বিষাদে পরিণত জয়নালের পরিবার, স্বপ্ন ভেঙে চুরমার ছেলে-মেয়ের

fec-image

দেশে প্রতিদিন কোথাও না কোন এলাকায় ঘটে চলছে সড়ক দুর্ঘটনা। নিত্যদিন সড়কেই পিষ্ট হচ্ছে তাজা প্রাণ। এই সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাচ্ছে বহু পরিবারের হাজারো স্বপ্ন ও আশা। অনাকাক্ষিতভাবে কোন দুর্ঘটনার মৃত্যু শুধু একটি জীবনের পরিসমাপ্তি নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পুরো পরিবারের ভবিষ্যৎ। অনেক পরিবার হারায় তাদের একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বনও।

বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে সাতটার দিকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চকরিয়া উপজেলার উত্তর হারবাং কলাবাগান এলাকায় যাত্রীবাহী পিকনিক বাসগাড়ি ও মিনি পিকআপ (লেগুনা) গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় লেগুনা গাড়ির যাত্রী ও নির্মাণ শ্রমিক জয়নাল আবেদীনসহ ৪ জন ঘটনাস্থলে নিহত হয়। এছাড়াও এ দুর্ঘটনায় আরো পাঁচজন গুরুতর আহত হয়।

মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় পিষ্ট হওয়া নির্মাণ শ্রমিক জয়নালের পরিবারের নেমে আসে চরম অন্ধকার। জয়নালসহ একই এলাকার চারজন সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর খবরে পুরো গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। নিহতদের পরিবার ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে সেখানকার পরিবেশ। হতবিহ্বল হয়ে বারবার চিৎকার করছেন জয়নালের শিশু সন্তান ও ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পডুয়া কন্যা এবং তার স্বজনেরা। দরিদ্র পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন নির্মাণ শ্রমিক জয়নাল আবেদীন। তার একমাত্র আয়-রোজগারে চলছিল পরিবারের সংসার।

জীবনের তাগিদে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো জয়নাল। তার তিন মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। সবাই স্কুলে লেখাপড়া করে। পরিবারে আয়ের কোন উৎসও নেই তার। থাকার জন্য নেই নিজের কোন বসতভিটাও। শ্বশুর বাড়ির সাথে পলিথিন দিয়ে একটি বারান্দা তৈরি করে কোন রখম ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সেখানে বসবাস করতো তিনি।

শুক্রবার (২৯ ডিসেম্বর) সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত নির্মাণ শ্রমিক জয়নাল আবেদীনের বাড়িতে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। তার ৬ষ্ট শ্রেণিতে পডুয়া মেয়ে তাসমিন আক্তার বাবা জয়নালের নানা ধরণের কথা ধরে ধরে বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। অঝোর ধারায় কেঁদে কেঁদে বলতেছে ‘সকালে উঠে আর কোনো দিন নাস্তার টাকা দিয়ে যাবে না আমার বাবা। যাবার সময় ছোট ভাইকে ঘুমের মধ্যে আদর করবে না বাবা।’ এমন বিলাপ করে কাঁদতে থাকে মেয়ে তাসমিন। তার নানীসহ আত্মীয়স্বজনরা স্বান্তনা দিলেও তার বিলাপ থামাতে পারছে না কেউ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, বাবার স্বপ্ন ছিল টাকা রুজি করে আমাদেরকে সুখ দেয়া। আজ সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের স্বপ্ন ও সুখ দুটিই শেষ। উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের পূর্ব বৃন্দাবনখীল জয়নালের বাড়িতে গেলে এ করুণ দৃশ্য দেখা যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত জয়নালের ছোট ছেলে ওমর ফারুক বাবার সাথে তোলা ছবির দিকে বার বার তাকিয়ে বলে যাচ্ছেন, আমার বাবা কই? আমার বাবা কই? তার এ কথা যতবার বলে যাচ্ছে ততো পরিবারের স্বজনেরা কেঁদে উঠে। বাবা’কে হারিয়ে ছোট ভাই ফারুকের কান্না কেউ থামাতে পারছেনা। এখনো জানতে পারেনি তার বাবা এ পৃথিবীর বুকে আর বেঁচে নেই। বাবা ও সন্তানের ভালবাসা মাখা এ বন্ধন হঠাৎ এভাবে বিষাদে পরিণত হবে তা কখনো ভাবেনি মেয়ে তাসমিন। মেয়েকে ঘিরে ছিল নির্মাণ শ্রমিক জয়নালের আকাশসম নানা স্বপ্ন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় ছেলে-মেয়ের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত জয়নালের স্ত্রী আয়েশা বেগম বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার দিকে ছেলে মেয়েদের নাস্তার জন্য ২০ টাকা দেয়। ছোট ছেলেকে ঘুমের মধ্যে আদর করে ঘর থেকে বের হয়। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার দরবেশহাট এলাকায় একটি বিল্ডিংয়ের ছাদ ঢালাইয়ের কাজে যোগ দিতে লেগুনায় উঠে জয়নালসহ ১২ জন শ্রমিক।

তিনি আরো বলেন, ঢালাই কাজের শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সংসার চালাতো। এখন চার সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। কি করবো কূল-কিনারা কোন কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন