বান্দরবানে বীর-রাজ পুত্রের মধ্যে লড়াই হবে সমানে সমান

নিজস্ব প্রতিবেদক, বান্দরবান:

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ নম্বর বান্দরবান আসনে প্রধান দুই প্রার্থী আওয়ামী লীগের বীর বাহাদুর উশৈসিং এবং বিএনপির সাচিং প্রু জেরী প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।

দুজনেই এলাকায় গণসংযোগ করতে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের পাড়ায় পাড়ায় ভোটারদের কাছে ভোট চাইছেন। আবার কখনো দুর্গম এলাকায় পানসি বোট নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় হেটে হেটে গণসংযোগ ও পথ সভা করে যাচ্ছেন। বান্দরবান পার্বত্য জেলা হওয়ায় দুর্গম এলাকাগুলো প্রার্থীদের গণসংযোগ করতে পারা-না পারার সংশয় দেখা দিয়েছে। হেভি ওয়েট এ দু-প্রার্থী ছাড়াও ইসলামী আন্দোলনের (হাতপাখা) প্রার্থী মুফতি শওকতুল ইসলাম নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলার ৭টি উপজেলা এবং দুটি পৌরসভা নিয়ে বান্দরবান আসন গঠিত। প্রার্থীরা এখনো দুর্গম এলাকাগুলো গণসংযোগ শেষ করতে পারেনি।

বীর বাহাদুর বলেছেন, উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমি কারো সাথে আপস করি নাই। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বান্দরবানকে পর্যটক বান্দব গড়ে তুলব। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাধন আরও দৃঢ করার প্রচেষ্টা চালাব। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে নৌকায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

অন্যান্য জেলায় বিরোধী জোটের গণসংযোগে হামলার ঘটনা ঘটলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী বীর বাহাদুর উশৈসিং রাজনীতিতে সহশীল হওয়ায় বান্দরবানে ছিল তা বিপরিত। বীর বাহাদুর টানা পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন ও পর্যটন বিকাশে অবদান রেখেছেন। এছাড়া স্থানীয় সূত্রগুলো দীর্ঘদিন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকায় অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় সব প্রান্তিক এলাকায় এবং দীর্ঘদিনের জনসস্পৃক্ততাসহ নানা কারণে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বীর বাহাদুরের জনপ্রিয়তা রয়েছে তুঙ্গে।

অন্যদিকে সাচিং প্রু জেরীর পিতা অংশৈ প্রু চৌধুরী জিয়া সরকারের খাদ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। পরে তিনি বোমাং সার্কেলের ১৫তম রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন। রাজ পরিবারের সদস্য হওয়ায় তিনি শহর থেকে দুর্গম এলাকায়ও বেশ পরিচিত ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। তিনি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান, সাবেক সাংসদ ও তৎতকালীন স্থানীয় সরকার পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকায় জেরীর জনপ্রিতাও সেই তুলনায় কম নেই। মৌজা হেডম্যান, পাড়ার কার্বারিসহ পুরনো সময়ের মানুষের কাছে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে।

তবে রাজপরিবারের অভ্যান্তরীণ কোন্দল দীর্ঘদিন জেলায় বিএনপি রাজনীতিতে প্রভাপ পড়ে। দলের মনোনয়ন প্রার্থীর পক্ষে একসাথে জেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এখনো পর্যন্ত গণসংযোগ করতে দেখা যায়নি। জেলা কমিটির সভাপতি মিসেস মাম্যাচিং, সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রেজা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন তুষার সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলেছেন, আমরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে চাই। কিন্তু সাচিং প্রু’র আচরণে মনে হচ্ছে নির্বাচনী মাঠে তিনি তাদের সহযোগিতা চান না। এরপরও মিসেস মাম্যাচিং, সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রেজার নেতৃত্বে পৃথক ভাবে বিএনপির প্রার্থী সাচিং প্রু জেরীর পক্ষে প্রচার প্রচারা চালাতে দেখা গেছে।

এর আগেও নির্বাচনের মাঠে এই দুই প্রার্থীর মধ্যে তিনবার দেখা হয়েছে রাজনীতির মাঠে। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে। প্রতিবারেই আওয়ামী লীগের বীর বাহাদুর উশৈসিং এর নৌকার কাছে হেরে যান সাচিং প্রু জেরী।

সাচিং প্রু জেরী বলেছেন, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা হবে। এবং সম্প্রীতির জেলা গড়ে তোলা হবে।

গনসংযোগ ও প্রচার প্রচারণায় আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকলেও দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আইনগত কারণে নির্বাচনী মাঠে তারাও পুরোপুরি কাজ করতে পারছেন না। জেলা কমিটির সভাপতি ক্যশৈহ্লা বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাহী দায়িত্ব পালন করায় নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে তাঁর প্রকাশ্যে অংশ নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইসলাম বেবীও বান্দরবান পৌরসভার মেয়র হিসেবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধান। ফলে তাঁকেও কাজ করতে হচ্ছে গা বাঁচিয়ে। এর ফলে অপেক্ষাকৃত নবীন রাজনীতিকদের নৌকার কাজ করতে হচ্ছে।

তবে বীর বাহাদুরের পক্ষে গান গেয়ে ক্যাম্পিং করে সাড়া জাগিয়েছেন স্থানীয় শিল্পী সমাজ। তারা প্রান্তিক এলাকাগুলোতে গিয়ে ভোট চাইছেন এটিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন সবাই।

জেলা আওয়ামী লীগের (বহিস্কৃত) সভাপতি প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও (বহিস্কৃত) সম্পাদক কাজী মজিবুর রহমান নির্বাচনে নৌকার প্রতিকের জন্য দৌড়ঝাপ করেন। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বীর বাহাদুরের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন গেরিলা নেতা প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা। সে সময় তাকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। তারপরও নৌকার প্রার্থী বিজয় লাভ করে।

প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও কাজী মজিবুর রহমান নিশ্চুপ থাকলেও আওয়ামী লীগের মধ্যে আতংক দেখা দিয়েছে। কাজী মজিবুর রহমান বর্তমানে কুমিল্লায় ৫ আসনে এক আওয়ামী লীগ নেতার পক্ষে নির্বাচনি গণসংযোগ করছেন। তারপরও মঙ্গলবার রাতে তার ভাই মো. ইকবাল ও তার আত্মীয় মো. হান্নানসহ প্রায় ২০জনকে বুধবার দুপুরের মধ্য এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ। এবিষয়ে পুলিশ সুপার জাকির হোসেন অস্বীকার করলেও সদর থানার এসআই বিপুল চন্দ্র সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে তাই ওপারের নির্দেশেই এটি করা হয়েছে।

১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রকাশ্য আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়। ২০০৮ সালে জনসংহতি সমিতি নিজস্ব প্রার্থী দেয়। তবে দু’বছর আগে সদর উপজেলার সংগঠনিক সম্পাদক মংপু মারমা অপহরণের ঘটনায় চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সদস্যদের দায় করে জেলা আওয়ামী লীগকে। এঘটনায় সংগটনটির প্রায় ২০ নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করা হয়। অনেক নেতা কর্মীকে জেলে যেতে হয়। এ ঘটনার পর থেকে চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে সাপে নেউলে ভাব হয়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি এখনো কাউকে সমর্থন দেয়ার খবর পাওয়া যায়নি। যদি বিএনপি প্রার্থীকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমর্থন দেয় এবং দলে ফিরতে না পেরে বহিষ্কৃত প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা এবং কাজী মজিবের সমর্থনও তিনি পেয়ে যায় তাহলে হিসেব নিকাশ অনেক পাল্টে যেতে পারে।

ভোটাররা বলেছেন, ঘরে ঘরে গিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে ক্যাম্পিং-এর চেয়ে আনুষ্ঠানিকতায় দু’পক্ষের কর্মীদেরই ঝোঁক বেশি দেখা যাচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন