মণিপুর মর্গে পড়ে আছে প্রায় ১০০ মৃতদেহ , শনাক্ত করতে আসছে না কেউ

fec-image

ভারতের মনিপুরে জাতিগত দাঙ্গয় গত চার মাসের সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ১৭৫ জন নিহত হয়েছে। কয়েকটি হাসপাতালের মর্গে বেওয়ারিশ ৯৬ জনের লাশ পড়ে আছে। যার জন্য এখনো কেউ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেনি। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ভয়ে লোকজন হাসপাতাল থেকে স্বজনদের লাশ নিয়ে যাচ্ছেন না।

এই পরিস্থিতিতে এখন সুপ্রিম কোর্ট গঠিত সাবেক বিচারপতিদের একটি কমিটি রাজ্য সরকারকে মৃতদের একটি তালিকা প্রকাশ্যে প্রকাশ করার পরামর্শ দিয়েছে, যাতে মৃতদের শনাক্ত করা যায় এবং লাশগুলো তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা যায়।

তাতেও যদি কোনো লাশের কোনো দাবিদার না এগিয়ে আসেন, তাহলে সসম্মানে অন্তিম সংস্কার করে দেয়া হোক।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মনিপুরে জাতিগত সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ১৭৫ জন নিহত হয়েছেন, আহত ১১৮ জন এবং অনেকে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।

মনিপুর রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই এবং কুকি উপজাতিদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গা বেধেছে। এই গোষ্ঠী দুটি রাজ্যের দুটি ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাস করে।

দাঙ্গার পর এখন পরিস্থিতি এমন যে, এক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ অন্য গোষ্ঠীর ভূখণ্ডে যেতে পারে না। সমগ্র মনিপুর রাজ্য জাতিগত ভিত্তিতে ভাগ হয়ে গেছে।

সহিংসতার ঘটনা এখনো ঘটছে।

গোষ্ঠীভিত্তিক এলাকা ভাগ:
মনিপুরের রাজধানী ইম্ফলের সিনিয়র সাংবাদিক ওয়াহেংবাম টেকেন্দর সিং বিবিসিকে বলেন, জাতিগত সহিংসতায় নিহত ৯৬ জনের লাশ ইম্ফলের দুটি হাসপাতালে রাখা হয়েছে- রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস, জওহরলাল নেহেরু ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস এবং চুড়াচাঁদপুরের রিজিওনাল মেডিকেল কলেজ।

ইম্ফল উপত্যকায় মেইতেই গোষ্ঠীর আধিপত্য রয়েছে এবং এখানকার দুটি হাসপাতালে রাখা লাশগুলো কুকি নৃগোষ্ঠীর অন্তর্গত। চুড়াচাঁদপুরের জেলা মেডিক্যাল হাসপাতালে যে লাশগুলো রাখা হয়েছে তার মধ্যে কুকি এবং মেইতেই উভয় গোষ্ঠীরই দেহ রয়েছে, যদিও তাদের মধ্যে কুকিদের লাশের সংখ্যা বেশি।

‘সমস্যা হলো- দাঙ্গার পরে কুকিরা মেইতেইর এলাকায় যেতে পারে না এবং মেইতেই সম্প্রদায়ের লোকেরা কুকিদের এলাকায় যেতে পারে না।’

‘আইন অনুযায়ী, নিহতদের পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগতভাবে হাসপাতাল মর্গে গিয়ে দেহ শনাক্ত করতে হয় এবং পরিবারের সদস্যরা একে অন্য জাতির অঞ্চলে যেতে না পারায় কয়েক মাস ধরে এসব দেহ শনাক্তকরণ ছাড়াই এখানে রাখা হয়েছে,’ বলছিলেন সিং।

পারস্পরিক বিশ্বাস ভেঙ্গে গেছে
তিনি বলেন, অত্যন্ত সংবেদনশীল পরিস্থিতির কারণে হাসপাতালগুলো এখনো ওই সব দেহগুলোর ছবি ও সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করেনি।

কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনী চেষ্টা করছে যাতে নিহতদের পরিবার গিয়ে লাশগুলো অন্তত শনাক্ত করতে পারে, যাতে তাদের সৎকার করা যায়, কিন্তু তাও সম্ভব হচ্ছে না।

সিং বলেন, গত কয়েকদিনে এখানে গুলি বর্ষণের ঘটনা কমেছে, যার ফলে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমেছে।

তবে সমস্যা হচ্ছে, উভয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস ও ঘৃণার ব্যবধান এতটাই গভীর হয়ে উঠেছে যে তা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর দুই গোষ্ঠীরই আস্থা কমে যাওয়ায় সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠছে।

তার মতে, মেইতেই গোষ্ঠীর লোকেরা সেনাবাহিনী এবং আসাম রাইফেলসের যাতায়াতের পথে বাধা সৃষ্টি করে। তাদের অভিযোগ, তারা কোনো রকম সাহায্য করেন না, অন্যদিকে কুকি গোষ্ঠী রাজ্য পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে মেইতেই গোষ্ঠীর সমর্থক বলে তাদের এলাকায় ঢুকতে দেয় না। পারস্পরিক বিশ্বাস ভেঙে যাওয়াই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা।

৪১ হাজার কুকি শিবিরে:
ইনডিজেনাস ট্রাইবাল লিডারস ফোরামের সেক্রেটারি মাওয়ান তেভেম্বেং বিবিসিকে বলেন, ইম্ফল উপত্যকায় গিয়ে লাশ শনাক্ত করা অসম্ভব, কারণ এটি মৃত্যুর উপত্যকার মতো। নিহতদের পরিবার তো সেখানে যেতে পারছেনই না, এমনকি আমাদের বিধানসভা সদস্যকেও সেখানে বেধড়ক মারধর করা হয়েছিল।

তার কথায়, বেশিরভাগ লাশ ছবি বা ফোনের মাধ্যমে শনাক্ত করা হলেও বৈধ কাগজপত্র জমা না দিতে পারায় কর্তৃপক্ষ নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করছে না।

তিনি জানান, এসব লাশ ছাড়াও ৪১ জন কুকি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। অনেক লাশ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, যার ফলে সেগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। নিহতদের নাম, বয়স ও অন্যান্য তথ্য দিয়ে বিবিসিকে একটি তালিকা পাঠিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই গোষ্ঠী ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলে এবং কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের অভিযোগের সমাধান করলেই পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

‘এখনো অস্থায়ী শিবিরগুলিতে ৪১ হাজার কুকি বসবাস করছেন। এমন পরিস্থিতি রয়েছে যা কয়েক দিনে স্বাভাবিক করা যাবে না। পরিস্থিতি নির্ভর করছে সরকারের অভিপ্রায়ের ওপর,’ বলছিলেন তেভেম্বং।

সরকার কী করছে?
সুপ্রিম কোর্ট গত মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক প্রধান বিচারপতি গীতা মিত্তলের নেতৃত্বে হাইকোর্টের তিন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির একটি কমিটি গঠন করেছিল। এই কমিটির কাজ মনিপুরে জাতিগত সহিংসতার মানবিক দিকগুলোতে সহায়তা করা।

কমিটি একটি রিপোর্টে সুপারিশ করেছে যে রাজ্য সরকারকে পাঁচ মাস ধরে চলা সহিংসতায় নিহতদের একটি তালিকা প্রকাশ করতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের পরিবারকে চিহ্নিত করতে হবে যাতে তাদের পরিবারকে নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়।

কমিটি বলেছে, যদি এই প্রচেষ্টা সফল না হয়, তাহলে জেলা কালেক্টরের উচিত উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করে পূর্ণ মর্যাদার সাথে লাশগুলো সৎকার করা।

সাংবাদিক ওয়াহেংবাম টেকেন্দর সিং বলেন, অজ্ঞাত পরিচয়ের লাশ সৎকার করা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এই পর্যায়ে, আমরা জানি না সরকার যদি এমন ঘোষণা দেয় তবে জনগণ কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

মনিপুর বর্তমানে উত্তেজনা আর সহিংসতার ভয়ে ডুবে রয়েছে। এখানে আবারো কয়েক দিনের জন্য মোবাইল ইন্টারনেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

হাজার হাজার মানুষ অস্থায়ী শিবিরে অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে বসবাস করছে এবং স্বাভাবিক জীবন পুরোপুরি বিপর্যস্ত। কতদিন পরিস্থিতি এরকম থাকবে সে বিষয়ে এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। সূত্র : বিবিসি

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: মণিপুর, মৃতদেহ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন