার বাঙালি শিক্ষার্থী ৬শ’ ৯৫ জন (৩১ দশমিক ৬১ শতাংশ) এবং অবাঙালি শিক্ষার্থী ১ হাজার ৫শ’ ৪ জন (৬৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ)। জনসংখ্যার দিক থেকে উভয় জনগোষ্ঠির সদস্য সংখ্যা প্রায় সমান সমান হলেও দুই সম্প্রদায়ের বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী সংখ্যার ব্যবধান প্রায় ৩৭ শতাংশ।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জনগোষ্ঠির মানুষ বসবাসর করে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা বৃত্তিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা জাতিগোষ্ঠিগুলোর মধ্যে সুষমভাবে বণ্টিত হয় না বলে অনেকের মধ্যেই বঞ্চনাবোধ এবং ক্ষোভ রয়েছে। এই বঞ্চনা এবং ক্ষোভ প্রশমনের ভালো উপায় হলো যেকোনো সুযোগ-সুবিধা জাতিগোষ্ঠিগুলোর মধ্যে জনসংখ্যানুপাতে সুষমভাবে বণ্টন করা। পাশাপাশি এসব সুবিধা বণ্টনের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। অন্যান্য বছর বৃত্তি প্রাপ্তদের নাম এবং জনগোষ্ঠির পরিচয়সহ তালিকা প্রকাশ করাও হয়েছে। কিন্তু এবার নাম-পরিচয় বাদ দিয়ে শুধু বৃত্তি প্রাপ্তদের আইডি নম্বর প্রকাশ করায় কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। এতে কোন জনগোষ্ঠির কতজন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে, তা নিয়ে যেমন অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে, তেমনি যেসব শিক্ষার্থী আবেদন করার সময় প্রাপ্ত তাদের আইডি নম্বর ভুলে গেছে বা হারিয়ে ফেলেছে তারা বৃত্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে।

অন্যদিকে বৃত্তি প্রাপ্তদের পূর্বের মতো নাম-পরিচয় প্রকাশ না করাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছেন পার্বত্য বাঙালি নেতৃবৃন্দ। তাদের বক্তব্য, উন্নয়ন বোর্ডের শিক্ষা বৃত্তিতে কোনো সময়ই বাঙালিদের ন্যায্য সংখ্যায় সুযোগ দেয়া হয় না। নাম এবং জনগোষ্ঠির পরিচয় সম্বলিত তালিকা দেখে যে কেউ বাঙালিদের প্রতি এই বৈষম্যের বিষয়টি বুঝতে পারতেন। যার ফলে সমালোচনার মুখে পড়তে হতো উন্নয়ন বোর্ডকে। সেকারণেই এবার তারা নাম-পরিচয় বাদ দিয়ে শুধু আইডি নম্বর প্রকাশ করে সত্য আড়াল করার কৌশল নিয়েছে।

আরও পড়ুন:

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শিক্ষা বৃত্তিতে বৈষম্যের শিকার বাঙালিরা

রাঙামাটি জেলা পরিষদ শিক্ষাবৃত্তির ৩৩.২৩ শতাংশ পেয়েছে বাঙালিরা

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শিক্ষাবৃত্তি এবং বাঙালি-অবাঙালির বৈষম্য সমাচার

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ (পিসিসিপি)’র রাঙামাটি জেলা সভাপতি হাবীব আজম বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শিক্ষা বৃত্তিতে বরাবরই বাঙালিদের সাথে বৈষম্য করা হচ্ছে। এবারও তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, আর সেই বঞ্চনার তথ্য আড়াল করতেই নাম-পরিচয় বাদ দিয়ে শুধু আইডি নম্বর প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।’

তিনি আরো বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে সব ক্ষেত্রেই বাঙালি এবং অবাঙালির মধ্যকার বৈষম্যটা থাকেই। একই আলো-বাতাসে বড় হওয়া শিক্ষার্থীদের সামনে এটা ভালো কোনো উদাহরণ নয়। বরং এটা বাঙালি শিক্ষার্থীদের মনে বঞ্চনার স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে, যা তাদের ভবিষ্যতের কর্মজীবনেও থেকে যায়। তাই, পাহাড়ে যারা শান্তির স্বপ্ন দেখেন তাদের এখন ভাবার সময় এসেছে। কাউকে বঞ্চিত করে নয়, বরং যার যার যথাযথ প্রাপ্য দিয়েই সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদের সাবেক সভাপতি ও উপদেষ্টা মিনহাজ মুরশীদ ত্বকী বলেন, ‘উন্নয়ন বোর্ডের বৃত্তির এবারের তালিকাটা দেখে একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। সাম্প্রদায়িকভাবে একটা প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে ব্যবহার করতে পারে উন্নয়ন বোর্ড তার জ্বলন্ত প্রমাণ। গতবছর ২০/২৫ শতাংশ বাঙালি ছাত্রদের বৃত্তি দিয়েছে বলে আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। এবার তাই নামই উল্লেখ করে নাই।’

ত্বকী আরো বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করেছি, বৃত্তি পেয়েছে কিনা। তারা বললো, পায়নি। আবার উনারা (উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ) বলেন, বাঙালি ছেলেমেয়েরা আবেদন করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে যদি কেউ বৃত্তি না পায়, তাহলে বৃত্তি পায় কারা, এটাই প্রশ্ন।’

এ ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (পরিকল্পনা) মো. জসীম উদ্দিন পার্বত্যনিউজকে জানান, ‘সব সময় তালিকা একইভাবে প্রকাশ করতে হবে, এমন কোনো শর্ত তো নেই।’

এবার বৃত্তি প্রাপ্তদের তালিকায় বাঙালি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কেমন হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে যেভাবে বৃত্তি প্রাপ্তদের সংখ্যা নির্ধারিত হতো, এবারও তাই হয়েছে।’

২০২১-২২ অর্থ বছরে বৃত্তি প্রাপ্তদের মধ্যে বাঙালি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশ ছিল, অথচ জনসংখ্যার দিক থেকে তারা ৫০ শতাংশের বেশি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাঙালি শিক্ষার্থীরা দরখাস্ত কম করে, তাই তারা বৃত্তি কম পায়।’

এ ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘শিক্ষা বৃত্তির কমিটিতে আমি এবারই প্রথম যুক্ত হয়েছি। আগে বিষয়গুলো কীভাবে দেখা হয়েছে, এখন কীভাবে হয়েছে, সেটা বলতে হলে অন্যদের সাথে কথা বলতে হবে। আর আইডি নম্বর ভুলে যাওয়ার কারণে নির্বাচিতদের মধ্যে কোনো শিক্ষার্থী যেন বৃত্তি থেকে বঞ্চিত না হয়, তার জন্য বোর্ডের পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

২০২২ সালের জনশুমারি মতে, পাহাড়ে বাঙালি জনসংখ্যা ৫০ দশমিক ০৬ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থ বছরে বাঙালি শিক্ষার্থীরা ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশ শিক্ষা বৃত্তি পেয়েছিল। এ ধরনের বৈষম্য তাদের মধ্যে বঞ্চনার অনুভূতি ও ক্ষোভ তৈরি করে। বাঙালি শিক্ষার্থীদের এই বঞ্চনা ও ক্ষোভ লাঘবে কোনো উদ্যোগ নেবেন কিনা জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, ‘আমি মাত্র তিন মাস আগে এখানে দায়িত্ব নিয়ে এসেছি। শিক্ষা বৃত্তি বণ্টনের ব্যাপারে উন্নয়ন বোর্ডের একটি সিস্টেম ডেভেলপ করা আছে। সেই সিস্টেম অনুযায়ীই এবারো বণ্টিত হয়েছে। তবে এ সিস্টেমে কোনো সমস্যা থাকলে বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান এবং সদস্যরা আছেন তাদের সাথে আলোচনা করে দেখতে পারি। কিন্তু একটা সিস্টেম পাল্টানো খুবই কঠিন বিষয়।’

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন